Subscribe:

মুক্তিযুদ্ধের পরে...

প্রায় ২ বছর  পর দেশে এসে পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করছি। আমার এক বন্ধু  জয় । অনেকের সাথেই দেখি ওর যোগাযোগ নাই ।

তাই অনেক খোজ খবর নিয়ে ওর ঠিকানায় গিয়ে হাজির হলাম। সাধারন কথাবার্তাই হল ।ওর কোন উচ্ছলতা দেখলাম না । অথচ ওই ছিল আমাদের সবার মধ্যে উচ্ছল ।ওকে জিজ্ঞেস করি,"কিরে রাইসার কি অবস্থা ?"


আমি বিদেশ যাওয়ার কিছুদিন আগেই ওদের সম্পর্কের শুরু ।এরপর আর তেমন কিছু জানিনা ।

রাইসার কথা শুনা মাত্র ওর চেহারা অন্য রকম হয়ে গেল আর রুক্ষ গলায় বলল-

 -হয়ত ভাল; না অবশ্যই ভাল আছে।

কথা বলায় ওর এমন অস্বাভাবিকতা দেখে জিজ্ঞেস করি-

 -কি হয়েছে?রাইসা কোথায়?ও বলে দোস্ত রাইসা তো আমার নয় । আমি কেমনে জানব ও কেমন আছে?

 - কেন তদের এত ভাল সম্পর্ক...

 একটু মজা করেই তারপর বলি –
 - খুলে  বল।নিজে যাতে ঐ ফান্দে না পড়ি।

ও একটা সিগারেট ধরাল।তারপর বলতে শুরু করল-

" আমার আর রাইসার সম্পর্কের কথা আস্তে আস্তে মা-বাবা,ওর পরিবার ও জানতে পারে।তবে কোন ঝামেলা ছাড়াই উভয় পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের মাস খানেক আগে একটা কাজে কুমিল্লা যাই।ওদের গ্রামের বাড়ি ও ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছেই। হঠাৎ ও ফোন করে বলে দাদু তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।আমি বলি,ঠিক আছে একদিন গিয়ে ওনার সাথে দেখা করে আসব।ও ভারি গলায় বলে না তোমাকে আমাদের বাড়িতেই এই কদিন থাকতে হবে।আমি হেসে বলে বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকলে লোকে কি বলবে?

ও ওর স্বভাব মতই আদেশের সুরে বলে তুমি যাচ্ছ এইটাই শেষ কথা । তো কোনো উপায় না পেয়ে গেলাম ওদের বাড়ি। থাকলাম,খেলাম,ঘুরলাম। ২ দিন পর একটা দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বখাটে ধরনের একটা ছেলে বলে উঠে –ওই যে সালাম রাজাকারের নাতজামাই যায়। এ কথা শুনে আমি থমকে দাঁড়াই।গিয়ে জিজ্ঞেস করি কি বললেন?
ওরা বলে-রাজাকারের জামাই দেখি গরম দেখায়। অস্থির হয়ে গেলাম আসল ঘটনা জানার জন্য । অবশেষে এক বৃদ্ধের কাছ থেকে আমার হবু দাদা শ্বশুর আর শ্বশুরের ৭১ এ ঘটানো কিছু ঘটনার কথা জানতে পারি।এরপর কাউকে কিছু না বলে ই চলে আসি । এর ২ দিন পর রাইসা আমার বাসায় চলে এল। আমার মোবাইল বন্ধ ছিল বলে ফোনও করতে পারে নাই। এসে বাবা মাকে সব বলল ।

বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,"কি হয়েছে? ওদের বাড়ি থেকে নাকি না বলে চলে এসেছিস ?"
 আমি শান্ত গলায় বলি,"বাবা এ বিয়ে হবে না।"
 সবাইতো আকাশ থেকে পড়ল।
বাবা বললেন, "১ মাস পর তোদের বিয়ে তুই এখন এসব কি বলছিস? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এইসব কি বলছিস?"

আমি যথাসম্ভব শান্ত ভাবে বললাম,"আমি কোনো রাজাকারের মেয়ে বা নাত্নিকে বিয়ে করতে পারবনা । এতক্ষনে রাইসার মুখের ভাব পরিবতন হল । চেহারায় কেমন যেন একটু তাচ্ছিল্য । আর বাবা নির্বাক।

রাইসা বলল,"এসব তুমি কি বলছ এইসব পুরনো ঝামেলার বিষয় টেনে এনে আমাদের ভালবাসা শেষ করে দিতে চাইছ?হাউ ফানি?"
 আমি বলি,"তোমার কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ,আমার দেশ ফানি হতে পারে আমার কাছে নয়।তোমার বাবাদের মত রাজাকাররা আজও তাদের কৃত দুষ্ক্রমের জন্য অনুতপ্ত নয় । তোমার মত তাদের সন্তানদের ও শেখাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল ঝামেলা, ছিল গণ্ডগোল। তোমার মত মায়ের কাছে আমার সন্তান কি শিখবে?"

ও তীক্ষ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,"তাহলে তুমি এ বিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছ?
আমি বললাম,"মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান হয়ে তো আমি আমার সন্তানকে এইসব শেখাতে পারিনা  সুতরাং 'হ্যাঁ'।"

ও কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল,"তোমার এ ত্যাগ এর জন্য তোমার দেশ তোমাকে কি দেয় দেখব ..."
তারপর আরেকবার আমার দিকে ক্রোধের দৃষ্টি ছুড়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। বাবা মা দুজনেই শুধু অবাক চোখে দেখলেন কিছু বললেন না।বলে জয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর আর কখনো দেখা হয়নি। বছর খানেক পর একটা মার্কেট এর সামনে দেখা হয়েছিল।

জিজ্ঞেস করি,"কেমন আছ?"
তার জবাব না দিয়ে ও বলে," আমার স্বামী ,বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হকের ছেলে।"

আমি আর কিছু না বলে সোজা হাঁটা দিই। এরপর দেখলে দুর দিয়ে চলে যাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়।

একটু পর পথে বের হই। হাঁটতে হাঁটতে নিজে নিজে ভাবি, জয় কি বোকামি করল?  
উত্তর নিজেই দিই, না ভুল কেন হবে সত্তিকারের দেশপ্রেমিকতো একেই বলে। অথচ ওকে আজ পালিয়ে চলতে হয়। দেশ ওকে একটা চাকরি ও দিতে পারে নি কারন এখন জয় এর কোন পাওয়ারফুল মামা নাই।

আমি কি রাইসা কিংবা শামসুল হক এর ছেলে কে দোষ দেব ? কিভাবে? আজ শেখের রক্তে ও যে মিশেছে রাজাকারের রক্ত । তবে কি দেশটা এগিয়ে যাবে অন্ধকারের দিকে ? যেমন আমি এগিয়ে যাচ্ছি বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকার গলির দিকে?

না-যত দিন জয় এর মত দেশ প্রেমিক থাকবে ততদিন এ দেশ অন্ধকারে ডুবে যাবে না। আমদের ই লড়াই করে এ দেশ কে বাঁচাতে হবে, কিন্তু কিভাবে? হাঁটি আর ভাবি…. দীর্ঘশ্বাস ফেলি...


-good boy

No comments:

Post a Comment