১) ৩য় দিনের মত রাত্রি কে হাসপাতালে দেখতে এসেছে নাজিয়া। গত দুদিন একটা কথাও বলেনি রাত্রি। আজও দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। প্রিয় বান্ধবির উপস্থিতি তার মনে এত টুকু আঁচড় কাটছে না। ডাঃ বলেছে আর কিছুটা দেরি হলেই ওই স্লিপিং পিল গুলো চিরদিনের মত ঘুম পাড়িয়ে দিত রাত্রি কে। নাজিয়া অবাক হয়! রাত্রির মত আদুরে একটা মেয়ে কেন সুইসাইড করতে যাবে! কিসের অভাব তার? বাড়ি,গাড়ি,ভালোবাসা না চাইতেই পায় সে। তবে কেন অমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে গেল রাত্রি? সেকি জানে না আত্মহত্যা মহা পাপ!
মনের ঝড় কে বাইরে প্রকাশ করে না নাজিয়া। রাত্রির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে উঠে আসে। নামাজের সময় হয়ে গেছে। চারদিকে আজানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মনে মনে আযানের জবাব দেয় নাজিয়া।
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই
২)
বাসায় ফিরে বসার ঘরে ঢুকতেই দেখল মৃদু খাতা কলম নিয়ে হাঁ করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। টিভিতে একটা হিন্দি ফ্যাশন শো এর প্রোগ্রাম চলছিল। নাজিয়া কে রুমে ঢুকতে দেখে মৃদু খুশি হয়ে বলল-
- নাজি একটু হেল্প করনা প্লিজ ! তোর তো আর্টের হাত খুব ভাল, আমি ডিজাইন গুলো ঠিক মত আঁকতেই পারছি না।
বয়সে দু বছরের বড় বোন কে বেশ কিছু কঠিন কথা শোনাতে চাচ্ছিল নাজিয়া। কিন্তু কি মনে করে যেন চুপ করে রইল। আজ আপুর সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে একদম ইচ্ছে করছে না তার। এই মুহূর্তে তার মন টা ভয়াবহ রকম শান্ত। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এই দরজা টাকে মাঝে মাঝে অনেক আপন লাগে। এটা যেন টাকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে রেখেছে।
বসার ঘর থেকে মৃদু তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের চেঁচামেচি শুনে রেহনুমা বেগম বেরিয়ে এলেন।
- কি হয়েছে? অমন চেচাচ্ছিস কেন?
- কি হয়েছে তা তোমার গুণধর মেয়েকে জিজ্ঞেস কর। আজকাল তার অনেক ভাব বেড়েছে!
ধীর পায়ে নাজিয়ার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। দরজায় নক করতেই নাজিয়া খুলে দিয়ে বলল
- কিছু বলবে মা?
মেয়ের এমন শান্ত প্রশ্নে প্রসঙ্গ পালটে নিলেন রেহনুমা বেগম ।
- না তেমন কিছুনা। আজ এত দেরি করলে যে?
মনে মনে একটু হাসল নাজিয়া। আজকাল মা ও বেশ কেয়ারিং হয়ে উঠার চেষ্টা করছে। অফিস, মিটিং এসবের মাঝেও মায়ের এই চেষ্টা খুব একটা খারাপ লাগেনা নাজিয়ার।
"আমি ঠিক সময়েই এসেছি বরং তুমিই আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছ" কথাটা মনে মনে গুছিয়ে নিল নাজিয়া। কিন্তু বলতে গিয়ে বলল,
- আজ একটু রাত্রির ওখানে গিয়েছিলাম।
- ও।
-তোমাকে অনেক বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে, এক গ্লাস লেবুর সরবত করে দিব মা?
- না মামনি। আমি ঠিক আছি।
আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান রেহনুমা বেগম। তার এই দুটো মেয়ে যেন দু প্রান্তের। একজন যতটা রাগী, বদমেজাজি আর একজন ঠিক ততটাই শান্ত। মাঝে মাঝে দুজনের মাঝখানে পড়ে নিজেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
৩) মৃদুর চাচাত বোন অমির বিয়ে। ডেইলি একবার করে শপিং এ যাচ্ছে মৃদু। সব কিছু তে তার পারফেকশন চাই। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলেই এল।
আজ সন্ধ্যা বেলায় হটাৎ তার মনে হল হাতের ব্রেসলেট টা ড্রেস এর সাথে ঠিক ম্যাচ করছে না। অমনি গাড়ি নিয়ে ছুটল শপিং মল এ। ৮/১০ টা দোকান ঘুরে ম্যাচিং ব্রেসলেট কিনে ঘণ্টা খানেক পর বাসায় ফিরল।
১০ টা বেজে গেছে। এখন ওঠা দরকার। থিসিস পেপার গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে ভাবল নাজিয়া। এতখনে নিশ্চয়ই মা আর আপু রেডি হয়ে গেছে।
কাপড়টা বদলে নিয়ে হিজাব পড়তে পড়তে মৃদুর রুমে ঢুকল নাজি। মৃদু তখন চোখে আই লাইনার লাগিয়ে বসে আছে শুকানোর অপেক্ষায়।
মেয়েকে দেখে চোখ কপালে তুলে রেহনুমা বেগম বললেন
- এখনও সাজগোজ করোনি ! কখন বের হব!
মিষ্টি করে হেসে নাজিয়া বলল,
- আমি তো তৈরি মা। আর সাজগোজ? চোখের আসল সৌন্দর্য বাড়ে যদি তা দিয়ে সুন্দর, পবিত্র কিছু দেখা হয়! ঠোটের সত্তিকারের সাজ তো সত্যি কথা বলা মা! ওসব মেক-আপ কিছু হয়না বরং ...।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল নাজিয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে মৃদু বল,
- শোন, বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। এখন তোর লেকচার শুনতে একদম ভাল লাগছে না।
এতক্ষণে মৃদু কে ভাল ভাবে দেখল নাজিয়া। কালো স্লিভলেস নেট এর ড্রেস এ অসাধারণ লাগছে নাজিয়া কে। যে কোন ছেলের চোখে নেশা ধরিয়ে দেয়ার জন্য ওই অর্ধনগ্ন দেহ যথেষ্ট!
৪)
মনোয়ার সাহেব এবার ওমরা হজ্বে যাচ্ছেন। ফিরতি পথে সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসার ইচ্ছা তাই খাবার টেবিলে বসে জিজ্ঞাসা করছিলেন কার কি লাগবে। মৃদু বিশাল এক লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। এবং বার বার বলে দিয়েছে যেন কোন কিছু বাদ না পড়ে ! শুধু নাজিয়াই চুপ।
-মামনি তোমার কি লাগবে বললে না তো ।
- আমার কিছু লাগবে না বাবা।
এই মেয়ে টা কখনই কিছু চাইবে না। মনে মনে বিরক্ত হয় মনোয়ার সাহেব।
- কিছু অন্তত ...
- বাবা তুমি হজ্বে তো যাচ্ছ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। নিজেকে প্রিপেয়ার্ড করে নিয়েছ তো?
- হ্যাঁ, শীতের কাপড়, এক্সট্রা ফোন, খাবার দাবার...
- আমি আত্মশুদ্ধির কথা বলছি বাবা! আত্মতৃপ্তি নয়!
২১ বছরের ছোট মেয়ে টার ইঙ্গিত এতখনে বুঝলেন মনোয়ার সাহেব। তার এই মেয়েটা যেন হটাৎ করেই বড় হয়ে গেছে অনেক! আজকাল সব কিছুতেই তার গোছানো পরিপাটি ইসলামিক ভূমিকা ভাবিয়ে তুলেছে মনোয়ার সাহেব কে। এই বয়সেও তিনি যা পারেন না তা কি করে পারে মেয়েটা?
৫)
বাবা মা কেউ বাসায় নেই আজ রাতে ফিরবেনও না। মৃদুর রুম থেকে হাই ভলিউম এ গান শোনা যাচ্ছে। কিছুখন পর পর ওর বান্ধবীদের অট্টহাসিতে পুর বাড়িটা কাঁপছে। নাজিয়া পড়তে পারছে না। অথচ কাল ওর ইনকোর্স পরীক্ষা।
অনেক সংকোচের পর মৃদুর রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল নাজি। ভেতর থেকে লক করা। কয়েকবার নক করেও যখন সাড়া পাচ্ছিল না তখন ভাবল ফিরে যাবে। ঠিক তখনি দরজা খুলল মৃদু। পুরো ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে! একটা অজানা শঙ্কায় নাজিয়ার বুক টা কেঁপে উঠল! উকি দিয়ে দেখল ওর বান্ধবীরা মিলে স্মোক করছে, সাথে ড্রিংকস আর বিশ্রী সব অঙ্গ ভঙ্গী করছে। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারল না নাজি।
শুধু বলল
-আপু তুই! বাবা জানলে!
মৃদু বিরক্ত হয়ে বলল- কি বলতে এসেছিস বলে চলে যা। জ্ঞান দিতে আসিস না।
নাজি কিছু বলতে পারছিল না। শব্দ গুলো গলার খুব কাছে এসে আটকে যাচ্ছিল।
বিড়বিড় করে বলল- ইয়া হাইয়ু ইয়া কাইউমু বিরাহমাতিকা আসতাগিছু...
( হে চিরঞ্জীব ! হে চিরস্থায়ী ! আমি তোমার রহমতের প্রত্যাশী )
মনে হচ্ছিল তার পায়ের নিচ থেকে যেন কেউ মাটি কেড়ে নিচ্ছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। আর কানে বাজছিল আপুর বান্ধবীর কথা- “ এটা তোর বোন মৃদু! বিশ্বাসই হয় না! এত আন-স্মার্ট !
৬)
আজ প্রায় অনেক দিন হল বাবা দেশের বাইরে। বাবার জন্য মনটা কেমন যেন করছে নাজিয়ার। ভোরের রক্তিম আলোয় ছেয়ে গেছে আকাশ টা। নাজিয়ার মন টাও সে আলোয় কানায় কানায় পূর্ণু । আজ প্রথম বার সে অর্থসহ কুরআন খতম দিয়েছে সে। অন্যরকম একটা পবিত্রতায় ভরে আছে মন টা। ভোরের এই মিষ্টি বাতাস, রক্তিম সূর্য সব কিছুই পবিত্র লাগছে। আজ নাজিয়ার খুব ইচ্ছে করছে মা কে দেকে তার সাথে গল্প করতে। মৃদুর সাথে এই ভোরের পবিত্রতা টুকু ভাগ করে নিতে।
মায়ের রুমে উকি দিয়ে দেখল মা পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে।
মৃদুর রুমে আল জ্বলছে! নিশ্চয়ই রাতে ইমন ভাইয়ার সাথে কথা বলতে বলতে বাতি নিভাতে ভুলে গিয়েছে। ঘরে ঢুকে অবাক হল নাজিয়া। মৃদু জেগে আছে। চোখ মুখ ভীষণ ফোলা। ওর টকটকে ফরশা গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারা রাত না ঘুমিয়ে কেঁদেছে।
চুপ চাপ মৃদুর পাশে গিয়ে বসল নাজিয়া। নাজিয়াকে আরও অবাক করে ওকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল মৃদু!
কোন কথা খুঁজে পেল না নাজিয়া। শুধু আসতে করে বলল –কি হয়েছে!
মৃদু চীৎকার করে বলল
imon has cheated me ! he does not NEED me anymore !
N he just has got more fashionable gf than me !
নাজিয়ার বিস্ময় আকাশ ছুঁলো ! সে শক্ত করে মৃদু কে বুকে আগলে রাখল। হয়ত ছেড়ে দিলেই মৃদু ও রাত্রির মত হারিয়ে যেতে চাইবে!
নাজিয়া জানে না আধুনিকতা কি। এর নামে রাত্রি-ইমন-মৃদুরা যা করছে টা ঠিক কিনা। ইসলামের আদর্শ পথ ছেড়ে তারা যে পথে হাঁটছে তা কত টা বিপদজনক সেটা কি তারা জানে?
এগিয়ে চলছে বিশ্ব । তার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছি আমরাও। সভ্যতার উৎকর্ষতার চূড়ান্ত সীমাকে ছুঁয়ে দিতে আমদের প্রচেষ্টার যেন অন্ত নেই ।
কিন্তু আমরা কি কখনও এই প্রচেষ্টা আর প্রাপ্তির হিসাব মিলিয়ে দেখেছি ?
আত্মিক প্রশান্তির সরবোরে কি অবগাহন করতে পেরেছি আমারা ?
তাহলে কেন এই অত্যাচারিত জনপদ?
কেন হায়েনাদের নখরাঘাতে ক্ষত বিক্ষত সভ্যতা?
একি তবে আমাদের অপরাধের নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ ?
আইয়ামে-জাহেলিয়া কি এর চেয়ে কঠিন সময় ছিল? তবে আর একজন মহাপুরুষ কেন আল্লাহ পাঠাচ্ছেন না? কেন তিনি আমদের মত দিক ভ্রান্তদের জন্য প্রার্থনা করছেন না – এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা কর।!
No comments:
Post a Comment