Subscribe:

অবেলার কান্না

যতটুকু বয়সে একজন শিশু কিছুটা গুছিয়ে কথা  বলতে শেখে , যখন তখন যার  তার কোলে উঠে পড়ার অধিকার হারায় কিংবা যে বয়সে তারা বড় হওয়ার সুখ স্বপ্ন দেখতে  শুরু করে , আমি তখন ততটুকুই  । চার কি পাঁচ বছরের মতো বয়স । তখনকার জীবনের ভাঙা ভাঙা কিছু ছবি এখনও আমার চোখে ভাসে । তখন আমরা থাকতাম আমাদের মোহাম্মদপুরের বাসাটায় ।  আমার শরীরে তখন একটি একটি করে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে বড় হয়ে,বড় মানুষ হওয়ার বীজ , “অ”, “আ”, “ক”, “খ”।


স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট হব । রাস্তায় শুধু লাল সবুজ নয় , কমলা ,বেগুনী আকাশী বাতিও জ্বলবে ।  ত্রিভুবনে আমার শত্রু বলতে একজনই ছিল, চাচাতো বোন মালিহা । তখনও পুরুষ বলতে যা বোঝায় তা হয়ে উঠিনি, তাই ওর গায়ে হাত তোলাটাকে কাপুরুষতা বলে মনে হয়নি কোনদিন । প্রতিদিন বিকেলে ইশা আপুদের বাসার ছাদের দোলনায় চড়া ছিল আমার সারাদিনের বিশেষ প্রতীক্ষার একটা কাজ ।

শ্যামা, ইশা , ফাহাম । ওরা দুই বোন এক ভাই। শ্যামা আপু ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট, এলাকার সেরা ছাত্রী (পরে জেনেছি ) । মেঝো বোন ইশা আপু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রী । এই দুই আপুর আদরের আতিশয্যে আমি তখন ওদের সাথে নরকে যেতেও এক পায়ে খাড়া । পৃথিবীতে ওরা ছাড়া কেউ আমাকে কোলে নেয় না, গালে চুমু খায় না । কলেজ জীবনেও এক বন্ধুকে দেখেছি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের কাছ থেকে হাত খরচ নিলো  , এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে ওর মা ওর কপালে একটা চুমুও দিলো। এই না হলে ভালোবাসা । চুমু ছাড়া কি কখনও ভালোবাসা যায়? আমি অভাগা ওই ছোট্ট বয়সেও বাসা থেকে এই ধরনের আদর সোহাগে অভ্যস্ত ছিলাম না । তাই বিকালবেলা ইশা আর শ্যামা আপুদের দেয়া গালের চুমু ছিল আমার কাছে একপ্রকার নিষিদ্ধ আকর্ষণ , কলেজ জীবনে সিগারেটে টান দেয়ার মতো । যে ভালোবাসা পৃথিবীর আর কথাও পাইনি সেটা পেয়ে তখন আমার শ্যামলা মুখও লাল হয়ে উঠতো ।

জানিনা কী কারণে, ইশা আপুদের ভার্সিটিতে একদিন আমার দাওয়াত পড়লো । ঐদিন ওদের ক্লাস এর প্রত্যেকে একজন করে আমার মতো চকলেট লোভীকে হাজির করলো । ওদের হলরুম তখন আমার মতো হাই অ্যামপ্লিচিউড সাউন্ড জেনারেটর এ ভরতি । সারাদিন থাকলাম , ছবি আঁকলাম, গল্প বললাম, ওদের টিচারদের সাথে গল্প করলাম।

সবাই-ই যে দিনটা আমার মতো আনন্দে কাটিয়েছিল তা নয় । কারও কারও কান্নার শব্দে ধরণী দ্বিধা হও অবস্থাও হয়েছিল। তবে সব মিলিয়ে আমি একটা রঙিন দিন কাটিয়েছিলাম । শেষ বিকালে যখন সমগ্র পৃথিবীটা লাল তখন পকেট ভরতি চকলেট আর মুখ ভরতি হাসি নিয়ে রওয়ানা দিলাম। এখনও স্পষ্ট মনে আছে ,আমি আর ইশা আপু গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছি , আমার চোখের পাতা ভারী । ছোট শরীরে সারাদিনের ধকল সহ্য করতে না পেরে আমি গা এলিয়ে দিলাম , মাথা রাখলাম ইশা আপুর কোলে । মথায় ইশা আপু বিলি কেটে দিচ্ছে , এক আকাশ ভালোলাগা ছরিয়ে পরছে আমার সারাটা শরীরে । ঘুম সাগরে ডুব দেয়ার ঠিক আগে আগেই নিয়ে ফেললাম জীবনের এক অনিবার্য সিদ্ধান্ত , বড় হয়ে আমি ইশা আপুকেই বিয়ে করব , অবশ্যই করব ।  

মুহূর্ত মুহূর্ত  করে মাঝে প্রায় আট দশ বছর  কেটে গ্যাছে , গঙ্গার পানি আরও  কালো হয়েছে , সমুদ্রের বুকের  ঢেউ গুলোকে অগ্রাহ্য করে  মেতে উঠতে পারিনা কোন শৈশবের খেলায় , অপলক চেয়ে থাকি । এই মুখ কোন নিষ্পাপ চুমু খাবার বয়স হারিয়েছে অনেক আগেই । শ্যামা আপু , ইশা আপুরাও আমাদের পাশের বাসায় থাকেনা । শুনেছিলাম রামপুরায় ফ্ল্যাট কিনেছে । কোন যোগাযোগ ছিলনা ওদের সাথে ।  কখনোই ওদের কথা আমার মনে পড়ে না ।

 নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হতে শিখে গেছি আমি, আর এই ঘোড়দৌড়ের ময়দানে শৈশবের সারল্যগুলোকে বোকামি ছাড়া আর কিছু মনে হয়না আমার । কোন একদিন সকালে আমাদের বাসায় একটা দুঃসংবাদ আসে । এ ধরনের দুঃসংবাদে সামান্য উত্তেজনা ছাড়া আমার আর কিছুই হয়না । চোখের জলের নোনা স্বাদ আমার জিভ ভুলতে বসেছে, কঠিন আমার হৃদয়,শুষ্ক আমার চোখ , ধীরে ধীরে যেন পুরুষ হয়ে যাচ্ছি । তবে দুঃসংবাদটি শুনে ধাক্কার মতো খেলাম । ইশা আপু নাকি মারা গেছে ।

এটা কি হতে পারে? নিশ্চয়ই কথাও কোন ভুল হচ্ছে । ঐ শরীরে মৃত্যু আসতে দ্বিধা করবে । কিন্তু মৃত্যু নিষ্ঠুর , মৃত্যু পুরুষ । হ্যা, ইশা আপু আর বেচে নেই , ইশা আপু মারা গেছে ,ইশা আপু ছাদ থেকে পরে মারা গেছে । বাসার সবার সীমাহীন আফসোস এর সাথে আমার অনুভূতিগুলো ঠিক গলা মেলাতে পারছিলনা সেদিন । আমার নির্বাক অনুভূতিগুলো বুক আর কণ্ঠের মাঝামাঝি কোন একটা জায়গায় আটকে ছিল , জান্তব দমকে কান্না হয়ে বের হতে চাচ্ছিল ।  প্রায় অপরিচিত একজনের জন্য এই বয়সে কোন ছেলে কি কাঁদতে পারে ? অনেক চেষ্টা করেছি কান্নাটাকে আটকাতে । পারিনি । সেদিন কেঁদেছিলাম । অনেক দূরের কারও জন্যই কেঁদেছিলাম । দুঃখে আর লজ্জায় সেদিনও আমার শ্যামলা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল ।



-হাফিজ আল রিয়াসাত

No comments:

Post a Comment