Subscribe:

উপন্যাসঃ শঙ্খচূড়

উপন্যাসটা শুরুর আগেই বলে নিচ্ছি এটার একটা ভূমিকা আছে। মোটামুটি একটা চ্যাপ্টার তুল্য ভূমিকা। যদিও এটাকে আমি চ্যাপ্টারের শ্রেণীতে ফেলতে রাজি নই।)
পূর্বকথাঃ 
আজ হাজী বাড়ির ভেতরে বাহিরে উপচে পড়া ভিড়। বহুকাল এত মানুষের সমাগম হয়নি মাঝারি সীমানার এ বাড়িতে। কুয়া পাড়েও জনা ছয়েক মানুষ পাঞ্জাবী পাজামা পরে এদিক ওদিক বিমর্ষ মুখে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে কোথাও বসার জন্য চেয়ার খুঁজছে- কিংবা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না এখানে থাকবে নাকি বাহিরে বেরিয়ে কোথাও থেকে দুকাপ চা, সাথে বিড়ি সিগারেট টেনে আসবে। কারণ এ বাড়িতে আজ খাওয়া দাওয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তত চুলা ধরবে না একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগ পর্যন্ত।

উঠানের কিশোর বয়সী ঝুলে পড়া আম গাছটার চারপাশে প্লাস্টিকের চেয়ার এদিক সেদিক বিছিয়ে রাখা। একটাও খালি নেই। গেদা বাচ্চা থেকে শুরু করে থুড়থুড়ে বুড়ো দিয়ে চেয়ার গুলো ভরে গেছে। উঠানের একপাশে সিমেন্টের ছাদ খোলা গোসল খানার ওপরে ছাদের মত বিছিয়ে মেলে ধরা জাম্বুরা গাছটায় ঝুলতে থাকা পাঁকা জাম্বুরাগুলো কিংবা কুয়াপাড়ের শিমুল গাছটার কড়া মিষ্টি গন্ধগুলো ছাপিয়ে যাচ্ছে তীব্র ধূপ কাঠি আর আগর বাতির গন্ধ। সাথে যোগ হয়েছে আতর গোলাবের মিষ্টি সুঘ্রাণ। সারা বাড়িতে মাজার মাজার ভাব এনে দিয়েছে ঘ্রাণটা। সবাই কথা বলছে নিচু স্বরে, যেন উচ্চ স্বরে কথা বললেই চারপাশের নিরেট থমথমে গুমোট ভাবটা কাঁচের মত ভেঙ্গে পড়বে। নিচু গলায় মেয়েলি স্বরে কেউ কাঁদছে, বোঝা যাচ্ছে না কে কোথায় কাঁদছে, কেবল ফোঁপানোর শব্দটুকুই জানান দিচ্ছে কান্নার। মাঝে মাঝে সব ছাঁপিয়ে জোরে কেউ কেউ কেঁদে ওঠে।
দু চারটে করে দেখতে দেখতে বাড়ির বাহিরে সুপারি বাগানের নিচে বিশ ত্রিশটা মোটর সাইকেল আর মাইক্রোবাস এসে জমাট হয়েছে। মেয়েরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে চোখে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকছে। পুরুষ লোকেরা অস্বস্তি ভরে আশে পাশের লোক জনের দিকে তাকাতে তাকাতে উঠানে ঢুকছে। পরিচিত কাউকে দেখা পাবার আশায় এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। পরিচিত তেমন কাউকে না পেলে এগিয়ে যাচ্ছে উঠানের মাঝখানে রাখা উত্তর দক্ষিণ মুখ করে রাখা খাটিয়াটার দিকে। কাবা ঘরের ছবি আর কালেমা লেখা সবুজ জমিনের একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আগর বাতির তীব্র গন্ধ যেন কুন্ডলী পাঁকিয়ে ঘিরে রয়েছে খাটিয়াটাকে। সাদা দামী একটা কাফনের কাপড়ে শুয়ে আছেন ডি.এম. খায়রুল আনাম। আল্প খানেক ফাঁক দিয়ে দর্শনার্থীরা তাঁর মুখটা দেখতে পাচ্ছে। একটু পরপর লাশের কাছে বসে থাকা একটা লাল পাঞ্জাবী পরা তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে রুমাল দিয়ে লাশের মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া কালো-সাদাটে রস মুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। কাফনের অল্প খানেক খোলা মুখ দিয়ে আকাশটা দেখা যায় আম গাছের পাতার ফাঁক গুলো দিয়ে। কিন্তু ডি.এম. খায়রুল আনাম সাহেব চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি চাপা ভাব নিয়ে পশ্চিম মুখো হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে সন্তান সন্ততি আর নাতি-নাতনিদের বেয়াড়াপনায় মহা বিরক্ত মাষ্টার সাহেব শীতের দুপুরে খাবার খেয়ে চোখ বুজে শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করছেন। নাতি-নাতনিরা ঘুমের চেষ্টারত মাষ্টার সাহেবকে ডাকলেই বুঝি চরম বিরক্তি নিয়ে ধমকে উঠবেন এখনি! চোখ মেলে তাকাবেন যেন!
বিরক্তি নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত ডি.এম. খায়রুল আনামের সদ্য বিধবা ষাটোর্ধ স্ত্রী তহমিনা বেগম ভেতরের ঘরে স্বামীর বিছানার পাশের নিজের বিছানায় লাল লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছেন। চুপচাপ। ঝিমুচ্ছেন যেন। তাকে ঘিরে তাঁর ছয় মেয়ে পিতা হারানোর কান্নায় মেঝে চৌচির করে কাঁদা শুরু করেছে সেই সকাল বেলা আসার পর থেকে। বাবা মারা যাবার কথা শুনে দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খায়রুল আনাম সাহেবের ছোট ছয় মেয়ে তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে ছুটে এসেছেন। নাত জামাই এবং তাদের সন্তানরাও বাদ যায়নি। বড় ছেলে গুলো এখনো আসেনি, কেবল একজন আছে। বাকি দুজন এখনো রাস্তায়। বাসে করে ঢাকা থেকে আসতে সময় লাগে।
বহু বছরের নিষ্প্রাণ হাজী বাড়ির পুরো দেহটায় যেন আজ প্রাণ জেগেছে একয়াত প্রাণের বিদায় জানিয়ে। তহমিনা বেগম শুয়ে শুয়ে এত ভিড়ের মাঝে পাশের বিছানাটা দেখবার চেষ্টা করছেন। খায়রুল আনাম সাহেবের এই বিছানাটা বিয়ের সময় তহমিনা বেগমের বাবা দিয়েছিলেন। খায়রুল সাহেব ঐ বিছানা ছাড়া কিছুতেই ঘুমাতে পারেন না। তহমিনা বেগমের অবাক লাগছে কেন জানি, হিসাব মেলাতে পারছেন না। এত কালের ঘুমের খাট বিষয়ক অভ্যাসটা এক মুহূর্তেই বদলে ফেলে তাঁর স্বামী বাহিরের উঠানের ঐ খাঁটিয়ায় কি করছেন তিনি বুঝতে পারছেন না। দূর্বল গলায় বার কয়েক বলার চেষ্টা করলেন সবাইকে, “এই তোরা কান্না থামা তো! তোদের আব্বাকে বল বিছানায় আসে ঘুমাইতে, এত শীতে বাহিরে কি করে? ওনাকে বল বিছানায় ছারপোঁকা নাই। আমি কেরাসিন দিছিলাম পরশুই। যা ওনাকে ভিতরে আসতে বল।”
আশ্চর্য ব্যাপার! কেউ শুনতেই পাচ্ছে না তহমিনা বেগমের কথা।  পাগল হয়ে গেল নাকি সবাই? গত রাতে বাথরুম থেকে ফেরার পর তহমিনা বেগম স্বামীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে গিয়েছিলেন। কত কয়েক বছর ধরে মাঝ রাতে এসে স্বামীকে নেড়ে দেখেন। কফ জমে কয়েকবার নিউমোনিয়া বাধিয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছিল খায়রুল সাহেবের। তখন থেকেই মাঝ রাতে তাঁকে নেড়ে চেড়ে দেখেন ঠিক মত শ্বাস নিতে পারছেন নাকি। সে রাতেও  স্বামীর হাত ধরে নেড়ে দিচ্ছিলেন। আগের সারা দিন অসুস্থ ছিলেন কিনা, ইদানীং প্রায়ই ঠান্ডা লাগে তাঁর। তহমিনা বেগম হাত ঝাঁকি দিয়ে অনুভব করলেন হাতটা যেন অসম্ভব শীতল। একটু অবাক হয়ে ডাকতে লাগলেন সেই মাঝ রাতে, “এই, উঠো? কি হইছে? খারাপ লাগতেছে?”
খায়রুল সাহেব বোধ হয় তহমিনা বেগমের ডাকটা তখন শুনতে পাননি। পেলে গত বাহান্ন বছরের প্রত্যেকটা রাতের মত জেগে উঠতেন। পাতলা ঘুম ওনার, আজ যে কোথা থেকে এত ঘুম চাপল ওনার- ভেবে পাচ্ছেন না তহমিনা বেগম।

ডি.এম. খায়রুল আনামের মোটামুটি বিশাল পরিবার। তাঁর বড় তিন ছেলে এবং ছয় মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে সেই পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেই। সবার স্বামী সংসার আছে। তিন ছেলের মাঝে ছোট ছেলের সাথে থাকেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। ছোট ছেলের নাম মুকূল। মুকূলেরও বিরাট সংসার। বাকি দুই ছেলে থাকে বীরগঞ্জ আর ঢাকায়। ঢাকায় থাকে বড় ছেলে। বাবা মারা গেছে শুনে দেখতে আসছে সে। বাসে এখনো, আসতে আসতে বিকেল গড়াবে। বাবার মুখ শেষ বারের মত দেখবে তাই জানাযা আর দাফনের পর্বটা মাগরীবের পর করা হবে। এখনো অনেকের আসা বাকি।
পঞ্চগড় বি.জি.বি. ব্যারাকের সামনের খোলা পাড়া নামের ছোট্ট এই গ্রামে আজ হাজারো মানুষের ভিড়। একটা মানুষের জন্য ঝিমিয়ে থাকা এ গ্রামে আজ এতটা প্রাণ চাঞ্চল্য। মাঝ বয়সী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যায়ের মানুষগুলো হাল্কা রঙের কাপড় পরে দেখতে এসেছে শেষ বারের মত মাষ্টার সাহেবকে। কম বয়সী ছেলে মেয়েরা কিছুটা রন-চঙ্গের পোশাক পরে এসে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মোবাইলে নিজেদের ছবি তুলছে। 
লোকজনের ভিড়ের কারণে খাঁটিয়া এখন বাড়ির বারান্দায় তুলে আনা হয়েছে। একটা স্ট্যান্ড লাগানো ফ্যান দিয়ে বাতাস দেয়া হচ্ছে লাশের ওপর। এত শীতের মাঝে ফ্যান কেন লাগিয়েছে বোঝা গেল না। পাশে মাদুর বিছিয়ে লাশের মাথার কাছে একটা মেয়ে কোরআন তেলাওয়াত করে যাচ্ছে সেই সকাল থেকে। ক্লান্তিহীন কোরআন তেলাওয়াতের একয়াত সুরে হাজী বাড়ির বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। যেন জানান দিচ্ছে কারো চির বিদায়ের।
মেজ ছেলে তহমিদার ইসলাম এসে বাবার মুখখানা একবার দেখে গেলেন। আজ কাঁদার সময় নেই ছেলেদের। হাতে কত কাজ বাকি। বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে দেড় কিলোমিটার খানেক দূরে খাপোগড়ি গোরস্থান। একপাশে ডি.এম. পরিবারের পারিবারিক গোরস্থান আলাদা করা। বিরাট বট গাছের একপাশে খায়রুল সাহেবের চির নিদ্রার শায়ন কক্ষ তৈরি করা হচ্ছে। মেজ ছেলে সেখানে গিয়ে কাজে হাত লাগালেন। আরো কয়েকজন কাঁচা বাঁশ কেটে “হেরাং” বানিয়ে কবরের মুখ বন্ধ করার আয়োজন করছে। কেউ কেউ বেড়া বানাচ্ছে। আবার কেউ জেনারেটর দিয়ে রাতে দাফনের সময় আলোর ব্যবস্থা পাঁকা করছে।
আজ মহররম। শুক্রবার। একটু পরেই জুমার আযান দিবে। মাষ্টার সাহেব ভাল দিন দেখে বিদায় নিয়েছেন- কবর খুঁড়তে খুড়তে লোকজন বলা বলি করছে।
বাড়িতে যারা দূর থেকে এসেছে, তাদের খিদে পেলেও বলতে পারছে না। তাই আশে পাশের বাড়িগুলো থেকে লোকজন এসে তাদের একরকম জোর করে নিয়ে যাচ্ছে, খেতে দিচ্ছে। এখানের নিয়ম অন্য রকম। লাশ বাড়ি থেকে বের হলে সাথে সাথে চুলা ধরাতে হয়, নয়তো পরের তিন দিন চুলা জ্বলবে না। তাই অন্তত সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত এবাড়িতে খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
দুপুরে জুমার সময় দেখা গেল খোলা পাড়ার ছোট মসজিদের উঠান পর্যন্ত উপচে পড়া মানুষের ভিড়।মাষ্টার সাহেবের মৃত্যুতে সবার যেন পরকাল বিষয়ক টনক নড়েছে। জীবনেও মসজিদ মুখো হন না- এমন মানুষও আজ এসেছে।
খায়রুল মাষ্টারের চাচাতো ভাই রশীদ সাহেব গম্ভীর মুখে জামাইদের সাথে কথা বলছেন মসজিদের এক কোনায় নিচু স্বরে।
“চাচা, আপনার আব্বা এলেন না আজ?” বড় জামাইয়ের প্রশ্ন।
“আর আসা! খোলাপাড়ায় আজরাইল ঢুকছে এই ভয়ে আজকেই চলে যাবে। খালি দাফনটা হোক।” রশীদ সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন। রশীদ সাহেবের বাবা হাফিজ মেম্বার এই গোটা পরিবারের বেঁচে থাকা সব চেয়ে বড় এবং বয়স্ক মানুষ। একশোর ওপর বয়স তাঁর। তাঁর চাচাতো বড় ভাইয়ের ছেলে খায়রুল আনাম মাষ্টার। ভাতিজার মৃত্যুতে ভয় পেয়েছেন তিনি। সকালে উঠেই এলাকা ছাড়ার তোড় জোড় শুরু করে দিয়েছিলেন। সবাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে থামিয়েছেন তাঁকে। দাফন হোক- তারপর যাওয়া যাবে। এখনো মসজিদে আসেন নি দেখে জামাইরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। একটু পর অবশ্য এলেন। বয়সের ভারে নুয়ে পরেছেন। লাঠিতে ভর করে চলতে হয়। নাত জামাইদের দেখে বলে উঠলেন, “চইলা যামুরে, চইলা যামু। খোলাপাড়ায় আজরাইল ঢুকছে। যামু গা। নাইলে আমারেও খাইবো!”
কেউ প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলল না। রাগী স্বভাবের এই বুড়োর সাথে কথা বলতে যাওয়া মানে কথার ডাল পালা গজানো। দরকার কি?

জুমার পরে দিনটা যেন খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল। সব ছেলেরা এসে গেছে। মাগরীবের নামাযের পর রীতিমত কান্নার রোল পরে গেল হাজী বাড়ি সহ খোলাপাড়া গ্রামে। লাশ বাড়ি থেকে বের করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে মানুষের ভিড় আর ছয় মেয়ের গগণ বিদারী বুকফাটা আর্তনাদে। চুলা জ্বলছে এখন।

লাশটা স্কুল মাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওখানে জানাযা পড়ানো হবে।

তহমিনা বেগম ধীর পায়ে হেটে বারান্দায় এসে বেঞ্চে বসলেন। ক্লান্ত লাগছে খুব তাঁকে। কারেন্ট চলে গেল।সবাই এদিক ওদিক ছোটা ছুটি শুরু করেছে আলোর জন্য। মরা বাড়িতে আলো থাকতে হয় চল্লিশদিন। লাশের যাওয়ার সাথে সাথে আলো চলে গেলে অমঙ্গল। এমনিতেই খায়রুল সাহেব মারা গেছেন হাতের মুঠো বন্ধ করে। হাতের মুঠো বন্ধ করে মারা গেলে নাকি বাড়ির সব রিযিক-বরকত চলে যায় মৃতের সাথে সাথে।
আলোর জন্য ছুটতে থাকা মানুষগুলোর তহমিনা বেগমের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই।
তিনি চোখ পিটপিট করে চারিদিকে তাকাচ্ছেন। দূরে কুয়াশার মাঝদিয়ে কুয়া পাড়টা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো আম গাছের পাতা দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে কুয়াপাড়টা ভিজিয়ে দিচ্ছে যেন......
তহমিনা বেগমের ঠিক মনে পরছে না- কাকে সর্ব প্রথম এই কুয়াটায় গোসল করতে দেখেছিলেন? তাঁর স্বামী? নাকি হাজী খামিরুদ্দিন সাহেব, তাঁর শ্বশুড়? কেউ কি ডুবে মরেছিল এখানে? কৈ? মনে তো পরছে না....... তাহলে কেন লাগছে কেউ ডুবে মরেছিল এই কুয়াতে? নাহ! এ কুয়া না। এটা তো মুকূলের জন্মের সময় খোঁড়া হয়েছিল। অন্য কোনো কুয়াতে হবে। কিন্তু ঐ কুয়াটা কোথায়? বন্ধ করে দিয়েছে নাকি কেউ?
তহমিনা বেগম কাঁপা হাতে নাকে হাত দিলেন, দীর্ঘ বায়ান্নটা বছর একটা নাঁক ফুলে কাটিয়েছিলেন, সেটা আজ খুলে নিয়েছে বৌমা’রা। কেমন যেন খালি খালি লাগছে।
তহমিনা বেগমের স্মৃতি বিস্মরণ হচ্ছে। সঙ্গে দৃষ্টি বিভ্রম। লাগছে উঠানটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশের পাকা বাড়ি গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে, উঠানের চারপাশ ঘিরে মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠছে আকাশ ছোঁয়া কাঁঠাল গাছ, আম গাছ...... কুয়াপাড়টার পাশে গজিয়ে উঠেছে বিরাট এক নারকেল গাছ..... তিনি অর্ধেক পাঁকা, আর টিনের দেয়াল দেয়া টিন সেডের একটা বাড়ির বারান্দায় বসে আছন...... সীমানাটা বাঁশের উঁচু চাটাইয়ের বেড়ায় ঘেরা....
তহমিনা বেগম ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি শুনলেন। চমকে উঠলেন, আপনা আপনি মাথায় ঘোমটা’টা ভাল করে টেনে নিলেন......তাঁর শ্বশুড় হাজী খামিরুদ্দিন সাহবে তাঁর ঘোড়ায় চেপে হাট থেকে ফিরল বোধ হয়! অবাক হয়ে দেখলেন বাড়ির তিন দিক থেকে দরজা, রান্নাঘর আর গোয়াল ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন তাঁর তিন শ্বাশুড়ি আম্মা..... হাজী সাহেব গেট দিয়ে ঢুকবেন, অথচ আলো যে কোথায়! রাগ লাগছে তহমিনা বেগমের। উঠে দাঁড়ালেন, নিজেই আলো আনতে রওয়ানা হলেন। শ্বশুড় আব্বা এসে সব অন্ধকার পেলে বাড়িঘর মাথায় করে ফেলবেন। ওনার রাগ ভয়ংকর রাগ।
হারিকেনটা যে কোথায় রেখেছে তাজলের মা। হাতড়ে বেরাচ্ছেন তহমিনা বেগম। একবারও মনে পরছে না তাজলের মা বলে কেউ নেই এখন আর। পঞ্চাশ বছর আগেই মারা গেছেন। কাঁপা স্বরে ডেকে যাচ্ছেন, “তাজলের মা, তাজলের মা? হারিকেনটা কোথায় রাখলা? আব্বা আসছে তো!”

(চলবে)


- লেখকঃ মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

No comments:

Post a Comment