Subscribe:

আঁধারে আলো

বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে । কাছে কোথাও মাঝে মাঝে বিকট শব্দে বাজ পড়ছে । কানা তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় রুদ্রের । এর মধ্যেও সে বসে আছে । বৃষ্টির ছাট্‌ তার পাঞ্জাবীটাকে অনেকখানি ভিজিয়ে দিয়েছে । ভালো লাগছে রুদ্রের । বৃষ্টিতে ভিজতে কখনোই খারাপ লাগে না তার । অথৈ এর বারণ স্বত্ত্বেও বর্ষার দিনগুলোতে অথৈ এর সাথে ছাদে প্রায়ই বৃষ্টিতে ভেজে সে । তার বৃষ্টিপ্রীতির কথা অথৈ ও জানে ।


আর ঘন্টা দেড়েক পরে রুদ্রের জন্মদিন । গত দুটো বছর ধরে এই দিনে অথৈ একই নিয়মে তাকে বারান্দায় বসিয়ে ডাইনিং রুমটা সাজায় । ঠিক ১২টায় দুজন মিলে এক সাথে কেক কেটে জন্মদিবসটির উৎযাপন শুরু হয় । তারপর একের পর এক রুদ্রের পছন্দের গানগুলো গেয়ে শোনায় অথৈ ।

আধ ঘন্টার মত হলো,রুদ্রকে বারান্দায় বসিয়ে রেখে বলে দিয়ে গেছে,সে যাতে বারান্দা থেকে ঘরের ভেতর না আসে ।

রুদ্র হেসে বলে,"আমি তো জানিই তুমি কি করবে । শুধু শুধু বারান্দায় বসিয়ে রাখার দরকার কি ? আমার জন্য ঘরের ভিতরে থাকা,বারান্দায় থাকা তো একই কথা । "
অথৈ রাগ করে । বলে,"এতো বেশি বোঝ কেন সবকিছু ? কি হয় একটু চুপ করে বসলে ? সবসময় তো বৃষ্টি বৃষ্টি করো...তোমার বর্ষাপ্রীতি একদিনেই হাপিশ ? "


অযথাই মেয়েটা এতো ঝামেলা করে । রুদ্রের কাছে এতো জাঁকজমক,এতো আয়োজনের কোন অর্থই নেই । কিন্তু,অথৈ নাছোড়বান্দা । সে এসব করবেই ।
কেনো সে বোঝে না এতো মায়া, এতো যত্ন রুদ্রকে বারবার মনে করিয়ে দেয়,অথৈ এর প্রতি তার অবহেলার কথা । সে তো পারেনি অথৈ কে এতো খুশি রাখতে । একটা মেয়ে কেনো এতটা নিঃস্বার্থ হয়ে ভালোবাসে ? কই,সে তো পারে না ।

রুদ্রকে খুশি করার কোন চেষ্টা ই সে বাদ রাখে না । কেউ বাধ সাধলে বরং সে আরো বেশি মন খারাপ করে । এই খুশিটুকু থেকে রুদ্র অথৈকে এখন আর বঞ্চিত করতে চায় না ।

অথৈ এর সাথে রুদ্রের পরিচয় হয় এস এস সি পরীক্ষার মাস খানিক আগে একটা কোচিং সেন্টারে । বাবা মার জোরাজুরিতে অনেকটা নিমরাজী হয়েই সেখানে ভর্তি হয়েছিলো রুদ্র । এমইতেই ভালো ছাত্র সে । কোথাও স্পেশাল  কোচিং এর কোন প্রয়োজন ছিলো না । তারপরও সেখানে ভর্তি হয়ে যায় ।

অনেকদিন ঘরে বন্দী থাকলে,বাইরের পৃথিবী দেখার ইচ্ছা একসময় এমনিতেই কমে যায় । রুদ্রর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা ই ছিলো । আর দশটা মানুষের থেকে সে আলদা,তার মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে,এই ব্যাপারটা জানাতে তার আপত্তি ছিলো । স্কুলের বাইরে তাই অন্য কোথাও যেতে তার খুব খারাপ লাগতো ।
কিন্তু, আর সব বাবা-মার মতো এই অস্বাভাবিকতা রুদ্রের বাবা-মা মেনে নিতে পারেনি । রুদ্রের মা বিশেষ করে ব্যাপারটা একদমই মেনে নেননি । তার ধারনা ছিলো,ছেলে ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে । তাই এক রকম জোর করেই রুদ্রের মা তাকে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দেন । মার মন রাখার জন্য সে ও আর তাই "না" করেনি । তাকে লক্ষ্য রাখার জন্য সবসময় কেউ না কেউ সাথে থাকার প্রয়োজন হত । সেই কাজটা তার মা ই করত বেশিরভাগ সময় । ছেলেকে হাসি খুশি রাখার সম্ভাব্য সব কোন চেষ্টাতেই তিনি ত্রুটি রাখেন নি ।

ক্লাসে অনেক স্টুডেন্ট । তার ভীড়ে রুদ্রকে সবার খুব চোখে পড়ত । ক্লাসের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে জানালার বাইরে থেকে ভেতর টা দেখা যেত । রুদ্রের মা সবসময় সেখানে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন । ব্যাপারটা একদিন দুদিন যেতে না যেতেই সবাই খেয়াল করলো ।
অথৈ এর ব্যাপারটা ছিলো উলটো । খেয়াল করার মত তেমন কোন বিশেষত্ব ছিলো না তার । শ্যামলা মত,ছিপছিপে গড়নের একটা মেয়ে । ক্লাসে কোন পার্টিসিপেশন ছিলো না,কিছু না। কোণার দিকের একটা চেয়ারে বসে থাকত সবসময় । রুদ্র তাকে খেয়াল করে একটা বিশেষ কারণে ।

প্রণয় কান্তি স্যারের ক্লাসে অথৈ কি একটা প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলো কোন একদিন । সেদিন গলার স্বর শুনে তার দিকে প্রথম তাকায় রুদ্র । কিছুটা বিস্মিত হয়ে সেদিন সে লক্ষ্য করেছিলো মেয়েটার গলার স্বর অস্বাভাবিক রকমের মিষ্টি । স্যার ও রুদ্রের মতোই অবাক হয়েছিলেন । সেটা তার কথা শুনেই বুঝা গিয়েছিলো । স্যার বলেছিলেন,"তুমি কি গান শেখ,মা? "
অথৈ রিনিরিনে কন্ঠে বলল, "জ্বী,স্যার।"
স্যার আর কোন প্রশ্ন করেননি । শুধু বললেন,"ভালো,ভালো । খুব ভালো ।"

হঠাৎ অথৈ এর গলার আওয়াজে চেনা বারান্দাটায় ফিরে আসে রুদ্র । বারান্দায় এসে কাঁধে হাত রেখে বলে,"ইশ্‌,অনেকখানি ভিজে গেছো । চেয়ারটা একটু দূরে সরিয়ে বসলে কি হতো ? ভিজতে হবে না আর...চলো ।"
অথৈ এর পিছে পিছে ডাইনিং রুমে ঢুকলো রুদ্র । চেয়ারে বসার প্রায় সাথে সাথেই দেয়াল ঘড়িটা টিক্‌ করে ১২টা বাজার জানান দেয় । অথৈ কানে কানে ফিসফিস করে বলে,"হ্যাপি বার্থডে...আজকে পুরো দিনে যা চাইবে,তা ই পাবে । তাড়াতাড়ি চেয়ে ফেলো । এই সুযোগ পরে না ও পেতে পারো । " বলেই হাসে অথৈ ।
 রুদ্র অথৈ কে সামনে এনে দুহাত ধরে অসহায়ের মত বলে উঠে,"আজ তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে ।"

বলতে বলতেই কেমন ছটফট করে উঠে রুদ্র । কেনো অথৈ এতো ভালোবাসে রুদ্রকে,সে বুঝে উঠতে পারে না ।
খুব অল্প সময়ের ব্যাবধানে দুজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে । অথৈ এর কাছে সম্পর্ক টা একসময় বন্ধুত্ব থেকেও বেশি কিছুতে পরিণত হয় । কিন্তু,রুদ্রের স্বপ্নে যে মেয়েটি রয়ে সয়ে উঁকি দিতো,সে কখনোই অথৈ ছিলো না । ভার্সিটির দিনগুলোতে অনি নামের একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগতো তার । মেয়েটিকে তার ভালো লাগার কথা জানাতেই ,অনি হেসে ফেলে । সে হাসিতে বিদ্রুপ ছিলো । যা জানিয়ে দিয়েছিলো, রুদ্রের কাউকে ভালোবাসতে বারণ আছে ।
ছোট বেলাতেই বেশ মোটা চশমা লেগে গিয়েছিলো রুদ্রের চোখে । পড়ালেখার নেশা,সে অবস্থার আরো অবনতি ঘটাতে থাকে । দেশের-বিদেশের সম্ভাব্য সব চিকিৎসা তার বাবা-মা তাকে করিয়েছেন । ডাক্তারদের একটাই কথা ছিলো,যে হারে রুদ্রের দৃষ্টি শক্তির অবনতি ঘটছে,এমন দিন আসতে খুব একটা দেরী নেই যেদিন রুদ্র কিছুই দেখতে পাবে না । এতো কিছুর পরেও রুদ্র থেমে থাকেনি । যতদিন চোখে আলো ছিলো,পড়ালেখা চালিয়ে গেছে সে ।
রুদ্র অন্ধ হয়ে যাবে,এই সত্যি মেনে নেয়ার ক্ষমতা রুদ্র বা অথৈ এর মা-বাবার কারও ছিলো না । অথচ,অথৈ এতো সহজ ভাবে মেনে নিয়ে ঘর সংসার করে যাচ্ছে,ভাবলে অবাক লাগে । তার বাবা-মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রুদ্রকে বিয়ে করে অথৈ । কেউ তো চায় না,অন্ধ একটা ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে । কিন্তু,অথৈ এর জেদের কাছে শেষ-মেষ তার বাবা-মাও মেয়ের ইচ্ছায় আপত্তি জানাতে পেরে ওঠেন নি ।
রুদ্রের অন্ধত্ব নিয়ে অথৈ এর মনে কখনো কোন আক্ষেপের স্থান হয়নি । দিনের পর দিন,নিজেকে পুড়িয়ে রুদ্রকে হহাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে যাছে একমনে ।

আয় রোজগারের কথা ভাবা লাগে না রুদ্রের । বাবার অঢেল সম্পত্তি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো । অথৈ তারপরেও বসে নেই । শখের বসে বিনা বেতনের একটা স্কুলে পড়ায় সে ।

চোখের আলোয় কখনো অথৈ কে দেখতে চায়নি সে । যে সুন্দরের পিছনে মরীচিকার মত ছুটে গেছে,তার চেয়ে সহস্র গুণ সুন্দর তার জীবনকে আলোকিত করে রেখেছে । আজ সে আলো সে শুধু অনুভবই করতে পারে ।

রাত বাড়তে থাকে । জানালার পাশে বিছিয়ে রাখা মাদুরের উপর অথৈ এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে রুদ্র ।

অথৈ গুনগুন করে গাইছে,

"মোরা আর-জনমে হংসমিথুন ছিলাম,ছিলাম নদীর চরে।
যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে ...
তমালতরু চাঁপালতার মতো জড়িয়ে কত জনম হলো গত,
সেই বাঁধনের চিহ্ন আজো জাগে হিয়ায় থরে থরে ...



- অধিবৃত্ত

1 comment: