Subscribe:

বার্তা পেয়েছি মনে...

আমি মনে মনে যত কথা বলি তার সিকি ভাগও মুখে বলিনা। ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যেস। এমন দিনও গেছে যখন আমি সারাদিনে একটা কথাও বলিনি। অথচ সেই দিনটাতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে গেছি নিজের সাথে। বন্ধুদের আড্ডায় সদা নির্বাক আমাকে সহ্য করে নিয়েছে সবাই। বন্ধুরা জানে আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নেড়ে অথবা ঘাড় কাত করে জবাব দেই আমি,আর খুব বেশী হলে মুচকি হাসি। নতুন কেউ এলে তো জিজ্ঞেস করেই বসে আমি বোবা কি না। চোখে কৌতুক আর ভাবলেশহীন হাসি দিয়ে আমি তাদের বিভ্রান্ত করি। বন্ধুরা অবশ্য খুবই মজা পায় এতে। হেসে গড়াগড়ি খায়। আমারও ভালই লাগে।


বাসা আর স্কুলের চার দেয়ালের বাইরেও একটা জগত আছে,সেটা আমার চাইতে ভাল কেউ বোঝে বলে আমার ধারণা ছিলনা। কিন্তু কলেজে উঠে দেখলাম আমার ধারণাটা ভুল। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমার অজানা। বাবু যেদিন সিগারেট দিয়ে বলল – “জীবনে সিগ্রেটের চাইতে আপন কেউ নাই রে পাগলা, টান দে, বুঝবি”, সেদিন কিছুটা ভয় আর আবিষ্কারের আনন্দে সিগারেট ঠোটে লাগিয়ে জোরে ধোঁয়া টেনে নিতে দিয়ে দম বন্ধ হয়ে মরার যোগার। কাশতে কাশতে জীবন শেষ। চোখ দিয়ে পানিও পড়েছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু পরদিন আস্তে আস্তে টান দিয়ে ধোয়া গেলাটা রপ্ত করে ফেললাম। এরপর থেকে নিয়মিতই খেতাম। বাসায় যাবার আগে লজেন্স খেয়ে নিতাম কয়েকটা। মা তবুও কিভাবে যেন বুঝে গেছিল। আমার ভুবন ভোলানো রহস্যময় হাসি দিয়ে মাকেও ধন্দে ফেলে দিয়ে সে যাত্রা বেঁচে গেছিলাম। কিছুদিন পর যখন হোস্টেলে উঠে গেলাম, তখন থেকে আর লুকোচুরির দরকার পড়তো না।

রানাকে একদিন দেখলাম আমার টেবিলে বসে সিগারেটের তামাক বের করে একটা কাগজে রাখছে। এরপর ছোট্ট একটা কাগজের পুটলি থেকে শুকনো কিছু পাতার মত জিনিস বের করে ছোট্ট কাঁচিটা দিয়ে কেটে তামাকগুলোর সাথে মিশিয়ে চিকন চিকন সিগারেট বানাল। তারপর টেবিলের ওপর পা তুলে বেশ আয়েশ করে সেই সরু সিগারেট ধরাল। প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল, কেন একটা বড় সিগারেট ভেঙ্গে ছোট ছোট সিগারেট বানাল? ওর কাছে সিগারেট নেই বলে? হায় রে, গরীব ঘরের ছেলে, মনে হয় টাকা শেষ হয়ে গেছে। আমাকে বললেই তো আমি সিগারেট কিনে দিতাম। কিছু বলিনি আমি, তবুও আমার চোখ দেখেই বুঝে নিলো রানা। সেদিন জানলাম এগুলো গাঁজা। এসব খেলে নেশা হয়। আর রানা গাঁজা না খেলে পড়তে বসতে পারেনা, ওর না কি মনোযোগ আসেনা পড়ায়। পড়ায় মনোযোগ তো আমারও আসেনা, তাই ওর কাছ থেকে একদিন একটা নিয়ে টেনে দেখলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো প্রথমে। মনে হল বিছানায় গড়িয়ে পড়বো। কিন্তু বসেই থাকলাম শক্ত করে। একটু পর মাথাটা বেশ হালকা লাগতে শুরু করলো, একটা নির্ভাবনা আর ফুর্তি ফুর্তি ভাব আচ্ছন্ন করলো আমাকে। এ এক অদ্ভুত ধরণের আনন্দ। প্রচণ্ড ঘুম পেলে যেমন ঘোর ঘোর লাগে, তেমন কিছুটা। পরে অবশ্য একদিন অনেক বমি হয়েছিল, বেশী খেয়ে ফেলেছিলাম সেদিন। কিন্তু বুঝে গেছিলাম আমি কতটা সহ্য করতে পারি।

সেদিন ছিল পহেলা বোশেখ। আমার জন্য বোশেখের প্রথম দিনটার আলাদা কোন গুরুত্ব ছিলনা, শুধু ছুটির দিন দেখে দেরী করে ঘুম থেকে উঠতাম, তারপর বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে পাঞ্জাবী পাজামা পড়া ছেলেগুলো আর বাসন্তী শাড়ীতে রাঙ্গানো পরিচিত মেয়েগুলোর হঠাৎ সুন্দর হয়ে ওঠা মুখগুলো দেখতাম। কোনদিন পাঞ্জাবী পড়ে সেই মিছিলে যোগ দেয়ার কথাও ভাবিনি। অথচ সেদিন আমার ঘুম ভাঙল বেশ সকালে। চোখ মেলেই দেখলাম আমাদের ছোট ঘরটা ঝলমল করছে বাসন্তী রঙ্গে। নতুন রুমমেট মাহবুবের বান্ধবী আর তার দুই সখীর খিলখিল হাসির শব্দটাই জাগিয়ে দিয়েছে আমাকে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে ওরা মুখে হাত চাঁপা দিলো। আমি হাতের ইশারায় বললাম – সব ঠিক আছে, আমি রাগ করিনি। এদিকে মাহবুব পড়েছে ভীষণ লজ্জায়। ঘুমুতে গেলে মাহবুবের কাপড় ঠিক থাকেনা। বেচারা উঠতেও পারছেনা বিছানা থেকে। ওর লুঙ্গিটা পড়ে আছে বিছানার নিচে। হাসি চাপা কষ্টকর হয়ে গেল আমার জন্য। বেশ শব্দ করেই হেসে ফেলেছিলাম সেদিন। কিন্তু মেয়েগুলো বুঝতে পেরেছিল মনে হয় সে কিছু একটা গড়বড় আছে, ওরা বাইরে চলে গিয়েছিল সাথে সাথেই। আর মাহবুব কোমরে চাদর পেঁচিয়ে উঠে এসে – “থ্যাঙ্কু বস্‌, আমার ইজ্জত বাঁচাইছেন” বলে জিহ্বায় কামড় দিয়ে কাপড় ঠিক করে হাতমুখ ধুতে চলে গেছিল বাইরে।

কিছু কিছু মানুষের উপকার করতে হয়না কোন ক্রমেই। মাহবুব সেই টাইপের মানুষ। ওর মাথায় সেদিন ঢুকে গেছিলো আমার এই উপকারের ঋণ তাকে শোধ করতেই হবে। বাথরুম থেকে এসে পাঞ্জাবী পড়তে পড়তে সে আমাকে ওদের সাথে বাইরে যাবার অনুরোধ করতে লাগলো। আমার বিখ্যাত হাসিটা দিয়েও ওকে কাবু করা গেলনা, তখন বেশ বিরক্তি নিয়েই ওর দিকে তাকালাম। থতমত খেয়ে মাহবুব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আমি ভাবলাম বাঁচা গেছে এ যাত্রা। পাশ ফিরে আরেক প্রস্থ ঘুমের চেষ্টা করে যাচ্ছি, এমন সময় আবার দরজায় টোকা দিয়ে শর্মীর আগমন ঘটলো ঘরে। শর্মী মাহবুবের বান্ধবী, ছোটখাটো উচ্ছল টাইপের মেয়ে। সারাক্ষণ হি হি করে হাসে। ওর আনন্দ দেখলেও ভাল লাগে। “ভাইয়া ... ওঠেন এখুনি। আজকে আপনি আমাদের সাথে ঘুরবেন সারা দিন। আপনি ঘর থেকে বের হননা কেন? এমন সুন্দর একটা দিনে কেউ ঘরে বসে থাকে? চলেন চলেন চলেন ...” - কে বলবে এই মেয়ে এই প্রথমবার আমার সাথে কথা বলছে। আমি যথারীতি মুচকি হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু শর্মী নাছোড় বান্দার মত মাহবুবের বিছানায় বসে পড়লো, আমাকে না নিয়ে যাবেই না। আজব যন্ত্রণা তো। হয়তো সেদিনের সকালটাই অন্যরকম ছিল। আমি ওর কথা মত গত ঈদে মা’র দেয়া খয়েরী রঙের পাঞ্জাবীটা পড়ে বের হলাম।

“ভাইয়া ... এ হচ্ছে রুমা আর ও চুমকি। আমার বান্ধবী আর রুমমেট” – শর্মী পরিচয় করিয়ে দিল ওদের সাথে। আমি হাসি হাসি মুখ করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খুব সাধারণ চেহারার দুটি মেয়ে, সুন্দর বলা চলে, কিন্তু অসাধারণ কিছুনা। রুমাই কথা বলল আগে “আপনার সাথে পরিচিত হইয়া বড়ই আহ্লাদিত হইলাম জনাব” – বলেই তিনজনে হেসে কুটিকুটি। দুষ্টু টাইপের মেয়ে,বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু আমিও যোগ দিলাম ওদের হাসিতে,মাহবুব যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল,সহজ ভাবে হাসতে লাগলো। আমি রাগ করে আছি কি না বুঝতে পারছিলনা বেচারা।

আমরা এগুলাম কলেজের মোড়েরে দিকে,ওরা মেলায় যাবে,কলেজের মোড় থেকে রিক্সা নেয়া হবে। কিন্তু রিক্সা নেয়ার সময়েই সমস্যা। রিক্সা আছে দুটো, মাহবুব আর আমি এক রিক্সায় বসলে মেয়ে তিনটা এক রিক্সায় বসতে পারবে। কিন্তু ওরা মাহবুব আর শর্মীকে এক রিক্সায় দেবে, কেউ কাবাব মে হাড্ডি হবে না। কাজেই আমরা তিনজন উঠে বসলাম এক রিক্সায়। রিক্সার সিটের ওপরে বসেছে রুমা, সেখান থেকেই অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে চুমকির সাথে। রিকশাওয়ালা একটু বেশী জোরে চালানোর চেষ্টা করছিল। যত দ্রুত প্যাসেঞ্জার পৌঁছে দিতে পারবে তার গন্তব্যে, তত দ্রুতই আরেকটা ভাড়া মারতে পারবে। এদিকে প্রায় অপরিচিত দুটা মেয়ের সাথে রিক্সায় বসতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার, বেকায়দায় বসেছিলাম। মেয়েদুটোর এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে আমাকেই বলতে হল – “এই রিক্সা আস্তে চালাও”।

প্রচণ্ড ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে যায় আমার। হাসপাতালের কেবিনে একা একা এই আঁধারে শুয়ে ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় আমার শরীর। কদিন থেকেই এমন হচ্ছে। অন্ধের মত হাতড়ে ইমারর্জেন্সি বাটনটা খুঁজে নিয়ে চেপে ধরি। জানি একটু পর নার্স এসে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে যাবে আমাকে। তারপর কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা ঘুমিয়ে পড়ার। এই সময়টুকুই কাটতে চায়না আমার। মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে কেউ গরম ধারালো একটা ছুরি দিয়ে একটু একটু খুঁচিয়ে চলেছে আমার মস্তিষ্ক।

“ওরা খুব অবাক হয়ে গেছিলো সেদিন তোকে কথা বলতে শুনে” – কৌতুক ঝরে পরে বাঁধনের গলায়। “ওরা ভেবেই নিয়েছিলো তুই কথা বলতে পারিস না। আচ্ছা, তুই অনেক মজা করেছিলি সেদিন, না?”। “হুম ... অনেক, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন ছিল সেই দিনটা” – সত্যি তাই। ওদের সাথে সারাটা দিন ঘুরেছিলাম, মাটির শানকিতে পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা খেয়েছিলাম কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। মাহবুবটা আবার ছোট মানুষের মত করে ভাত খায়। খেতে বসে ওর থুতনিতে লেগে গিয়েছিল একটা ভাত। টের পেয়ে শর্মী সেটা ফেলে দিয়ে ওর মুখটা মুছে দিয়েছিল। বড় ভাল লাগছিল ওদের ভালবাসাবাসি দেখতে। ওদিকে রুমা আর চুমকি তো হেসেই খুন। মাহবুবও লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল খুব।

সেদিনের পর আবার আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার একান্ত জগতে। সকালে উঠে ক্লাস, দুপুরে ল্যাব না থাকলে ঘরে এসে ঘুমানো, বিকেলে ঘরে বসে গান শোনা অথবা লাইব্রেরীতে বসে নোট করা। এক সময় প্রায় ভুলতে বসেছিলাম ওদের কথা,সেই দিনটার কথা। কিন্তু হটাতই একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে যায় ওদের সাথে। সকাল বেলায় কলেজের মোড়ে টং দোকানে আয়েশ করে চা খাচ্ছিলাম, ওরা তিনজন এসে নামলো দোকানের সামনেই। নেমেই কি একটা নিয়ে তিনজন ঝগড়া শুরু করে দিল। আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম ওদের ঝগড়ার বিষয়টা কি, কিন্তু ওরা এত দ্রুত কথা বলছিল, এক সাথে তিনজন, কেউ কারোটা শুনছিল না, ফলে আমিও কিছুই বুঝতে পারলাম না। ইশারায় দোকানের ছেলেটাকে বললাম তিন কাপ চা ওদের দিয়ে আসতে। ওরা চা খেয়ে ঝগড়া করতে করতেই কলেজের দিকে চলে গেল, যাবার আগে রুমা একবার বলে গেল – “চায়ের জন্য থ্যাঙ্কস, ঝগড়ার সময় চা না হলে ঝগড়া জমেই না”। কি আজব মেয়ে রে বাবা। এতদিন জানতাম চা ছাড়া আড্ডা জমেনা, এখন দেখি ঝগড়াও জমেনা।


সাদামাটা রঙচটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আমার জীবনটা এরপর কিভাবে যেন পালটে গেল, জানেন। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী পালটায়, মানুষও পালটে যেতে থাকে। মেয়েদের সাথে মিশতে যে দ্বিধাটুকু ছিল, এই তিনটা সদা উচ্ছল মেয়ে সে দ্বিধাটা একেবারেই কাটিয়ে দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠলো। রোজ বিকেলে ওদের সাথে দেখা না হলে ভাল লাগতোনা। অবশ্য আমার বন্ধুবান্ধব হাসাহাসি করতো। বলতো আমার মত ছেলেই না কি মেয়েরা খোঁজে, আমি কথা বলি কম, শুনি বেশী, ওরা কথা বলে বেশী, শুনতে চায়না কিছুই। আমার কিন্তু ভাল লাগে ওদের কথা শুনতে। প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভরা মেয়েগুলোর আশে পাশে যে থাকবে, তার মন খারাপ করে থাকার কোন উপায়ই নেই। তবুও মাঝে মাঝে কেমন যেন একটা শুন্যতা অনুভব করতাম। একটা বয়সে সব ছেলেরাই বোধ হয় এমনটা অনুভব করে। খুব ইচ্ছে করতো –কোমল একটা হাত আলতো করে ধরে রাখি, দিঘীর জলের মত শান্ত এক জোড়া চোখে আকাশের প্রতিচ্ছবি দেখি, মেলা থেকে নীল চুরি, নীল টিপ কিনে দেই। কিন্তু আমার এই শুন্যতাকে পূরণ করবে কে? সে কি জন্মেছে এই পৃথিবীতে?

না, সে এই পৃথিবীর কেউ না। জন্ম তার পরীদের রাজ্যে। ভুল করে যেন নেমে এসেছিল ধুলোমাখা পৃথিবীতে, আনমনে, খেলার ছলে। সোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় পরীক্ষার হলে। ও ছিল কমার্সের তুখোড় ছাত্রী। এক সাথেই সিট পরেছিল আমাদের। পরীক্ষার হলেও ওকে ঘিরে ছিল একটা জটলা। যেন সবার পরীক্ষা পাশের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে সে, গোটা হলটা আলো করে। একই কলেজে পড়ি, অথচ ওকে দেখিনি কোনদিন। সেদিনের পরীক্ষায় কি লিখেছিলাম মনে নেই। কিন্তু তার পরের চারটা পরীক্ষাতে যে কিছুই লিখিনি, সেটা বেশ মনে আছে। কি করে লিখবো? আমি ছিলাম এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। চোখের সামনে সারাক্ষণই সোমাকে দেখতে পাই, চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাই। পড়তে পারিনি একটা অক্ষরও, লিখবো কি আমি? পরীক্ষার হলে গেছি শুধু সোমাকে দেখতে। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। এখনও মনে হলে হাসি পায়।

পরীক্ষার চারটা দিন কেটে গেল। কিন্তু হাজার ছাত্রছাত্রীর মাঝেও আমি সোমাকে ঠিকই দেখে ফেলি, কখন ও কলেজে আসে, কখন বেরিয়ে যায়। বন্ধুরা যথারীতি ধরে ফেললো আমার উথাল পাতাল অবস্থা। আমার সব চাইতে কাছের বন্ধু সজীব একদিন চা খেতে ডেকে নিয়ে এই প্রসঙ্গ তুললো, হয়তো অন্যরা ওকে সেই দায়িত্বটা দিয়েছিল। সেদিন জানলাম সোমা বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল একটা ছেলেকে। ছেলেটা ড্রাগ নিত, সোমা বিয়ের পর জানতে পারে। ছয় মাসের মাথায় সে তাই ফিরে এসেছিল বাবার বাড়ীতে। সজীব সাবধান করে দেয়, ওর দিকে এখনও কেউ আগ্রহী হলে ওর স্বামী সেই ছেলেকে শায়েস্তা করে। কোন ছেলের সাথে তাই সোমাকে গল্প করতেও দেখা যায়না। শুনে আমি হেসেছিলাম শুধু। প্রেম এমন একটা আজব অনুভূতি, যেখানে মানুষ অন্ধকারে আলো দেখা পতঙ্গের মত মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আত্মাহুতি দেয়।

বন্ধুরা অবশ্য একটা বিষয় এপ্রিশিয়েট করেছিল। আমি না কি সাব হিউম্যান স্পিশিজ থেকে হিউম্যানে পরিণত হচ্ছি। যেটাই হোক না কেন, আমার তখন প্রতিটা দিন কাটতো সোমাকে কল্পনা করে। কিন্তু ওর সাথে পরিচিত হবার কোন উপায় দেখছিলাম না। সুযোগটা এলো কলেজের একটা অনুষ্ঠানের দিন। সেদিন সন্ধ্যের পর অনুষ্ঠান শেষে মেয়েদের গ্রুপ করে করে বাড়ী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হলো আমাদের। সোমা যে গ্রুপে যাবে, আমার কয়েকজন বন্ধু যাচ্ছে তাদের পৌঁছে দিতে। আমাকেও ডেকে নিলো ওরা, হয়তো ইচ্ছে করেই। মেয়েগুলোকে সামনে দিয়ে আমরা হেটে যাচ্ছি, টুকটাক কথা হচ্ছে ওদের সাথে। আমি যথারীতি চুপচাপ। এমন সময় একটা মেয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো – এই যে কবি সাহেব, আপনি কি কথা বলতে পারেন? আকাশ থেকে পড়ার মত অবাক হলাম, আমি আর কবি? জীবনে এক লাইন কবিতা লিখিনি আমি। বিস্ময় গোপন করে হেসে বললাম – না তো, পারিনা। সবাই ছেঁকে ধরলো আমাকে, তুই কবিতা লিখিস? আমি এদিক ওদিক মাথা নাড়াই। জানা গেল মেয়েরা অনেকেই আমাকে কবি ভাবে, কম কথা বলি দেখে। যাহ বাবা, আমাকে নিয়েও মেয়েরা আলোচনা করে তাহলে।

সেদিন অবশ্য কোন কথা হয়নি সোমার সাথে। কিন্তু এরপর থেকে ওদের আড্ডার আশে পাশে গেলে কুশল বিনিময় হতো, মাঝে মাঝে আড্ডাও। এভাবেই জেনে গেলাম আমার সাথে সোমার অনেক ব্যাপারে পছন্দের মিল আছে। আমার কালেকশনে কিছু গান ছিল, সোমার সেই গানগুলো দরকার। বললাম, আমি কপি করে দেবো ক্যাসেটে। খুব যত্ন করে কপিটা করলাম। সাথে আরও কিছু সুন্দর গান সাথে দিয়ে দিলাম। ভালবাসায় ভরা প্রতিটা গান, আমি তো তখন যাকে বলে ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ক্লাস শেষে সোমাকে দিতে গেলাম ক্যাসেটটা। সে ক্যাসেটটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে হেটে চলে গেল। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন, জানেন। ভদ্রতা করে কি কিছুটা সময় আমার সাথে কাটাতে পারলোনা মেয়েটা? আরও কিছু কথা বলতে পারলোনা? না হয় গান নিয়েই কথা হতো কিছুক্ষণ।

দুদিন পর লাইব্রেরীতে বসে নোট করছি, সোমা এসে পাশের চেয়ারটায় বসলো। ব্যাগ থেকে একটা ক্যাসেট বের করে দিয়ে বললো – “এটা তোমার জন্য। সুমনের রবীন্দ্র সঙ্গীত, আমার খুব প্রিয়”। স্যরি বললো ওর সেদিনের ব্যাবহারের জন্য। বললো ওর মনটা অনেক খারাপ ছিল সেদিন। অনেক কথা হলো সোমার সাথে। ওর বাড়ী যাবার সময় হলে আমরা একসাথে বেড়িয়ে এলাম লাইব্রেরী থেকে। পাশের ক্যান্টিনে চা খাবার সময় আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এসে জুটলো। খুব সুন্দর একটা বিকেল কাটিয়ে ফিরে এলাম হোস্টেলে।

তার পর দিন কলেজ ছুটি ছিল। সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম। নাস্তা করে কলেজের মোড়ে গেলাম চা খেতে। এমন সময় চার পাঁচটা মটর বাইক এসে থামল আমার পাশে। বেশ কয়েকটা ছেলে নেমে এসে ঘিরে ধরলো আমাকে। ওরা শকুনের মত তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে বললো – “তুই জানসনা যে সোমার দিকে তাকানো নিষেধ আছে? যে তাকায় হ্যার চোখ আমরা তুইলা নেই”। আমি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। ওরা কয়েকজন মিলে আমাকে নানা রকম ভাবে গালিগালাজ করতে থাকে। হটাত এক সময় টের পাই যে আমাদের চারপাশে আরও অনেক মানুষ। হোস্টেলের প্রায় সবাই এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমাদের। পরিচিত মুখগুলো চারপাশে দেখতে ভয়টা কেটে যেতে থাকে। এমন সময় ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ায় রিপন ভাই, আমাদের কলেজের বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। এই এলাকায় উনার একচ্ছত্র আধিপত্য। উনি এসে সামনের ছেলে গুলোকে লক্ষ্য করে খুব শান্ত ভাবে বললেন যেন এই এলাকায় ওদের মুখ আর না দেখা যায়। এরপর আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন – এইটা আমার ছোট ভাই, ওর যা ইচ্ছে ও তাই করবে, এই শহরে কেউ ওর কোন ক্ষতি করবার চেষ্টা করলে, তাকে নিজে ট্যাকেল করবো। ছেলেগুলো মাথা নিচু করে চলে গেল। রিপন ভাইয়ের ক্ষমতা অনেক, সেটা সবাই জানে। ওরা চলে গেলে রিপন ভাই আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটু সাবধানে চলার পরামর্শ দিলেন, আর দুষ্টুমি করে বললেন – “মিয়া, কলেজে এত সুন্দরী মেয়ে থাকতে তোমার সোমাকেই পছন্দ হলো? যা হোক, চালায় যাও, কোন সমস্যা হলে আমাকে জানিও”। আমি মনে মনে বললাম – চালিয়ে যাবার মত তো কিছুই এখনও হলোনা ভাইয়া। মুখে কিছু বললামনা, শুধু হাসলাম।

নার্স মেয়েটা এসে অভ্যস্ত হাতে ইনজেকশন দিয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করছিলাম, চোয়াল শিথিল হয়ে এলো আস্তে আস্তে। বুঝতে পারছি ঘুমিয়ে পড়ছি আমি। আহ্‌ ... ঘুম, শান্তির ঘুম। কবে যে চির শান্তির ঘুম ঘুমোবো, এই কষ্ট আর সহ্য হয়না। মাথার ভেতর দানা বেধে থাকা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের পিণ্ডটা আমার সমস্ত জীবনটা এলোমেলো করে দিলো। সব কিছু কেড়ে নিলো আমার কাছ থেকে। সব কিছুই। এখন শুধু এই যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকা। মুক্তির উপায় জানা নেই।

যা হোক, পরদিন সোমা কলেজে এসেই জেনে গেছিল ঘটনাটা। এরপরের কয়েকদিন আমার আশে পাশেই আসেনি সে। হয়তো লজ্জায় অথবা আমার ক্ষতি হতে দিতে না চাওয়ায়। আমিও কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বন্ধু বান্ধব আর সিনিয়রদের কাছ থেকে ক্রমাগত না না ধরনের কথা শুনতে হচ্ছিলো। কেউ কেউ বলছিলেন যে ওই ছেলেটার দোষ। যে মেয়েটা ভালবেসে ওর হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল, তাকে সে নুন্যতম সম্মান দিতে পারেনি। না হলে একটা মেয়ে এত সহজে ঘর ছাড়েনা। আবার এখন সেই ছেলে এসেছে মাস্তানি দেখাতে। অনেকে আবার বলছিল যে আমারই ভুল। আমি কেন সব জেনে শুনেও সোমার সাথে মিশতে গেলাম। সব কথাই আমার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমার কিছুই করার ছিলনা সেই সময়। ভালবাসার প্রথম সময়টা মানুষকে অনেক বেশী দুর্বল আর অসহায় করে দেয়। স্বাভাবিক চিন্তার অবকাশ থাকেনা তখন। চোখের সামনে সব সময় ভালবাসার মানুষটার মুখ ঘুরতে থাকে। অকারণে মন ভাল হয়ে যায়, অকারণেই মেঘ ছেয়ে যায় মনের আকাশে।

আবার একটা রোদ ঝকমকে বিকেলে ওকে পাশে পাই। সেই ঘটনা নিয়ে সেও কিছু বলেনা, আমিও না। আমার কেমন যেন অসস্থি লাগে। মনে হয় সোমা যদি দেখে ফেলে আমার বুকের মধ্যে আলোর নাচনটা! কিছুক্ষণ অপ্রাসঙ্গিক এলোমেলো কথা বলার পর স্বাভাবিক হয়ে যাই দুজনেই। একটু পরে আড্ডায় যোগ দেয় আরও কিছু বন্ধু। অনেকদিন পর ফুরফুরে একটা মন নিয়ে ঘরে ফিরি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মনটা ছেয়ে যায় বিষাদে। আমি চাই, আমি সোমাকে চাই, ভালবাসতে চাই, ভালবাসা পেতে চাই। একবার মনে হয় ওকে একটা চিঠি লিখি। নিজেই হেসে ফেলি আবার। বড্ড হাস্যকর মনে হয় লাভ লেটার লেখার ধারণাটা। ওকে বলবো কিভাবে? সেটাও সম্ভব না। ভালবাসা এমন একটা জিনিস, যেটা লুকিয়ে রাখা যায়না। যাকে ভালবাসি, সে কোন না কোন ভাবে সেটা বুঝে ফেলবেই। এর জন্য ঘটা করে প্রস্তাবনা পেশ করবার কিছু নেই। ও যদি কোন দিন বুঝে যায়, নিজে থেকেই আমাকে বুঝিয়ে দেবে সে আমাকে ভাল বাসে কি না। তবে এভাবেই চলুক, সিদ্ধান্তটা নিয়ে হালকা লাগে নিজেকে। মনের সুখে একটা সিগারেট ধরাই।

ঈদের ছুটি হয়ে যায় এর পরের সপ্তাহে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছেলে মেয়েরা যে যার বাড়ী চলে যায়। আমি থেকে যাই হোস্টেলে। বাবা তখন সিলেটে, ওখানে যেতে আসতেই দুদিন করে সময় লাগে। ঈদের পরেই আবার পরীক্ষা। তাই হোস্টেলে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। আসলে ছোটবেলা থেকে বাড়ীর বাইরে আমি। পরিবারের সাথে থাকার অনুভূতিগুলো আমার মাঝে কমই কাজ করে। হোস্টেলের এই স্বাধীন জীবনেই অভ্যস্ত আমি। কিন্তু ... মিথ্যে বলবো না, সোমার কাছাকাছি থাকার একটা অনুভূতি অবশ্যই কাজ করেছিল সে সময়ে। কোথায় যেন পড়েছিলাম – যে রিক্সায় চড়ে প্রেমিকা স্কুলে যায়, প্রেমিকের ইচ্ছে করে সেই রিকশাওয়ালাকে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করতে। হাস্যকর ইচ্ছে, কৌতুক অর্থে বলা অবশ্যই। কিন্তু ভালবাসাটা তো একটা পাগলামোই।

ঈদের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে এলাকার কয়েকজনের ডাকে। ওরা আমাকে নিতে এসেছে নামাজ পড়তে যাবে বলে। ঈদের নামাজ পড়বো কি না সে ব্যাপারে অলসতাটুকু ঝেড়ে ফেলি। মানুষের ভালবাসা অগ্রাহ্য করতে নেই। ঈদগায় গিয়ে দেখি জুম্মাঘরের পরিচিত মাঠটাকে লাল নীল ঝালর দিয়ে ওরা সাজিয়েছে। খুব সাধারণ ভাবে সাজানো ময়দানটাই যেন ঝলমল করছে আনন্দে। ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে চারিদিকে। একেই বোধহয় উৎসব বলে। শহরের বড় বড় ঈদগায় এই আনন্দ দেখিনি কখনও। বড় ভাল লাগে আমার, ঈদের দিনটা শুরু হয় সুন্দরভাবে।

নামাজের পর পরিচিত কয়েকজনের বাসায় যেতে হয়। সেমাই আর মিষ্টি খেয়ে পেট ভরে যায়। এমন সময় শহরের কয়েকজন বন্ধু আসে বাইক নিয়ে। ওদের সাথে ঘুরতে যেতে বলে। কেন যেন ইচ্ছে করেনা যেতে। পড়ার কথা বলে ঘরে ফিরে আসি। কিন্তু বই খুলে বসার বদলে বিছানায় শুয়ে পড়ি। বিকেলের দিকে আবার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসে। ওদের সাথে যাব কি না ভাবতে ভাবতে এক সময় বেড়িয়ে পড়ি। অনেক মজা হয় সারাটা বিকেল, সন্ধ্যে। রাতের বেলা এক বন্ধুর বাসায় খেয়ে ঘরে ফিরবো, মানে হোস্টেলে আমার রুমে, এমন সময় প্রথম বারের মত মাথা ব্যথাটা আরম্ভ হয়। ঘরে ফিরে এসে গোসল করে শুয়ে পড়ি, কিন্তু ব্যথায় ঘুমোতে পারিনা। ক্রমেই ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল। এক সময় দুটো পেইন কিলার খেয়ে নেই, ব্যথা কমেনা। মাঝ রাতের দিকে যখন ব্যথাটা অসহ্য হয়ে যায়, তখন কোন রকমে উঠে গিয়ে নীচের কয়েন বক্স ফোন থেকে বাঁধনকে ফোন করি। তারপরে আর ঘরে ফিরে আসতেও পারিনি। বাঁধনরা এসে আমাকে পায় দোতালার সিঁড়ির কাছে। সেখান থেকে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যায়।

সেই বার হাসপাতালে ছিলাম কয়েকদিন। ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারেননি। শুধু ব্যথার ওষুধ দিয়ে আধা অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখেছিলেন আমাকে। এর মাঝে সোমা প্রতিদিন একবার আসতো। বাকি সময়টা সুখ স্মৃতি কল্পনায় কাটিয়ে দিতাম। একদিন সকাল থেকেই আমার বাম হাতটায় জোর পাচ্ছিলামনা। পানির গ্লাসটা নিতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দিলাম। বুঝলাম কোন একটা সমস্যা হয়েছে। ইশারায় নার্সকে ডাকার পর উনি এসে কিছুক্ষণ হাতটা মালিশ করলেন। কিন্তু আমি কোন পার্থক্য দেখলাম না। পরে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন উনি। ডাক্তার শুধু – এটা কিছু না, ভাল হয়ে যাবে গোছের একটা মন্তব্য করে চলে গেলেন। এদিকে আমার হাতে তখন একেবারেই জোর নেই। মনে হচ্ছে এটা আমার হাত নয়। বিকেলে সোমা এলে বাঁধন বলে দিল যে আমি হাতে জোর পাচ্ছিনা। কেন যেন সেদিন সোমা ওর হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার দিকে। মুখে বলেছিল – হাতটা ধরো তো।

নাটক সিনেমায় এমন হলে দেখা যেত নায়ক প্রচণ্ড কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত নায়িকার হাতটা ধরতে পারলো, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এমন কিছুই হলো না। আমি পারিনি সেদিন সোমার হাত ধরতে।

সোমা ছুটে বের হয়ে গেছিল সেদিন ঘর থেকে। মেয়েরা তাদের চোখের জল সবাইকে দেখাতে চায় না। এত অসহায় লাগছিল তখন, জানেন। একটু পরে নার্স এলে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমার ভাল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটুকু। নার্স কিছু বলতে পারেনি।
এরপর থেকে আমার জীবনটা বদলে যেতে থাকে। বাবা মা খবর পেয়ে এসে আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। সবার মুখ দেখে বুঝলাম যে রিপোর্ট ভাল না। একদিন ডাক্তার আমার বেডের পাশের টেবিলে সিটি স্ক্যান রিপোর্ট রেখে চলে গিয়েছিলেন। স্লাইডগুলো দেখে যা বোঝার বুঝে গেলাম আমি। আমার মাথার ভেতর দানা বেঁধেছে ছোট্ট একটা টিউমার। স্ক্যান রিপোর্টে লাল দাগ দেয়া সেই চিহ্নটাই আমার বেঁচে থাকার সময় নির্ধারণ করে দিলো। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় ছাদ থেকে পড়ে যাবার ঘটনাটা। সে সময় দেশে এত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলনা। আমি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা অজ্ঞান ছিলাম। মাথা ফাটেনি, কিন্তু ইন্টারনাল ব্রেন হ্যামারেজ হয়েছিল। সেই রক্তটা রয়ে গেছিল ভেতরেই। টিউমারের কারণ সেটাই।
বাবা তার গ্রামের জায়গা সম্পত্তি বিক্রি করে আমাকে নিয়ে এলেন সিঙ্গাপুরে। অনেক রকম ট্রিটমেন্ট করা হলো আমার। এর মাঝেই ডাক্তার একদিন বুঝিয়ে দিলেন যে টিউমারটা অপারেশন করে ফেলে দেবার উপায় নাই। মগজের এত ভেতরে চলে গেছে ওটা, যে অপারেশন সফল হবার সম্ভাবনা খুব কম। এভাবে থাকতে থাকতে একসময় শেষ হয়ে যাবো আমি। সময় বেঁধে দিলেন নয় মাসের মত।
নিজেকে ফাঁসির আসামীর মত লাগে এখন, যে জানে কবে তার ফাঁসি হবে। একটা একটা করে সেকেন্ড চলে যায়, আমি একটু একটু করে এগিয়ে যাই মৃত্যুর দিকে। সিঙ্গাপুরে আসার কিছুদিন পর আমার চোখের আলোটাও নিভে গেল। সেদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি সব অন্ধকার। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম হাসপাতালে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল না কি। তারপর বুঝলাম যে আমি কিছু দেখতে পারছিনা। চিৎকার করে কেঁদেছিলাম সেই দিন, এই প্রথম। মরে যাবার কষ্ট আর আতঙ্কটার চাইতেও কিছু দেখতে না পাবার কষ্টটা বেশী অনুভব করেছিলাম। সব চাইতে বেশী দেখতে ইচ্ছে করতো মা'কে। মা অবশ্য এসেছিলেন কয়েকদিন পড়েই, আমাকে জডিয়ে ধরে সে কি কান্না তার। কষ্টের একটা পর্যায় আছে, যখন মানুষ কাঁদতেও ভুলে যায়, আমার তখন তেমন অবস্থা। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। মা'র সেই কান্না আমাকে স্পর্শ করছিলোনা। ভাবছিলাম - আমি চলে গেলেও মা এভাবে কিছুদিন কাঁদবেন, এক সময় সে কান্নাও থেমে যাবে। আস্তে আস্তে সয়ে নেবেন কষ্টটা। ব্যস্ত হয়ে যাবেন দৈনন্দিন জীবনে। এছাড়া উপায় কি? কিন্তু উনি তো আমার মা। গভীর রাতে, হয়তো সবার অজান্তে বালিশে মুখ ঢেকে কাঁদবেন অনেক দিন। যত দিন না মা আমার কাছে চলে আসেন। আমি মনে মনে মা'র দ্রুত মৃত্যু কামনা করতাম। এখনও করি।

সোমার সাথে যোগাযোগ ছিল বেশ কিছুদিন। চিঠি লিখত খুব সুন্দর করে। কি সব আবেগী কথা, কত দুষ্টুমি। আমি জানতাম লেখার আগে পড়ে কেঁদে আকুল হতো সে। সিঙ্গাপুরে আসার আগের দিন এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। বলেছিল - আমি জানি তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। কেন যেন হেসে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম - তুমি জানতে? বলে - "হু, আমরা মেয়েরা আগেভাগেই অনেক কিছু টের পাই। পরীক্ষার হলে তোমাকে বার বার আমার দিকে তাকাতে দেখেই বুঝেছিলাম যে আরও একটা উপদ্রব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমি নিজে কখন তোমাকে ফলো করতে শুরু করেছিলাম বুঝতে পারিনি। কলেজে এসে তোমাকে খুঁজতাম। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি, নিজেকে বুঝিয়েছি এটা ঠিক না। এক সময় হেরে গিয়ে সব ছেড়ে দিয়েছি সময়ের হাতে। জীবন তার নিজস্ব গতিতে চলে। মানুষ জীবনের রাশ টেনে ধরে ভাবে সে তার জীবনের গতিটাকে বদলে ফেলেছে। আসলে সেটাই জীবনের গন্তব্য ছিল। আমরা সব খেলার পুতুল। আমি যখন একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম তোমার ওপর, সে সময়েই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে। আমি যে কি কষ্ট পেয়েছিলাম। মনের মাঝে যেটুকু দ্বিধা ছিল, এক নিমিষে কেটে গিয়ে বুঝেছিলাম তোমাকে কত ভালবাসি। আর তুমি কত খারাপ, আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরতে পারলেনা সেদিন।"

হেসে ফেলেছিলাম সেদিনও। সোমা আমার হাতটা নিয়ে খেলা করছিল অনেকক্ষন, আমি কিছুই অনুভব করিনি। শুধু দেখছিলাম। ভালবাসার সার্থকতাকে যারা বিয়ে বলে মনে করেন, তারা ভুল করেন। ভালবাসা ভালবাসাই। সেটা একতরফা হোক অথবা দুতরফা। কাউকে মন থেকে ভালবাসতে পারাটাই ভালবাসার সার্থকতা। না হয় এই জীবনে আমার সোমাকে পাওয়া হলো না। কিন্তু মরে গিয়েও আমার চেতনাটা, আমার আত্মাটা যদি বেঁচে থাকে, তখনও আমি সোমার কথা ভাববো। জানবো সোমা নামের এই অসাধারণ রূপবতী মেয়েটি আমাকে অনেক ভালবাসত।

এখন আমার জীবন এই অন্ধকার ঘরের চার দেয়ালে বন্দি। ঘড়ির কাটার নিরন্তর টিক টিক শব্দটাই আমার সব চাইতে আপন। একটা একটা করে টিক টিক শব্দ করে সে জানিয়ে দিচ্ছে তোমার চলে যাবার সময় এগিয়ে আসছে, তৈরি হও। সবাইকেই এভাবে চলে যেতে হয়, চলে যেতে হবে। কেউ থাকেনি, থাকবেওনা এই পৃথিবীতে। শুধু রয়ে যাবে একরাশ মায়া আর মায়া ভরা স্মৃতিগুলো। রয়ে যাবে শত সহস্র ভালবাসার জানা অজানা কাহিনী।

একটা গান শুনতে খুব ভাল লাগে আজকাল। অনেক সময় শুনতে শুনতে কাঁদি, একা একাই ...

আমি তোমায় না দেখি
তুমি আমার না হও
আমি যত দূরে যাই
তুমি কাছে রও

আমি স্বপ্নে তোমায় দেখি
ঘুমিয়ে যখন রই
স্মৃতিতে এসো তুমি
যদি দিশেহারা হই
একা হয়ে যাই আমি
স্বপ্ন স্মৃতি ছাড়া
তুমি ছাড়া মনে হয়
আমি তো আমি নই
-------------------------------------------------O---------------------------------------------------



~স্বপ্নজয়~

ফেসবুক আইডিঃ জয় কবির

No comments:

Post a Comment