Subscribe:

কান্না

কি কর?
খাচ্ছি।
কি?
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই,আলু আমার প্রিয় খাবার।
বল কি? আলু প্রিয় হলে তুমি দেখতে আলুর মত না হয়ে পটল হলে কেন?
মানে, আমি দেখতে পটলের মত?
১০০%,পুরা মিল।


আচ্ছা,আর আপনি তো দেখতে করল্লার মত।
করল্লা কত উপকারি জানো?
হুম জানি উপকারি কিন্তু  তেঁতো।
তেঁতোই তো মজা ,ওটার মধ্যে আলাদা মাদকতা আছে,তোমার এখনো বুঝে উঠার বয়স হয়নি আসলে।
আচ্ছা তাই না? আপনি বসে বসে করল্লাই চিবান, খোদা হাফেজ।


      ফোন রেখে দিল প্রিওতি।এই ছেলের সাথে সে তিন মিনিটের বেশি কথা বলতে পারেনা কখনো। সেবার প্রথম যখন দেখা হল,এক বান্ধবীর বড় বোনের বিয়েতে।আপুর বন্ধুদের সাথে মিলে ওরা হলুদের প্রোগ্রাম ঠিক করছে,আর প্রিওতি তার স্বভাবসুলভ মাতব্বরির সাথে প্রচুর বকর বকর করছে (ও এক মুহূর্ত চুপ করে থাকতে পারেনা, চুপ করে থাকলে ওর মাথা ঘুরায়,পেটের মধ্যে গুটর গুটর করা,বুক ধরফর করা সহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়)। তো হটাতই আপুর এক বন্ধু বলে বসল “তুমি ত দেখছি এফ এম রেডিও ,সারাক্ষন বাজতেই থাক”।ব্যাস আর যায় কোথায়,প্রিওতি রেগে খুন।ও আবার বেশি রেগে গেলে তোতলায়,আর বেশি রেগে গেলে কেঁদে দেয়।আর ও যত রাগে শোভনের ততই যেন সুখ।(বলা হয়নি এই বেহায়া বালকের নাম শোভন।নাম যাই হক তার মধ্যে সেটার কোন লক্ষণই নাই।সে হিটলার টাইপ ,মানুষকে রাগিয়ে কাদিয়েই সে শুধু সুখ পায়।)


সেই থেকে শুরু।এরপর বিয়ের দিন,তার পরের দিন,তার পরের প্রতিদিন সে প্রিওতিকে জ্বালিয়েই যাচ্ছে।প্রিওতি কে সে ডাকে রেডিও প্রিওতি ১০০০ এফ এম।
    আর প্রিওতি পৃথিবীর সবচেয়ে গাধা মেয়ে ,যে কিনা এই হিটলার টাইপ বেহায়া ছেলেটাকে তার মন দিয়ে বসে আছে ,প্রতিদিন স্বপ্নও দেখে এই ফাজিল ছেলেটাকে নিয়ে ।ওর ভালবাসার কথা যে বলবে তারই বা উপায় কি। নিশ্চয়ই শোভন হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলবে “শেষ পর্যন্ত পটল আর করল্লা দিয়ে এক তরকারি রাধবে?”তাই শোভনের সাথে কথা বললে সে প্রথমে রাগে তারপর কাঁদে।এখন যেমন কাঁদছে।


    ভার্সিটি গিয়েও ও গাল ফুলিয়ে রাখল।আর ওর বন্ধুরা হেসে হেসে ওর ফুলা গাল আরও ফুলিয়ে দিল।প্রিওতি কয়েকবার শোভনদের ডিপার্টমেন্ট এর সামনে গিয়ে হেটে এল । যদি তাকে দেখা যায়। উফ্ ওর নিজের উপরি রাগ হয়। কি শান্তিতেই না ছিল এতদিন। ক্লাস ,আড্ডা , হইছই, ঘুম এই ছিল ওর সব।আর এখন ক্লাসও করতে ইচ্ছে হয় না, আড্ডাতেও মন বসেনা,
আর নিদ্রাদেবী তো কাছে ঘেষতেই চায় না,আর যদিও বা আসে সাথে করে শোভন কে নিয়ে আসে।প্রিওতিকে সে অদ্ভুত সব সপ্ন দেখাতে থাকে।কিছু কিছু তো রিতিমত ভয়াবহ । যেমন সেদিন দেখল ও আর শোভন ঘরের মধ্যে দরজা আটকে চিৎকার করে ঝগড়া করছে। শোভন ওকে বলছে “তুমি মেয়েটা মহা ঝগড়াটে ,সারাক্ষন ঝগড়া করতে তোমার ক্লান্ত লাগে না” আর ও বলছে “না লাগে না ,তুমি যে বিয়ের আগে আমাকে কত জ্বালাতে, তোমার ক্লান্ত লাগত না?”।


     এমন ভাবেই দিন যায় । প্রিওতি কত প্লান করে কিভাবে শোভনকে জানাবে ,কিন্তু বলতে আর পারেনা কিছুতেই।রাতে ফোন দেয় শোভনকে।
কি করছেন?
ডায়েরি লিখছিলাম।
এত কি লিখেন?
এই আলু পটল করল্লা এসব নিয়ে লিখছি,ইদানিং সবজির যা দাম,এদের নিয়েই তো লিখা উচিৎ।
 প্রিওতির চোখে পানি চলে আসে।ইশ একবার কি এই ছেলেটা ওকে ভালবাসতে পারেনা। ওর শুধু কণ্ঠ শুনেই যে প্রিওতির গলা শুকিয়ে আসে ,হাত পা অসার হয়ে যায়,ও বুঝে না কেন?কি করলে বুঝবে?প্রিওতির হটাৎ হটাৎ মনে হয় ওর যদি খুব বড় একটা অসুখ করত,তাহলে শোভন বুঝত কেমন লাগে। ও কল্পনা করে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে আর শোভন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে,ওর মায়া মায়া চোখ দুটিতে অশ্রু ভরা,যে কোন সময় ওর  দাড়ি না কামান গাল বেয়ে নেমে আসবে। প্রিওতি তখন ওর অশ্রু মোছার নাম করে গাল ছুয়ে দিবে।
এই মেয়ে,কাদছ কেন?
কাদব কেন?
ফোঁপানির আওয়াজ পেলাম।
আমার ঠাণ্ডা লেগেছে ,রাখলাম ,বাই।
ফোনটা রেখে কাদতে বসে ও । শোভনের সাথে দেখা হওয়ার আগে ওর জীবনে কান্না বলতে কিছু ছিলই না।অথছ এখন সেটাই ওর নিত্যসঙ্গী । কিন্তু অদ্ভুত বেপার হল তখন কান্না ছিল না কিন্তু সাথে আরও যেন কি একটা ছিল না। একটা অজানা অনুভুতি যার অস্তিত্ব ও প্রতিমুহূর্তে অনুভব করে,আর সেই অনুভুতি দিয়ে ও নিজেকে চিনে,ও যে প্রিওতি ও যে বেচে আছে তা বুঝে।নিজের অস্তিত্তের এত প্রবল উপস্থিতি ওর জীবনে ছিল না আগে।

    আজ ১৩ই ডিসেম্বর ,প্রিওতির জন্মদিন।এই দিন টা নিয়ে ও এম্নিতেই উত্তেজিত থাকে।তবে এবার একটু বেশি। শোভন কি করবে ,কখন উইশ করবে,নাকি করবে না তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে ও মাথা গরম করে ফেলেছে। আর থাকতে না পেরে শেষে ১২ টা বাজার কিছু আগে গিয়ে মাথায় পানি ঢেলে এসেছে।
    সকালবেলা আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গে । “জন্মদিনের দিন এত ঘুমুতে হয় নাকি”আম্মু বলে। ধ্যাত , ও কি ঘুমিয়েছে নাকি? সারাটা রাত অপেক্ষা করে শেষে ফোন বন্ধ করে বসে ছিল।ভেবেছিল ফোন করে বলবে “আপনি আর কোনদিন আমাকে ফোন দিবেন না”।নাহ ,আজ সারাদিন ও ফোন খুলবে না,বেরও হবে না কোথাও। দরকার নেই কারও উইশের।

     কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে দেখে শোভন দাড়িয়ে। হাতে এক গাদা  লাল গোলাপ।প্রিওতি ঠোট ফুলিয়ে দাড়িয়ে থাকে।
“শুভ জন্মদিন, ফোনে কাউকে উইশ করতে ভাল লাগে না বলেছি না,তাই চলে এলাম।“
 প্রিওতি কি করবে বুঝে উঠতে পারে না,ফুল গুলো নিবে না চোখ মুছবে না শোভনের হাত ধরবে,ওর একিসাথে সব করতে ইচ্ছে হয় ,কিন্তু কিভাবে?

     হটাৎ চোখ মেলে তাকায়।আরে দরজা ধাকাচ্ছে কে যেন।ওহ , ও তাহলে সপ্ন দেখছিল।দরজা খুললে আম্মু জানায় অনন্যা ফোন দিয়েছে।ও গিয়ে ফোনটা তুলে নেয়। অনন্যা হড়বড় করে বলে যায় “মাই গড , তুই কই ছিলি ? ফোন বন্ধ। শোভন ভাইয়া বাইক এক্সিডেন্ট করেছে,শাহাবাগের মোড়ে ,ফুল কিনে ফিরছিল বোধহয়। ঢাকা মেডিকেল এ নিয়ে গেছে,অবস্থা বেশি ভাল না,তুই আসবি?”
     প্রিওতি সব শুনছিল কিন্তু ও কিছু বুঝছিল না। ওর জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালে গিয়ে দেখে শোভনকে শুভ্র কাপড়ে ঢেকে রেখেছে আপাতমস্তক।এরপর কি হয়েছে ,প্রিওতি কি করেছে ওর পরবর্তীকালে কিছুই মনে থাকে না।শুধু মনে থাকে কিছু গোলাপের ডাল ,এক্সিডেন্টের সময় যার পাপড়িগুলো ঝোরে পরেছে,আর মনে থাকে একটা ডায়েরির কথা,প্রিওতি রাগলে ওকে দেখতে কেমন লাগে, ওর টোল পরা হাসিটা,ওর অভিমানি গাল দুটি ,ওর চোখ, চোখের অশ্রু এসব কিছুর কথাই যেটাতে লেখা, যেটা দিবে বলে শোভন আসছিলো ছুটে,ওর জন্য জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার। পুরো পথটুকু না এসে তবে কেন মাঝপথেই হারিয়ে গেল?

      প্রিওতি অনেকটা বছর মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন ছিল। ওর সবচেয়ে বড় অস্বাভাবিকতা ছিল ও কখনো কাঁদত না ।কোনো কিছুতেই না। ধীরে ধীরে সবার প্রচেষ্টায় ও সুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু একটা ব্যাপার থেকে যায়। প্রিওতি আর কখনই কাঁদেনা।


(FOUZIA KHANAM MARY)

No comments:

Post a Comment