Subscribe:

নীল

লালন সাইয়ের ব্রিজের উপর যখন আমাদের জিপটা উঠলো তখন বাহিরে ঝুম বৃষ্টি।আমাদের ড্রাইভার হারুনের মুখে ভাজা মুড়ি। তা খেতে খেতেই ও বললো, “মাজারে যাওনের অনেক শখ ছিলো।মাজারের হালুয়া যেই বেডা একবার খায়, সে চাইরডা বিয়া করতে পারে”।
আমি হাসি, তানজিয়া বিরক্ত হয়।প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সে হারুনকে বলে, “এত বিয়া করার শখ কেন তোমার হারুন?”


হারুন পিছনে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “আফা আমার তো অনেক ফ্রেমিকা।দুই চারডারে বিয়া না করলে বাচুম কেমনে”।
আমি জিপের জানালা খুলে বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে তানিজিয়াকে বলি, “হৃদয়ের দাবি বুঝলা?এসব তুমি বুঝবেনা, বাচ্চা মেয়ে”।
তানজিয়া আমার দিকে একটা ঠোট বাকানো হাসি দিয়ে এমন ভাবে তাকালো যেন আমি এক অদ্ভুত চিড়িয়া।তারপর নিজের আড়ং থেকে কেনা লাল ব্যাগটা থেকে একটা কলা আর বনরুটি বের করে খেতে খেতে বললো, “আমার একটা দুই বছরের মেয়ে আছে অর্ক।আমি নিশ্চিত সে তোমার থেকেও বুদ্ধিমান।কারণ তুমি মাঝে মাঝে যেমন ছাগলের মত উদ্ভট কথা বলো, আমার মেয়েটাও এমন বলেনা”।
আমি হা হা করে জোরে জোরে হেসে উঠলাম।কিছু বললাম না।শুধু শুধু তানজিয়াকে জ্বালাতন করার মানসিকতা আমার নেই।মেয়েটাকে আমি যথেষ্টই পছন্দ করি(প্রেম নয়), তাছাড়া ওকে জ্বালাতন করার মত মন মানসিকতা আমার নেই।সে কোন কথায় কি মনে করে বসে বলা যায়না।

যাই হোক।পাঠককে আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য জানানো দরকার।আমি একজন ছোটখাট চাকুরিজীবি, আর তানজিয়া কিছুদিন আগে ইন্টার্ণ শেষ করে এখন পূর্ণ ডাক্তার।আমাদের পরিচয় ব্লগিং করতে যেয়ে।কোন এক সোশ্যাল কাজ করতে গিয়ে পরিচয়টা আরো ভালো হয়।এই মেয়েটা খুব সোসিওপ্যাথ ক্যাটাগরীর, আমি অস্বীকার করবোনা যে আমি ওই রকম নই।আর তার জন্যই হয়তো আমাদের মাঝে একটা ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে।আমি আমার জবের বাহিরে অনেক কিছু করতে পারিনা, বা করতে চাইনা।কিন্তু মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছা করেই শহুরে ব্যস্ততার বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে একটু শ্বাস ফেলতে চাই, সবুজের মাঝে বাচতে, টলটলে নদীর জলে নিজেকে হারিয়ে হারিয়ে খুজি।এমনটা খুব বেশি হয়না।অফিস থেকে দুদিন ছুটি নিয়ে হয়তো বেড়িয়ে পড়ি।এ ব্যাপারগুলো আগে হতোনা, হতোনা যতদিন না তানিজয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো।ওর সাথে পরিচয় হয়েই কিনা আমার মধ্যে এমন অনেক ভাবনা আসা শুরু করলো।কারণ মেয়েটা এত সুন্দর করে বিভিন্ন জায়গার বর্ণনা করে, আমার চোখে মুখে তখন লোভ ছড়িয়ে পড়ে সৌন্দর্যকে দেখার, জানার এবং উপলব্ধি করার।এক্ষেত্রে সঙ্গী হিসেবে এই অসাধারণ দৃঢ় মানসিকতার স্নিগ্ধ মেয়েটিকেই আমি বেছে নেই।অথবা সেও হয়তো আমাকেই বেছে নেয়।ওর কথা নাহয় একটু একটু বলি।

তানজিয়ার কথা বলতে গেলে প্রথমে যেটা বলতে হয় তা হলো ওকে প্রথম দেখেই মনে হয় এই মেয়েটার সাথে প্রেম করা যাবেনা।সে বন্ধু হিসেবে চমৎকার, প্রেমিকা বা বউ হিসেবে নয়।এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল।তানজিয়া বন্ধু হিসেবে মোটেই চমৎকার নয়। সে একটু রুক্ষ, কিছু সময় বদমেজাজী এবং আগেই বলেছি আপনাদের, সে সমাজ সংসার বিবর্জিত টাইপ একজন মানুষ।কিন্তু একটা কথা বলতেই হয়, আমি তানিজিয়াকে অনেক সম্মান করি।ওর জীবনের অল্প বিস্তর যা জানি তা জেনে এবং খানিকটা অনুধাবন করতে পারি বলেই হয়তো এই সম্মানের উৎসটা অনেক গভীর।তানিজয়া এটা বুঝে, আর এইজন্যই ও জানে আমি ওকে কখনো এমন কিছু বলবোনা যাতে ওর সম্মানে আঘাত লাগে।আর আমি আসলে তেমন কিছু ভাবতেই পারিনা।প্রেম বিয়ে জাতীয় ব্যাপারগুলোতে আমার কেন যেন আগ্রহ কাজ করেনা।
তানিজিয়া যখন সেকেন্ড প্রফ শেষ করে, ওর বিয়ে হয়ে যায়।এক বছর আদিব নামক চমৎকার একটি মানুষের সাথে অসাধারণ কিছু মুহূর্ত পার করে একদিন সব শেষও হয়ে যায়।আদিব ভাই তখন বরিশাল মেডিকেলে কর্মরত।আর তানিজিয়া সলিমুল্লাহ মেডিকেলে পড়ছে।সেসময় ও ওর থার্ড প্রফ নিয়ে প্রচন্ড ব্যাস্ত।একদিন তানজিয়াকে আদিব ভাই ফোন করে বলে, “তোমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে।সারা রাত তোমার হাত ধরে গল্প করবো।শর্ত একটাই, তুমি চুপ করে শুনবে”।
তানিজয়া ঘ্যানর ঘ্যানর করা শুরু করে, বলে তার পরীক্ষার কথা।আদিব ভাই দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, “ঠিক আছে আসবোনা।দু মাস পর প্রফ শেষ হলেই না হয় তোমাকে আবার জ্বালাবো”।
তানিজিয়া চুপ করে থাকে।পরে বলে, “জ্বি না জ্বি না।আজকেই আসতে হবে।যেভাবেই হোক।আমি কালকে হল থেকে বাসায় ফিরবো এবং তোমার সাথে অনেক অনেক গল্প করবো।কত কিছু বলা হয়নাই”।

আদিব ভাই রওনা দিয়েছিলো তার ভালোবাসার মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলার জন্য, তাকে একটাবার বলার জন্য আমি তোমাকে ভালোবাসি।কিন্তু সেই তৃষ্ণা বুকে নিয়েই তিনি হারিয়ে গেলেন।২৬শে জানুয়ারী ২০০৯ সালের এক গভীর রাতে একটি লঞ্চ ডুবে গিয়েছিলো, আর সেই লঞ্ছে আদিব ইউসুফ নামে একজন সাধারণ মানুষ হারিয়ে যায় চিরতরে তার ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে।তানজিয়া তার লাশটাও দেখতে পায়নি।দিনের পর দিন সে কেদেছিল, নিজেকে দায়ী করে চিৎকার করে কেদেছিলো।আমাদের আশেপাশের জগতটা বড়ই নিষ্ঠুর, তারা কেউ এই কান্নায় সাড়া দেয়নি।তাই তানিজিয়াকে একা একা পথ চলতে হয়েছে।আর সে হারিয়েও যায়নি। সে এগিয়ে গেছে, ডাক্তারী পাশ করেছে। প্রতি বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার বিনা ভিজিটে বাড্ডায় একটা ছোট্ট ক্লিনিকে প্রসূতি মায়েদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।তানজিয়াকে কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে, “তুমি ভালো আছো তো?”
তানজিয়া মুখে রাগ রাগ ভাব ফুটিয়ে বলে, “খারাপ থাকবো কেন?”
আমি যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম তখন বলেছিলো, “ভালো নেই অর্ক।প্রতিরাতে ও স্বপ্নে এসে আমাকে বলে এত ঘুমাও কেন?জেগে উঠো, আমাদের না কত কত গল্প!”


যাই হোক মূল কথায় ফিরে আসি।আজকে আমাদের এই ভ্রমনের উদ্দেশ্য দুটি।এক, লালন সাই এর মাজার দেখবো।আর দুই, যমুনায় জেগে ওঠা চর হালুদিয়ায় এক মহাপুরুষের সাথে সাক্ষাত করবো।মহাপুরুষের নাম কবির ভাই।তার সাথেও আমার পরিচয় ব্লগিং করতে যেয়েই।কবির ভাইয়ের বয়স ৩৮ এর কাছাকাছি।উনি রাশিয়া থেকে পি.এইচ.ডি করে বাংলাদেশে এসে বিয়ে করেন।দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিয়ের দুই বছরের মাথায় তার স্ত্রী ভেগে যায়।কার সাথে এটা কবির ভাই নিজেও জানেনা বলেই অবগত হয়েছিলাম।এরপর মনের দুঃখে কবির ভাই কিছুদিন উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে ফিরে এই চরে এসে আশ্রয় নেয়।তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত জায়গা থাকতে এই চরে কেন?উনি বলেছিলেন, “নদীর পাশে থাকতে ভালো লাগে।এই নদী যেমন স্রোত হারিয়ে ফেলেছে, এখানকার মানুষগুলোও তেমনি।এদের কোন আশা নেই, চিন্তা নেই।দু বেলা খাওয়া আর রাতের বেলায় একটু শোয়ার জায়গা হলেই তারা শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলে”।
কবির ভাই একটা ছোট্ট বেড়া দিয়ে বাধানো স্কুল বানিয়েছেন চরের বাচ্চাদের জন্য।সেখানকার ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে শিক্ষকতা সবই তার কাজ।সমস্যা একটাই বাচ্চারা পড়তে চায়না।তারা স্কুলে আসে কবির ভাইয়ের মুখ থেকে রুপকথার গল্প শুনতে।গল্প শেষ হলে যেই কবির ভাই পড়াশোনা শুরু করতে চায়, যে যেখানে পারে ছুটে পালায়।পালানোর আগে একটু ছোট্ট গুড়িগুলো কবির ভাইয়ের হাতে পায়ে কামড়ায় যায়।কবির ভাই তাকে কামড় দেয়ার রহস্য আজো উদ্ধার করতে পারেনি বলেই জানতে পেরেছিলাম।
আমরা যখন লালন সাইয়ের মাজারে পৌছালাম তখন টকটকে ভোর।মাজারে যেয়ে বড়ই কষ্ট পেলাম।গাজার গন্ধে টিকা যায়না।যখন আমরা মাজারে পা দিলাম, লাল কাপড় মাথায় দিয়ে তার খাদেমরা আমাদের দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে ছিলো।কেন যেন সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে মন চাইলোনা।লালনের মত করে গুনগুন করে আবৃত্তি করছিলাম, “সব লোকে কয় লালন কি জাত এ সংসারে, লালন বলে জাতের কি রুপ দেখলাম না এক নজরে”।


হালুদিয়া চরে যখন পৌছালাম তখন কয়েকটা ১০-১২ বছরের কিশোর চরের বালি দিয়ে ঘর বানাচ্ছিলো।আমি মনোযোগ দিয়ে তাই দেখছিলাম।কবির ভাইয়ের চিৎকারে আমার ধ্যানমগ্ন হলো।কিশোরগুলো কবির ভাইকে দেখে ভেংচি কেটে ভৌ দৌড় দিলো, কবির ভাই ওদের পিছনে ছুট লাগালেন আর আমরা কবির ভাইয়ের পিছে।কবির ভাই একটু দৌড়িয়ে থামলেন, একটু বিশ্রাম নিয়ে বললেন, “সবকয়টা বিচ্ছু।পিটায়ে ছাল চামড়া এক করে দিবো।"এরপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অর্ক সিগারেট আনছো?”
আমি মাথা নাড়ি দু পাশে।পাশে তানিজিয়াকে দেখায় বলি, “ম্যাডাম বলছে সিগারেট স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর।তাই যখন কিনতে গেলাম সে বাধা দিছে এবং বলছে যে সিগারেট কিনবে আর যে খাবে দুইজনেরই ব্যাক্কেল দাত ভাঙ্গার ব্যবস্থা করা হবে”।
কবির ভাই তানজিয়ার দিকে তাকায় ঢোক গিললো।তানিজিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে ছবি তুলছিলো।আমি তানজিয়ার দিকে তাকিয়ে তার অদ্ভুত উদাসীনতা দেখছিলাম।

কবীর ভাই আমাদের জন্য চরটা ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থা করলো।চরের মানুষগুলোকে জানার ও চেনারও ব্যবস্থা করলো।মানুষগুলো বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছে।সবাই বড়ই চালু প্রকৃতির।কিন্তু তারা ভালো মানুষ, অন্তত আমার এমন মনে হয়েছিলো।চরের মাঝে একটা ছোট্ট নদীর ধারা বয়ে গেছে।সেটা পার হওয়ার জন্য আমাদের একটা সাকোতে উঠতে হবে।আমি এ ব্যাপারটায় খুব অস্বস্তি বোধ করলাম।মনে আছে ৯৮ এর বন্যায় সাকোতে উঠতে যেয়ে চিৎপটাং খেয়েছিলাম।কিন্তু আজকে সাথে তানজিয়া আছে, কবির ভাইও ফরফর করে পার হয়ে গেলো সাকো।তাই আমি অনেক সাহস বুকে নিয়ে সাকোর কাছে গেলাম।তানজিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার হাত ধরে পার করতে পারবা?এমন সাকোতে উঠার অভ্যাস নাই। ভয় লাগে”।
আমি হতচকিত হলাম এবং নিজেকে সামলিয়ে সাকোতে উঠে এক হাতে সাকোর বাদিকে ধরে আরেকটা হাত তানজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেই।যেইমাত্র সে আমার হাতটা ধরলো আমার পুরো শরীর কেপে উঠলো এবং আমি বুঝতে পারলাম আমার হৃদয়ের পুরোটা এই উদাসীন মেয়েটাকে দিয়ে বসে আছি।আই এম জাস্ট এ স্টুপিড।তানজিয়া কি কিছু টের পেল?আশা করি না।
দুপুরবেলা কবির ভাই নিজে আমাদের জন্য নদীর টাটকা শিং মাছের ভর্তা, ছোট ছোট করে কাটা আলুর ভাজি, গাঢ় মুগ ডাল আর কচি লাউ এর স্যুপ জাতীয় কি যেন এনে দিলো।আমি খাচ্ছি আর মনে মনে বলছি, কবির ভাই আপনি মহান।আমাদের সাথে আরো কিছু ছোট বাচ্চা খাচ্ছিলো।এর মধ্যে একটা বিড়াল ছানার মত।বয়স বেশি হলে ৫ হয়েছে, সারা মুখ মাখিয়ে ভাত খাচ্ছে।আমি বললাম, “কিরে বেটি এমন করে ভাত খায় কেউ?”
পিচ্চি আমার দিকে রাগ রাগ করে তাকিয়ে বলে, “খিদা লাগে না?”
আমার চোখে পানি এসে গেলো।কবির ভাই হেসে বললেন, “এইগুলা আমার এক একটা বাচ্চা।একটারও মা বাপ নাই, কোথা থেকে আসছে আল্লাহ মাবুদ জানে।ওদের খেতে দেখলেই কি যে শান্তি লাগে অর্ক, তুমি বুঝবেনা”।
আমি কিছু বলিনা, কবির ভাই হয়তো বুঝবেওনা আমার আজকে একবেলা এই দেবশিশুদের সাথে বসে দু মুঠো ভাত খেয়ে কি অসাধারণ অনুভূতি হলো।সন্ধ্যার একটু আগে আগে আমরা রওনা দেবার আগে কবির ভাই আমাকে ডেকে বললেন, “অর্ক তোমার ভাবী চিঠি লিখেছে।আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি ভালো আছি নাকি”।
আমি মাথা নিচু করে বলি, “ভাইয়া ভাবীকে চলে যেতে দিলেন কেন?”
কবির ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “দু বছর ওর সাথে ছিলাম।মেয়েটা এত ভালো ছিলো যে কখনো বলতেও পারেনি যে সে আরেকজনকে ভালোবাসে।আমি বারবার ভাবতাম সে আমার সাথে সহজ নয় কেন?আমাকে আপন ভাবেনা কেন?কাছে আসেনা কেন।নিজে নিজে বের করে জানলাম ছেলেটার কথা।ও অভিমান করে আমাকে বিয়ে করেছিলো, সেই অভিমানটায় ও নিজে কতটা পস্তাচ্ছিলো তা আমি ভালো করেই জানি।আমি নিজেই ওকে বলেছি নিজের জীবন নতুন করে শুরু করতে।আমার আর কোন উপায় ছিলোনা ছেলে”।


আকাশের চাঁদ যখন তার সবটুকু জাদুকরী স্নিগ্ধতা নিয়ে আমাদের গায়ে এসে পড়লো, তখন আমি তানজিয়ার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখছিলাম।সে ঘুমিয়ে আছে।মাথায় ওড়না দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।এই মেয়েটাকে আমি কখনো বলতে পারবোনা আমি তাকে কতটা চাই।কারণ আমি ওকে অসম্মান করতে পারবোনা।ও প্রচন্ড কষ্ট পাবে যদি আমি কখনোও ওকে এমন কিছু বুঝাতে চাই।আমরা বন্ধু, ভালো বন্ধু।এইখানে এসবের স্থান নেই, অন্তত ওর কাছে নেই।সে আবিদ ভাইকে অনেক ভালোবেসেছিলো আমি তা জানি।মাত্র দু বছর হলো ওর জীবনে সেই ভয়ংকর দিনটি এসেছিলো।ও সেইদিনের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা নিয়ে আজো বেচে আছে, সেখানে আমার কোন স্থান নেই।একদম নেই।
রাত একটু গভীর হলে তানজিয়া ঘুম থেকে জেগে উঠলো।আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “অর্ক ক্ষিদা লেগেছে।গাড়িটা কোথাও থামায় কিছু কিনে খাওয়া যায়না?”
আমি মাথা নাড়ি।হারুনকে বলি কোন একটা ভালো হোটেল দেখে গাড়ি থামাতে।হঠাৎ করে একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পাই।তানজিয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ওর খুব মন খারাপ।আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনা, গাড়ির জানালা খুলে বাহিরে তাকিয়ে এমন ভাব করি যেন কিছু খেয়াল করিনা।তানজিয়া আমাকে বলে নিজে থেকেই, “এই রাস্তা দিয়ে জানো এর আগেও পার হয়েছিলাম।ওইযে সামনে একটু গেলেই একটা ছোট্ট ব্রিজ পড়বে, বেন্টিংটনের ব্রিজ।আমি আদিবের হাত ধরে ব্রিজের উপর দিয়ে হেটে হেটে পার হয়েছিলাম”।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “বাকি জীবনটা কি এভাবেই কাটাবে?”
তানজিয়া জিজ্ঞেস করে, “কিভাবে?”
আমি কিছু বলিনা।একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আকাশের চাঁদ দেখি।তানজিয়া বলে, “আমার বাসায় আমাকে বিয়ে দিতে যাচ্ছে আবার।আমার ভাইয়ার এক বন্ধু অনেকদিন পর ইউ.এস.এ থেকে এসেছে আমাকে বিয়ে করার জন্য।লোকটা আমাকে আদিবের সাথে বিয়ের অনেক আগে থেকে পছন্দ করতো।ভালো লোক ছিলো, কিন্তু আমার ওভাবে কখনো ভাল লাগেনি।আমার কাউকেই ভালো লাগেনা অর্ক।আম্মু আব্বু অনেক কষ্ট পায় তাই আমি কিছু বলিনি”।
আমি হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।আজই প্রথম জানলাম এই মেয়েটাকে ছাড়া আমার জীবনটা কতটা অসম্পূর্ণ, আর আজই সে এভাবে হারিয়ে যেতে চাচ্ছে।আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “চলো ভালো হোটেল পাওয়া গেছে, কিছু খেয়ে নেয়া যাক”।


অনেক ভোরে যখন ঢাকা পৌছালাম তখন চারদিকে ভয়ংকর কুয়াশা।সূর্যটা খুব লালচে মনে হলো, যেন কোন নিষ্ঠুর সীমার তার ত্রিফলার কুৎসিত আঘাতে সূর্যের বুকে আঘাত হেনেছে বারংবার।আমি চোখ ফিরিয়ে নেই।তানজিয়ার বাসার সামনে গাড়ি থামলে আমি ওকে বলি, শুভ সকাল তানজিয়া ম্যাডাম।গাড়ি থেকে ঝটপট নেমে প্রস্থান করুন।আমাকে দ্রুত বাসায় ফিরে বিশাল ঘুম দিতে হবে”।
তানিজয়া দাত বের করে বিশাল হাসি দিয়ে বললো, “তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ।এক কাপ চা খেয়ে যেতে পারো চাইলে।আম্মু তোমাকে দেখতেও চেয়েছিলো”।
আমি হেসে বলি, “স্যরি আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনা এটা আন্টিকে জানায় দিয়ো।আই প্রেফার টু বি এলোন”।
তানজিয়া গম্ভীর মুখে বললো, “জানি।আমার বিয়ে হয়েছিলো, ছোট্ট একটা মেয়ে আছে।এইজন্যই তো হা?”
আমি একটা অদ্ভুত কাজ করলাম তখন যেটা আসলে ওই পরিস্থিতে শোভনীয় নয়।কেন করলাম তাও জানিনা।আমি তানজিয়ার হাত ধরে বললাম, “না সেজন্য নয়।তুমি চাওনা এই জন্য”।
তানজিয়া হাতটা আস্তে করে সরিয়ে নিলো আর আমিও ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে জোরে জোরে হেসে দিলাম।এরপর বুঝলাম এতে আরো ব্যাপারটা অদ্ভুত দাড়াচ্ছে।তাই শেষমেষ ওকে বললাম, “তানজিয়া যাই।আন্টির সাথে আরেকদিন না হয় দেখা হবে”।
তানজিয়ার হতভম্ব দৃষ্টিকে পেছনে ফেলে আমি সামনে এগিয়ে যাই।হারুন জিজ্ঞেস করে, “স্যার কোথাও নাইমা নাস্তা করবেন।সামনে আল কারীম হোটেল আছে।ওইহানে ভালো খাসীর মাংসের ভুনা এখন পাওয়া যাইবো”।


আমি তানজিয়ার সাথে দু মাস লজ্জায় কথা বলিনাই।আমার বারবার মনে হচ্ছিলো ও কিছু একটা বুঝে গেছে।আমি নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃণা বোধ করছিলাম।কেন আমার তাকে ভালোবাসতে হবে?কেন তাকে এভাবে আমি অসম্মান করবো?নিজেকে প্রতিদিন আমি ধিক্কার দিয়েছি।যখন দু সপ্তাহ যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর ও ফোন করেছিল আমার নাম্বারে আমি কেন যেন ফোনটা ধরিনি।আমার ইচ্ছা করেনি একদম।তাই একদিন যখন ও আমার বাসায় এসে পড়লো সরাসরি আমি প্রচন্ড বিরক্তি বোধ করেছিলাম।হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলাম, “তানজিয়া আমি একটু অসুস্থ ছিলাম বেশ অনেকদিন, তাই যোগাযোগ করতে পারিনি”।
তানজিয়া মিষ্টি হেসে বললো, “কোন ব্যাপার না।তোমাকে একটা ভালো খবর দিতে এলাম।আমার সামনের মাসে দ্বিতীয় বিয়ে হতে চলছে।তোমাকে আসতে হবে।আমি আমার কোন বন্ধুকে এভাবে নিজে যেয়ে দাওয়াত দেইনাই।তোমাকে দিলাম, তাই আমার সম্মানটা রক্ষা করো।ঠিক আছে?”
আমি ওর অদ্ভুত মায়াকাড়া চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আচ্ছা”।


অনেক অনেক রাতে আমার হাতে একটা নীল রঙের সুপ্রভাতের ছবি আকা কার্ড।আমার ছোট্ট ঘরের চারদিকে নীল রঙ্গা একটা অনুভূতি ছড়িয়ে দিতে তা একটুও কার্পণ্য করেনা।আমি মুগ্ধ চোখে তানজিয়ার বিয়ের কার্ডের দিকে তাকিয়ে থাকি, ওতে আকা সবগুলা আলপনা কেমন যেন জীবন্ত হয়ে আমাকে ভেতরে ঢুকে উকি দেয়।আমার ভেতরে ধক করে উঠে যতবার ভাবি এই মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলবো আমি। কয়েক মুহূর্ত পর সে হারিয়ে যাবে কোন এক অজানা বাহুডোরে।হয়তো সে অনেক সুখী হবে, আমার করা হাজার প্রার্থনার থেকেও সুখী।তার চোখে হয়তো আকা হয়ে থাকবে নতুন ভালোবাসার গল্প, একটা নতুন স্বপ্নের সাতরঙ্গা রংধনু।ভাবতে অনেক অনেক কষ্ট লাগে যখন মনে হয় সেই সাতটি রঙ্গে একটাও আমি হতে পারবোনা।আমি তবুও কার্ডটাকে আমার পাশে নিয়ে শুয়ে থাকি।বালিশের অসমান উচু নিচু ধাপগুলো পেরিয়ে আমার দৃষ্টি বারবার কার্ডের উপর পড়ে।আমি ভিতরে খুলে দেখার সাহস পাইনা, একদম না।

***************************************************************************
আমার খুব কল্পনা করতে ইচ্ছা করে তানজিয়া এসে একদিন অর্কর হাত ধরে বলবে, “চলো আবার কোথাও ঘুরে আসি।" কিন্তু এমনটা হয়না, কেন যেন হয়না।সবসময় আমি এই বিশাল বিশাল স্বপ্নময় প্রেমের গল্প লিখি, আজকে একটা বাস্তব গল্প লিখলাম।এমন বাস্তব গল্পে, ভালোবাসাগুলো কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে থাকে।তাদেরকে ছোয়া যায়না, শুধু অনুভব করা যায়।



সাদ আহম্মেদ

No comments:

Post a Comment