Subscribe:

সব অপেক্ষা শেষ হয় না

সন্ধ্যার ঠিক পরপর খুব অদ্ভুত একটা সময়।একই সাথে রহস্যময় এবং সুন্দর।সিগারেট ধরানোর জন্য এটা জহিরের প্রিয় সময়।নিলা আসবে একটু পর। পৃথিবীর অধিকাংশ মেয়ের মত নিলাও সিগারেট খাওয়া অপছন্দ করে।জহির ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।মেয়েমানুষ আজব এক সৃষ্টি।পৃথিবীর সত্যিকার ভালো জিনিসগুলার কদর বুঝল না।কম বুদ্ধির জীব একদমই।পুরুষমানুষের জীবনটা একদম ত্যানা ত্যানা করে দিল।


গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়ার রহস্য জহিরের কাছে এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার।নিলা নামের এই যন্ত্রণাদায়িনী মেয়েটি জীবনে আসার পর থেকে জহিরের শনির দশা চলছে।রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে জীবনটাতো তার ভালই চলছিল।চায়ের দোকানে বসে অকারণেই তুমুল হট্টগোল করা,রাস্তা দিয়ে কোন মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখলেই বিকট শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে গান গাওয়া...

মেয়েগুলার চোখ মুখ তখন দেখার মত হয়!তারা মাটির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বেগে হেঁটে যায়,আর চায়ের দোকানে বসা যুবকের দল নির্মল আনন্দে সমস্বরে হেসে ওঠে।একদিন একটা মেয়ে গান শুনে সরাসরি দোকানের দিকে এগিয়ে এল।জহিরকে বলল, "গান গাচ্ছেন ভাল কথা।গলা খারাপ হলেই যে গান গাওয়া যাবেনা এমন কোন নিয়ম নেই।কিন্তু দয়া করে ভুসভুস করে সিগারেট টানবেন না।রাস্তা পর্যন্ত ধোঁয়া চলে আসে।সিগারেট গাঁজা যা খুশি খান,কিন্তু নিজের বাসায় গিয়ে।"

এই কথা বলেই সেই মেয়ে জহিরকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে গেল।
                                              তার চারদিন পরের কথা।চায়ের দোকানের যুবকেরা চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে।আজকে সেই বেয়াদব মেয়েকে শিক্ষা দেয়া হবে।তার মুখের উপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দেয়া হবে।তারপর বলা হবে,"লে হালুয়া।"।এই শব্দের মানে জহির জানেনা।পরিকল্পনাকারী বল্টুর অতি প্রিয় শব্দ এটা।যেহেতু মেয়েটি জহিরের সাথে কথা বলেছে,তাই তাকে শিক্ষা দেয়ার দায়িত্বটাও জহিরের উপর পড়েছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা বেণী দুলিয়ে হেঁটে আসতে লাগলো।জহির কিছু বোঝার আগেই সবাই মিলে তাকে ঠেলে ঠুলে রাস্তার মাঝখানে পাঠিয়ে দিল।জহির মেয়েটার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে রইল।মেয়েটা গলায় একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,"রাস্তার মাঝখানে পিলারের মত দাঁড়িয়ে আছেন কি কারণে?"
চায়ের দোকানে বসা যুবকের দল গভীর বিস্ময়ে লক্ষ্য করল জহির বলছে,"গত চার দিন রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি।"
"আপনি ঘুমাতে পারেননি তো আমি কি করব!আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয় আমার ঘুমের ওষুধের দোকান আছে?"
জহির কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে বলল,"আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?"
                                            এরপরের কাহিনী না জানলেও চলবে।এখনকার নির্মম সত্য হল সেই মেয়ে আনন্দের সাথে জহিরের জীবন প্রতিনিয়ত ভাজাভাজা করে যাচ্ছে।জহিরের সব কিছুই সে মশা মারার মত ভঙ্গিতে ফালতু বলে উড়িয়ে দেয় এবং সবশেষে বলে,"ছাগলের সাথে তোমার একমাত্র পার্থক্য হল ছাগলের চারটা পা,আর তোমার দুইটা।আল্লাহ্‌ মনে
হয় তোমাকে খুব তাড়াহুড়া করে বানিয়েছে,তাই বাকি দুইটা পা দিতে ভুলে গেছে।"
                                               জহির জানে,তার আজকের কথা শুনেও নিলা একই কথা বলবে।।নিলা এসে বলল, "অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছ?বাবা বাসায় ছিল,বের হতে পারছিলাম না।"
জহির মাটির দিকে তাকিয়ে বলল," তোমার জন্য অপেক্ষা করতে আমার খারাপ লাগেনা।"
সে এখনও নিলার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠিক মত কথা বলতে পারেনা।বুক ধড়ফড় করে।
"খুব জরুরী একটা কথা ছিল। আমি কিছু দিনের জন্য গ্রামের বাইরে যাচ্ছি।কবে ফিরব বলতে পারছি না।"
"কোথায় যাচ্ছ?"
জহির উত্তর না দিয়ে আঙুলের নখ কামরাতে লাগলো।এই ভঙ্গির অর্থ নিলা জানে।এর মানে হল সে এই প্রশ্নের উত্তর দেবেনা।
নিলা জহিরের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,"আমার উচিৎ একটা থাপ্পড় মেরে তোমার মাথা থেকে এসব আজাইরা চিন্তা দূর করা। কিন্তু কাজটা করতে বিবেক সায় দিচ্ছে না।আমি বুঝতে পারছি তুমি কোথায় যাচ্ছ।"
জহির এবার নিলার দিকে তাকাল।গভীর বিষাদে ওর গোলগাল মুখটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেছে।
"গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সাথে নিও মনে করে।আর ঠাণ্ডা লাগিও না।"
"তুমিও সাবধানে থেকো।"
নিলা এবার অপ্রকৃতস্থের মত হেসে বলল,"যার বাবা রাজাকার,তার সাবধানে থাকার প্রয়োজন হয়না।"
জহির চুপ করে রইল।নিলা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরপর ওর শরীর কেঁপে উঠছে।টপটপ করে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে। এই দৃশ্য সে জহিরকে দেখতে দিতে চায়না।ভালবাসার অশ্রু মানুষকে দুর্বল করে দেয়।জহিরের এখন সাহসের দরকার,দুর্বলতার নয়। দুজনেই নিজের চোখের জল নিয়ে বিব্রত,আরেকজন কে সান্ত্বনা দেবে কিভাবে?
বহুক্ষণ পর জহির বলল,"এই কথাটা যতবার তোমাকে বলি, তোমার ন্যাকামি মনে হয়।কিন্তু আজকে তবুও আরেকবার বলি।পূর্বজন্ম বলতে যদি সত্যিই কিছু থাকে,আমি নিশ্চয়ই সেখানে বড় ধরণের কোন পুণ্য করেছিলাম।তার প্রতিদানে এই জন্মে তোমার মত একটি মেয়েকে পাশে পেয়েছি।"
নিলা শুন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,"তুমি যে ছাগলের ছাগল,ভয় পেয়ে আবার মাঝপথে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে এসো না। যতদিনই লাগুক, যুদ্ধ শেষ না করে ফিরবে না।এতদিন তো তুমি অনেক অপেক্ষা করেছো আমার জন্য।আজ থেকে আমি অপেক্ষা করব। তুমি না ফেরা পর্যন্ত।"
                  

                                        * * * * * * *       * * * * * * *           * * * * * *
 

রশিদ পাটোয়ারী চেয়ারের উপর পা তুলে বসে আছেন।রহমত তার গা টিপে দিচ্ছে।আরামে তার চোখ বুজে আসছে।নতুন আলু দিয়ে মুরগীর মাংস কষানো হচ্ছে।সাথে চিকন চালের ভাত।গন্ধেই লোভ লাগছে তার।এই বাড়ীর মালিক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হাসান সাহেব।দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কিছুক্ষণ আগে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।অপরাধ অমার্জনীয়-একমাত্র ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে।দুই দিনের চেংড়া পোলাপান গুলা ভাবে কি?এইসব মুক্তি ফুক্তি করে পবিত্র পাকিস্তানের ক্ষতি করতে পারবে নাকি!নিজের বাড়ীই তো বাঁচাতে পারল না,দেশ বাঁচাবে কি করে?গণিমতের মাল হিসেবে এই বাড়ী এখন রশিদ পাটোয়ারীর।তিনি তৃপ্তি নিয়ে একটা পান মুখে দিলেন।
                     অদূরেই এক অসহায় রমণী আকুল হয়ে কাঁদছেন।মাত্র সতেরো বছর বয়সে জরির পাড় দেয়া একটা লাল শাড়ি পড়ে আলতা পায়ে এই বাড়ীতে পা রেখেছিলেন তিনি।এক নিমেষে তার ঘরটা কি করে গনিমতের মাল হয়ে গেল এই হিসাবটা তার সহজ সরল সংসারী মাথায় ঢুকছে না।তার চেয়েও বড় কথা,তার ছেলে যখন ফিরে আসবে,তাদের না পেয়ে খুঁজবে কই?
                   কিছু পোটলা নিয়ে তার পাশে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বামী -জহিরের বাবা হাসান সাহেব। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন না।এই মুহূর্তে একটা বিষয় নিয়ে তিনি অতি বিরক্ত।উঠানের কোণে কয়েকদিন আগে জাপানি টমেটোর চারা লাগিয়েছেন।
রান্নার আগুনটা ঠিক ওখানেই জ্বালানো হয়েছে।সবুজ চারাগুলো পুড়ে পুড়ে ফ্যাকাসে কালো হয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ করে তীব্র বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে গেল।
 

                                * * * * * * *        * * * * * *             * * * * * *

                                   নুরুল হুদা জহিরদের গ্রুপের কমান্ডর।প্রথমে কিছুদিন ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চি ধরে প্র্যাকটিস করানো হয়েছে ওদের,তারপর থ্রি নট থ্রি পিস্তল।এলএমজি নামক অদ্ভুত অস্ত্রটার প্রতি জহিরের প্রবল আকর্ষণ জন্মেছে।অপারেশনে গিয়ে যখন সে এলএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে,অদ্ভুত শান্তি অনুভব করে।আর মনে মনে বলে,"ছাগল এখন মানুষ হয়েছে নিলা।"
অনেকদিন হল সাবান দিয়ে গোসল করা হয়না।কাঁদা মাটিতে ট্রেনিং করে জুতো জোড়ার বেহাল অবস্থা।আগে একবেলা খেয়ে থাকতে কষ্ট হত খুব,এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।সব কিছু মানিয়ে নিতে পারলেও একটা জিনিস মানিয়ে নিতে পারেনা জহির। মাঝে মাঝে তীব্র ইচ্ছা করে যুদ্ধ ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে নিলার কাছে চলে যায়।কিন্তু গ্রুপের অন্য মানুষগুলোকে দেখলে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে যায় আবার।এই যে ওসমান ভাই,বউ আর দুটা বাচ্চা কে ফেলে যুদ্ধে এসেছেন।অই যে ফরহাদ,মাত্র দেড় মাস আগে বিয়ে করেছে।
মারুফ,ঘরে বৃদ্ধা মাকে একা ফেলে এসেছে।সবচে যেটা দেখলে তার নিজেকে একদম ভীরু কাপুরুষ মনে হয় সেটা হল অই ষোল বছরের জনি।প্রথমে নুরুল হুদা ভাই কিছুতেই রাজি হননি এইটুকুন ছেলেকে যুদ্ধে নিতে।কিন্তু জনি ফেভিকলের চেয়েও উত্তম আঠা।এই দল যেখানে যায়,পরীক্ষার প্রশ্নের লেজুড়ের মত জনিও সেখানে যায়।এদের দেখলে জহিরের মনে হয় এই মানুষগুলো সব কিছু ত্যাগ করে এখানে পড়ে আছে দেশের জন্য,আর সে কিনা যুদ্ধ ছেড়ে চলে যেতে চায়?!
                                            পাকিস্তানি আর্মির মেজর লতিফ বেগের জন্য আস্ত খাসির রোস্ট করা হয়েছে।রশিদ পাটোয়ারী ক্রমাগত দৌড়াদৌড়ি করছে।এত সম্মানিত অতিথিকে ঠিক কিভাবে আপ্যায়ন করলে যথেষ্ট হবে এটা বুঝতে না পারায় সে নিজের উপর অসামান্য বিরক্ত।অকারনেই স্ত্রী এবং কন্যাকে ধমক দিয়ে সে বিরক্তি প্রশমিত করার চেষ্টা করছে।একটু পর লতিফ বেগ তাকে ডাকলেন।
পাইপের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,"তুমনে হামারে লিয়ে জো খুবসুরাত বাঙ্গাল আওরাত কো ভেজা,হামে বহুত পসন্দ আয়া।"
রশিদ বিনয়ে গলে গিয়ে বলল,"স্যার,হাম আপকে খিদমাত কে লিয়ে অর ভি লাড়কি ভেজেঙ্গে।কোই প্রবলেম নেহি।"
লতিফ বেগ মাথা নাড়লেন।রশিদ অত্যন্ত করিৎকর্মা লোক।প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন মেয়ে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসে।তার উপর সন্তুষ্ট হয়েই তাই আজকে লতিফ বেগ তার বাসায় এসেছেন।যাওয়ার সময় বারান্দায় দাঁড়ানো একটি মেয়ের দিকে চোখ আটকে গেল লতিফের।বাঙালি মেয়েদের সৌন্দর্যে লতিফ বেগ বিমোহিত,কিন্তু এই মেয়ে তার চেয়েও কিছু বেশি।তিনি তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিলেন অতি রূপবতী এই মেয়েকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার।রশিদ কাতর অনুনয় করেও তার মেয়েকে রক্ষা করতে পারলেন না।তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তার
মেয়ে নিলাকে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হল।পরের দিন সারাদিন রশিদ ক্যাম্পে বসে রইলেন।পাক অফিসারদের কাছে কাঁদলেন, পা জড়িয়ে ধরলেন......কিন্তু মেয়েকে উদ্ধার করতে পারলেন না। ফিরে আসার সময় জান্তব কান্নার শব্দে একটা রুমের খোলা জানালায় চোখ আটকে গেল তার।স্পষ্ট গোঙানির শব্দ কানে আসছে।একটু এগিয়ে গেলেন তিনি।দূর থেকেই দেখলেন,রুমের ভেতর তার মেয়ে নিলা!
কিন্তু যে দৃশ্য দেখলেন,রাজাকার হলেও পৃথিবীর কোন বাবাকে তা সহ্য করার ক্ষমতা পরম করুণাময় দেননি। পরের দিন স্কুলের পুকুরে রশিদ পাটোয়ারীর লাশ পাওয়া গেল।

                                           * * * *         * * * * * *         * * * * *
মানুষ যখন বুঝতে পারে যে তার সামনে কোন পথ নেই,না বেঁচে থাকার না মরে যাওয়ার...তখন সে অনুভুতিশুন্য হয়ে যায়।নিলার অবস্থাও তেমন। ক্যাম্পের প্রতিটি মেয়ে কাঁদে,অবিরত কাঁদে।এখান থেকে ফিরে যাবার জন্য নয়,আল্লাহ যেন তাদের মৃত্যুর দিনটা একটু তাড়াতাড়ি আনেন সেই প্রার্থনায়। প্রতিদিন কিছু হায়েনা,কিছু মানুষের চেহারার জানোয়ার ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।সেই সময়টা দাঁতে দাঁত চেপে ওরা ভাবে,"এবার নিশ্চয় বিধাতার করুণা হবে।এই যাত্রায় নিশ্চয় তিনি উপরে ডেকে নেবেন।"

কিন্তু বিধাতা এই মহাজগতের অন্যান্য কাজে ভীষণ ব্যাস্ত।এই আকুতি তার কানে পৌঁছায় না।প্রতিদিন ওদের আত্মার মৃত্যু হয়।কিন্তু শরীরের মৃত্যু হয়না,আর তাই ওদের মুক্তিও হয়না। হিংস্র শকুনগুলো তৃপ্ত হয়ে যখন চলে যায়,নিলা নিথর দেহে এক সন্ধ্যার কথা মনে করে।একজন মানুষকে সে কথা দিয়েছিল,সে ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।নিলা অপেক্ষা করে......
                ১৯ নভেম্বর।জহিরদের ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা এক কলাম মুক্তিবাহিনী নিয়ে কালীগঞ্জ পৌঁছেছেন।২০ নভেম্বর ভোর পাঁচটায় হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করেন।হিঙ্গলগঞ্জ থেকে তাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দিচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৃতীয় রাজপুত।দুই ঘণ্টার এই যুদ্ধ শেষে ৪০ জন পাক সেনা বন্দি হল।

কালীগঞ্জ স্বাধীন হল।ক্যাম্প থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে মেয়েরা।অনেকেই হাঁটতে পারছে না।গায়ের ছেঁড়া কাপড় টেনে শরীর আড়াল করার নিরুপায় চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ে গেলেন।নিজেদের গায়ের চাদর,কেউবা গেঞ্জি খুলে ঢেকে দিতে চেষ্টা করলেন অসহায় বোনগুলোকে।জহির ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকল।ভেতরে কিছু মেয়ের নিথর শরীর পড়ে আছে।হঠাৎ ওর পুরো শরীর আতঙ্কে জমে গেল।
সে কি ভুল দেখছে!জহির এগিয়ে গেল।না, কোন ভুল নয়।এই সেই হাত,নানা মিথ্যে অজুহাতে জহির যেটা ছুঁয়ে দিতে চাইত।এই সেই মায়াবী মুখ।এই সেই নিলা, যাকে এক মুহূর্ত কাছে টেনে নেয়ার জন্য সে পুরো পৃথিবীকে দূরে ঠেলে দিতে পারত।
জহিরের মনে হল,যত কলঙ্ক এই শরীরের উপর দিয়ে যাক,এই মেয়েটির পবিত্রতায় তাতে কোন কালি লাগেনি।সে পরম মমতায় নিলার মাথাটা কোলের উপর টেনে নিল।ওর গালের উপর গালটা চেপে ধরল আস্তে করে।নিলার নিথর দেহে কোন স্পন্দন নেই।
জহির খুব নিচু গলায় বলল,"আমি কথা রেখেছি নিলা।যুদ্ধ শেষ করে তবেই ফিরেছি।কিন্তু তুমি কথা রাখনি।"
আকুল হয়ে কাঁদছে জহির...অদূরেই সহযোদ্ধাদের সম্মিলিত কণ্ঠ ভেসে উঠলো-
"আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি........."

-আয়শা কাশফী

No comments:

Post a Comment