Subscribe:

আব্বাকে লেখা চিঠি

আব্বা কেমন আছো? সাড়ে সাত বছর পর প্রশ্নটা শুনে অবাক হচ্ছো? তুমিতো কোনদিনও বলতে না খারাপ আছি যেন আমরা টেনশান না করি। কিন্তু একবারও কি ভেবেছিলে তোমার এই সাময়িকভাবে লুকানো উত্তরগুলো একদিন আমার জীবনে স্থায়ীভাবে তোমাকে হারানোর বেদনার কারণ হবে!


আব্বা, আমার এখনও মনে আছে আমার যখন তিন বছর বয়স ছিল, আমাকে বাসায় রেখে যখন জুম্মায় চলে যেতে তখন বারান্দা থেকে তোমাকে হেঁটে যেতে দেখে আমার সে কী চিৎকার আর কান্না! তা দেখে তুমি আবার বাড়ি এসে আমায় নিয়ে যেতে।
ক্লাস টু তে থাকতে একবার ইংরেজী ডিকটেশান স্পেলিং-এ চল্লিশে চল্লিশ পেয়েছিলাম। আমার চেয়ে তুমি খুশি হয়েছিলে বেশি। কত জায়গায় নিয়ে গেলে! দোকান থেকে চকলেট, চিপস, স্যান্ডুইচ খেতে খেতে যখন হাঁফিয়ে উঠতাম তখনও তুমি বলতে, “আর কি খাবে আব্বা?” ঘুরাঘুরি করে যখন বাসায় ফিরতে রাত হত আমি তখন গাড়ির সামনের সিট কাত করে এসির বাতাস খেতে খেতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতাম। তুমি এক হাতে আমাকে আর আরেক হাতে অফিসের ফাইল, কাগজপত্র নিয়ে চার তলায় উঠতে। আমি বুঝতে পারতাম তুমি থরথর করে ঘেমে যাচ্ছ। আর আমারও জিদ কোল থেকে নামবো না।

তুমি খেতে খুব বেশি পছন্দ করতে। ডিম তোমার ভীষণ পছন্দ ছিল বলে তোমাকে ডিমা ডিমা বলে ডাকতাম। এমনকি বাসায় মেহমান থাকলেও ফোকলা দাঁত বের করে মুখে সরল হাসি নিয়ে বলতাম ডিমা এসেছে।
শর্ত সাপেক্ষে মাথা থেকে পাকা চুল তুলে দিতাম তোমার। কখনও তোমার বুকে-পিঠে বসে কখনও পাশে বসে। শর্ত ছিল পঞ্চাশটা পাকা চুল তুলে দিলে দশ টাকা দিতে হবে। তুমি দিতে বিশ টাকা। সেই টাকা পেয়ে আমি আনন্দে সারা বাড়ি দৌড়াতাম। আর আশে পাশে লোকদের বৃথা বুঝানোর চেষ্টা করতাম আমি ছোট হলে কি হবে ইনকাম আমারও কম না।

আমার যখন এগার বছর হল তুমি লোভ দেখালে সব রোজা রাখলে যা চাই তাই দেব। আমারতো তখন খুশিতে মাথা খারাপ। কাগজ পেন্সিল নিয়ে বিশাল লিস্ট করতে বসলাম। টেনিস বল, কর্ক, টেবিল টেনিস খেলার ব্যাট, কিটক্যাট এগুলো ছিল প্রথমে। সব মিলিয়ে হিসাবটা সাড়ে পাঁচশ টাকা হল যা আমার কাছে তখন লাখ টাকারও বেশি।

ভালইতো ছিল দিনগুলো। তারপর কি থেকে কি যেন হয়ে গেল। তুমি অনেক দূরে হারিয়ে যাবার আগের দুদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম তুমি আর আমাদের মাঝে থাকছো না। ভেবেছিলাম স্বপ্ন সত্যি হবে না। কিন্তু না। এত আগে তুমি না ফেরার দেশে চলে যাবে সত্যিই কোনদিন ভাবিনি। এও ভাবিনি এত অল্প সময়ে এত বেশি আদর পাব তোমার থেকে। এত বেশি সরল মনের মানুষ ছিলে তুমি, দুনিয়ার সব মানুষের উপকার করে বেড়াতে, কেউ কোন কিছু চাইলে না বলতে পারতে না, চোখ বন্ধ করে মানুষকে বিশ্বাস করতে আর কষ্টও পেতে বেশি। এত এত কাজের দায়িত্ব তুমি একাই কিভাবে যে এত সুন্দর করে ম্যানেজ করতে সত্যিই অবিশ্বাস্য। এও অবিশ্বাস্য যে ছেলে আহত কাউকে দেখলেই শিউরে উঠত সে ছেলেটা মধ্য কৈশরে তার বাবার লাশ বহন করার অভিজ্ঞতা অর্জন করল। আব্বা তুমি হয়ত দেখেছিলে আমি যখন তোমার কবরে নামি তখন আমার একদম উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কারণ বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল উঠে গেলে আর তো পাশে পাব না তোমাকে, কোনদিনও না। অনেক্ষণ তোমার পা ধরে ছিলাম সে সময়। কেউ বোধহয় খেয়াল করে নি । হয়ত সেভাবে কোনদিন মাফ চাওয়া হয়নি তোমার কাছে। তুমিতো আমাকে সুযোগই দিলে না মাফ চাওয়ার। যে ছেলের আবদারের শেষ ছিল না সে কি আর বুঝে মাফ চাওয়া কি জিনিস। আব্বা তুমি কেমন আছো? খুব জানতে ইচ্ছে করে, খুব। এখনতো আর লুকানোর কিছু নেই; তুমি যে আজ সব কিছুর উর্ধ্বে। 


FB ID: Rajeen Reasat
ব্লগার রাজিন

No comments:

Post a Comment