Subscribe:

শঙ্খচূড় - তৃতীয় পর্ব "ক"

রশিদের চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে খায়রুল আনাম পত্রিকা পড়ছে সকাল বেলা। দশটার মত বাজে। রোদটা এর মধ্যেই চরিয়ে উঠেছে বেশ। ছাউনির নিচে বেঞ্চে দুই পা তুলে আয়েশ করে বসে মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছে সে। দোকানে রশিদ মিয়া ছাড়া আর কেউ নেই। সামনের দোকান পাটগুলোতেও তেমন একটা লোকজন নেই। সবাই গমিতে আছে এখন। বিকাল দিকে বাজার গরম হয় এখানে। সকালে ঘুমিয়ে থাকার মতই অবস্থা।
“কিরে বেটা, কাগজে আজকা কি খবর দিছে? এত ধিয়ান দিয়া পড়তেছো যে?” আরেক কাপ চা বানাতে বানাতে রশিদ মিয়া খায়রুল আনামকে জিজ্ঞেস করল।

পত্রিকা থেকে মুখ না তুলেই বলল সে, “আর বইলেন না চাচা, মার্শাল ’ল দেওয়ার পর থেকে আইয়ুব খান যে আসলে কি করবার চাইতেছে বুঝতেছি না! পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষা করার জন্য বাংলা আর উর্দূ মিলাইয়া একটা খিচুড়ি ভাষা বানাইতে চেষ্টা করতেছে সামরিক শাসন জারী করার পর থেইকাই। সেটা আবার কি রকম? রোমান হরফে বাঙলা! পুরা তুঘলকি কারবার!”
“বুঝলাম না! ভাষা পাল্টায়া লাভ কি?”
“লাভ লোকসান যদি বুঝতেন, তাইলে তো হয়েই যাইত। ডাকসুর সম্পাদক মোঃ ফজলী হোসেনের একটা বড় লেখা ছাপাইছে। দাঁড়ান, পড়ে শুনাই। তাইলে বুঝবেন। আমাদের সাহিত্য পর্যন্ত নিয়া টান মারছে বদের দল!” নাকের পাটা ফুলে উঠল তার। গলা খাকারি দিয়ে আবৃতির মত করে পড়ে শোনাতে লাগল লেখাটা-
“....... প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মনে করেন যে উর্দূ অথবা বাঙলা কোনোটাই একক ভাবে সমগ্র পাকিস্তানের ভাষা হতে পারে না। এই সমস্যার সমাধানে তিনি একটি জাতীয় মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার মতে, “এই ধরণের একটি মাধ্যম উদ্ভব হলে আমাদেরকে বাঙলা ও উর্দূর মধ্যেকার সাধারণ উপাদানগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলোকে একটি মাত্র সাধারণ লিখন রীতির মাধ্যমে একত্রে বর্ধিত হতে দিতে হবে।”
প্রেসিডেন্টের এই দর্শনকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে শরীফ শিক্ষা কমিশন ও বাঙলা একাডেমী, রোমান হরফ প্রবর্তন, বাঙলা বর্ণমালা সংষ্কার, বাঙলা-উর্দূ ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে বাধ্যতামূলক শিক্ষা ইত্যাদি কতকগুলি তোঘলকি পরিকল্পনা গ্রহণ শুরু করেছে। এসব করতে গিয়ে চতুর পরিকল্পনাবিদরা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যকেও সংষ্কার শুরু করে দিয়েছেন। কবি নজরুলের বিখ্যাত কবিতা “চল চল চল” – এর “নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশ্মশান” চরণ আংশিক সংশোধন করে তাঁরা লিখেছেন, “সজীব করিব গোরস্থান”। এছাড়াও জনপ্রিয় ছড়া,
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।”
এটিও সংশোধিত করে মুসলমানী আরোপিত হয়ে পুনঃলিখিত হয়েছে এভাবে-
“ফযরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি,
সারা দিন আমি যেন নেক হয়ে চলি।”
খায়রুল আনাম তিক্ত কন্ঠে বলল, “কাজী নজরুল ইসলাম বাঁইচা থাকতেই এই কান্ড! আল্লায় জানে উনি মরার পর আরো কি হয়!”
রশিদ মিয়া কিছু না বুঝেই মাথা ঝাঁকাল যেন সব বুঝেছে। খানিক বাদে শমসের এসে যোগ হল খায়রুল আনামের সঙ্গে পত্রিকা পড়ায়। শুরু হল দুজনে মিলে রাজনৈতিক আলাপ। হাফিজ চাচাও এসে বসলেন ওদের সঙ্গে। গল্প জুড়ে দিলেন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আর তাঁর নানান অযৌক্তিক কাজ কারবার নিয়ে। দেখতে দেখতে ছোট্ট দোকানটা অন্যান্য দিনের মত আজও মানুষজনে ভরে উঠল। এখানে প্রতিদিন একটা ইংরেজী ও একটা বাংলা পত্রিকা আসে। ইংরেজী পত্রিকার প্রতি কারো তেমন আগ্রহ নেই খায়রুল আনাম ছাড়া, সবার আগ্রহ বাংলা পত্রিকাটার দিকে। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে শোনাতে হয় খায়রুল আনাম নয়তো শমসেরকে। দুজনেই ভাল পড়ে শোনাতে পারে। আজও আর সবদিনের মত আইয়ুব খানের মার্শাল ’ল আর অন্যান্য সংষ্কৃতি বিরোধী কাজ কারবার নিয়ে আলোচনা গরম হতে লাগল। কম বয়সীরা সংষ্কৃতির টানা হেচড়া নিয়ে ক্ষুব্ধ সবদিনের মত, বড়রা ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে। সূর্য চড়ার সঙ্গে সঙ্গে করে আলোচনাও চড়তে লাগল।
এখানে পাঠকদের জন্য অল্প কথায় জানিয়ে দিচ্ছিঃ
আইয়ুব খানের মার্শাল ’ল জারী করার এক বছরের মধ্যেই ভাষা, সাহিত্য- সংষ্কৃতির মধ্যে নানান পরিবর্তন আনার অপচেষ্টা করা হয়। বিখ্যাত কিছু কবিতা ও কাব্য গ্রন্থে নানাবিধ বিকৃতি ঘটানো হয়েছিল। একই সঙ্গে এ সময় (১৯৫৯) ছাত্র ছাত্রীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও তথাকথিত মুসলমানী আনার চেষ্টা করা হয়। যে সমস্ত ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাশ করতে গিয়ে কপালে টিপ দিয়ে যেত তাদের বহিষ্কার করা হতে থাকল।
এসব প্রক্রিয়া যেহেতু শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সাল থেকে, এ কারণে সে সময়েই ছাত্র ও বুদ্ধিজীবি মহল থেকে এই বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। ১৯৫৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠন সমূহের একুশের সম্মিলিত অনুষ্ঠানে ডঃ মোঃ শহীদুল্লাহ সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে রোমান হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাবসহ অন্যান্য সংষ্কার সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখান করেন। ছাত্ররা সম্মিলিত ভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, এই ধরণের প্রয়াস তাঁরা মেনে নেবে না।
সামরিক শাসন ও তার প্রণেতার প্রতি ছাত্রদের মোহ থাকতে থাকতেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় UOTC – এর ক্যাডেটরা তাকে গার্ড অব অনার দেয়। এখানে তাকে দেখতে আসা সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি এক বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, “আপনাদের চোখে চোখে আমি দেশ প্রেম জ্বল জ্বল করতে দেখছি।”
বস্তুত ছাত্রদের মধ্যে দেশ প্রেমের অগ্নিশিখা সত্যি জ্বল জ্বল করছিল সেদিন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তা প্রবল আকার ধারণ করে বিস্ফোরিত হয়। জ্বল জ্বলে চোখের সেই ছাত্রগুলো আইয়ুব খানকে হয়ত ভেতরে ভেতরে বেশ খানিকটা শংকিত করে তুলেছিল, সেই সঙ্গে কাঁপিয়ে দিয়েছিল সমগ্র সামরিক শাসনের ভিতকেই।
সামরিক শাসন জারীর পরবর্তী কিছুদিন বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) রাজনীতি অনেকের মতেই কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল বলে ধারণা। আগ্নেয়গিরিতে অগ্নুৎপাতের পূর্বের কিছুদিন সুপ্ত দশা থেকে জেগে ওঠার পর্যায়কাল চলে। এদেশের ছাত্র সমাজের ওপর নানান দিক থেকে কিছু অযৌক্তিক নিয়াম নীতি চাপিয়ে দিয়ে এবং বাংলা সাহিত্যের বিকৃতি ঘটানোর অপচেষ্টাগুলো করে সে সময়ের সামরিক শাসকরা নিজেদের অজান্তেই পরবর্তী সময়ের গণঅভ্যুত্থানের দিকে ক্রমশ ঠেলতে শুরু করেছিল এদেশের মানুষকে।
উপন্যাসের কাহিনীর সঙ্গে যদিও এর কোনো সম্পর্ক নেই, তবুও সে সময়ের এসব খুঁটি নাটি ছোট খাট ব্যাপারগুলো উল্লেখ করলাম। অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু মনে হল ১৯৫২ এর পরও আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর যে একটা সময় ধাক্কা এসেছিল- এটা অনেকেই জানেন না। একজন ক্ষুদ্র লেখক হিসেবে ব্যপারটা আপনাদের জানানো কর্তব্য মনে করেছি।


হাজী খামির উদ্দিন কুয়া পাড়ে দাঁড়িয়ে যোহরের নামাযের জন্য ওযু করছিলেন। পাশেই জয়গুন্নেছা গামছা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। স্বামীর ওযু করা দেখছেন।
হঠাৎ নজল আলী দৌড়ে উঠানে ঢুকল। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজল যেন। খামির উদ্দিনকে কুয়া পাড়ে দেখে দৌড়ে এল, উত্তেজিত কন্ঠে হড়বড়িয়ে বলে ঊঠল, “বড় আব্বা! সুলতান শিকদারের লোকজন মাঝ গেরামের আমাগো জমিতে বেড়া দিতেছে! পিলার গাইরা তাঁরকাঁটা দিয়া! আপনে শিগগির চলেন!”
ঝট করে মুখ তুললেন খামির উদ্দিন। মুখের একটা পেশিও কাঁপল না। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, গম্ভীর গলায় ডাকলেন, “সুলেমান?”
সঙ্গে সঙ্গে সুলেমান দৌড়ে এল কুয়া পাড়ে। হাতে লাঠি।
“সুলতান শিকদারের পা লম্বা হইছে বেশি। কাটে ফেলা দরকার।” বিড়বিড় করলেন। জয়গুন্নেছার হাত থেকে গামছাটা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “সুলতানের লোকজন নাকি মাঝ গ্রামে আমাদের জমিতে বেড়া বসাইতেছে। লাঠিয়াল নিয়া প্রস্তুত হও। আমি যাবো। তবে আমার হুকুম ছাড়া কোনো কিছু করবা না।” গামছাটা জয়গুন্নেছার হাতে দিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। সুলেমান দৌড়ে চলে গেল তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে আসতে। নজল আলী দৌড়ে আস্তাবলে গেল, হাজী সাহেবের ঘোড়া বের করতে হবে।
হাজী খামির উদ্দিন গায়ে পাঞ্জাবী চরিয়ে, কাঁধে চাদর ফেললেন এক পাশে। মাথায় জালের টুপিটা দিয়ে আলমারীর তাকে রাখা কোরআন শরীফটা দুহাতে নিয়ে চুমু খেলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ। বিড়বিড় করে কিছু বললেন। তারপর আগের জায়গায় কোরআন শরীফটা রেখে দিয়ে ছড়ি হাতে বেরিয়ে এলেন।
ঘোড়াতা উঠানে দাঁড় করিয়ে রাখা। সুলেমানের লাঠিয়াল বাহিনী এসে গেছে। একটা জায়নামায নিয়ে জয়গুন্নেছা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, স্বামীর কাছে এগিয়ে দিলেন ওটা। জায়নামাযটা নিয়ে ঘোড়ার পিঠে রাখলেন হাজী খামির উদ্দিন। সবার দিকে তাকালেন। গলা চরিয়ে বললেন, “আমার হুকুম ছাড়া কেউ কোনো কিচ্ছু করবা না, বুঝলা? আগে আমি কথা বলবো।”
বারান্দায় তাঁর বাকি দুই স্ত্রীও বেরিয়ে এসেছে। মাথায় ঘোমটা, স্বামীকে কিছু বলতে ভয় পাচ্ছেন। হাজী সাহেব ঘোড়ায় উঠে স্ত্রীদের দিকে ফিরে তাকালেন, “আমি যাইতেছি। তোমরা চিন্তা করবা না। আল্লাহ পাক আমাদের সঙ্গে আছেন।”
রহীমা খাতুন অনুচ্চ স্বরে কেবল বললেন, “সাবধানে থাকবেন। ফি আমানিল্লাহ।”
সাদা ঘোড়াটা সামনের দুই পা তুলে আকাশের দিকে মুখ করে ডেকে উঠল।


সূর্যটা মধ্য গগণ পুঁড়িয়ে দিচ্ছে নির্মম ভাবে। ধান কাটা ন্যাড়া মাঠগুলো খাঁ খাঁ করছে। হাজী খামির উদ্দিন ঘোড়ায় চড়ে লাঠিয়াল বাহিনীর সামনে সামনে এগোচ্ছেন। ঘোড়ার খুরের আঘাতে শুঁকনো মাঠে ধূলো উড়ছে।
দূরে দেখা যাচ্ছে অনেক লোকজন সিমেন্টের খুঁটি আর কাঁটাতাঁর দিচ্ছে একটা জমিতে। আরেক পাশে ছাতা হাতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, লাঠি হাতে সাত আট জন লাঠিয়াল রয়েছে বোঝা যায়। কয়েকটা ঘোড়াও দেখা যাচ্ছে।
কাছাকাছি যেতেই স্পষ্ট হল। ছাতাগুলোর নিচে সুলতান শিকদার আর তার ছোট ভাই ইসমাইল শিকদার দাঁড়িয়ে লোকগুলোকে গলা উঁচিয়ে হুকুম দিচ্ছে কাজের। হাজী খামির উদ্দিন তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন গম্ভীর মুখে।
হাজী সাহেবকে দেখেই সুলতান শিকদারের মুখে ধূর্ত একটা হাসি ফুটল, “আরে! আমার সম্বুন্ধি সাহেব যে! কি সৌভাগ্য আমার। আসেন ভাই আসেন। এই কে আছিস, ওনারে ছাতা ধর, রোদ লাগতাছে তো!”
ঘোড়ার ওপর থেকেই থম থমে গলায় বললেন হাজী খামির উদ্দিন, “এই সব কি হইতেছে সুলতান? আমার জমিতে বেড়া বসাইতেছো কোন সাহসে?”
“ওমা ওমা! কি বলেন ভাই! জমি তো আপনার বোন, মানে আমার বিবির নামে! তার মানে মালিক তো আমিই। হাজার হোক বিবাহের স্মৃতি। স্বামী হিসাবে হলেও আমার জমিই হয় ভাই!”
“খবরদার, সালেহাকে তোমার বৌ বলবা না। তালাক আর দেন মোহরানার সাথে সাথে তোমার বাড়ি আর আমার বাড়ির মধ্যে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তোমার জমি বল কোন সাহোসে?” গর্জে উঠলেন।
“সাহস না ভাই, কাগজের জোর। আপনার বোনটা বড় দিল দড়িয়া কিনা, আমার নামে দিয়া দিছিল জমিটা।” একটা দলিল বের করে নাড়াল।
“আমার বোন বাঁচে থাকতে তোমারে কোনো জমি লেখে দেয় নাই! মিথ্যা দলিল বানাইয়া জমি হাতাইতে চাও? তোমার আস্পর্ধা দেখে আমি অবাক হইতেছি।” বাঘের মত গর্জে উঠলেন ঘোড়ার ওপর থেকে, “এক্ষনি বেড়া রুলে নিয়া চলে যাও। নাইলে খারাপ হবে।”
“ভদ্রভাবে বললাম, শুনলেন না।” হাসি মুখে বললো সুলতান। “আমার হাতের কাগজটা আগে কোর্টে জাল প্রমাণ করেন হাজী সাব। তারপর আসিয়েন। রাস্তা ঐ দিকে, আসতে পারেন।”
সুলেমান লাঠি হাতে এগিয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে, চোখ দুটো অঙ্গারের মত জ্বলছে। হাজী সাহেব হাত তুলে থামালেন, “সুলেমান- না!”
ধারাল দৃষ্টিতে তাকালেন সুলতান শিকদারের দিকে, “শেষ বারের মত সাবধান করতেছি সুলতান। আমি খামির উদ্দিন, এক কথা দুইবার বলব না। লোকজন নিয়া ফিরা যাও। নয়তো তোমার সব জমি এইদিক সেই দিক হয়ে যাবে। ভাবে নেও।”
সুলতান তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল, হাসল, “আপনার দৌড় আমার জানা আছে হাজী সাব। প্রেসিডেন্ট হইছেন বলে মাথা কিনে নিছেন ভাবছেন? লাভ নাই। যান, যান। ঘরে যান।”
হাজী খামির উদ্দিনের মাথায় যেন বিস্ফোরণ হল, হুংকার দিয়ে বেড়া দিতে থাকা লোকগুলোর দিকে ফিরে বললেন, “আর একটা খুঁটি জমিতে যে গাড়বে পরের খুঁটিটা তার বুকের ওপর গাড়বো আমি! আমার জমির ওপর দাঁড়াইয়া কোন সাহোসে খুঁটি গাড়িস তোরা?”
সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো থেমে গেল। হাজী খামির উদ্দিনকে বাঘের মত ভয় করে সবাই।
সুলতান শিকদার ধমকে উঠল, “কাজ কর হারামজাদার দল! কার খাস? আমার না হাজীর?”
ধমকে কাজ হল না। লোকগুলো গ্রামের গরীব আধিয়ার, হাজী সাহেবকে সুলতানের থেকেও বেশি ভয় করে। জড়সড় হয়ে রইল লোকগুলো। এমনকি সুলতানের সঙ্গে থাকা লাঠিয়ালগুলো পর্যন্ত ঢোক গিলল শব্দ করে।
হাজী খামির উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সুলতান, “দেবীর হাটে দেখা হবে হাজী সাব। কোর্টের মুখ আপনারে না দেখায়া ছাড়ছি তো আমি সুলতান শিকদার না!” ঘুরে হাটা শুরু কর। ওর পেছন পেছন ইসমাইল শিকদার। ঘোড়াগুলোয় চড়ে ফিরে গেল।
হাজী খামির উদ্দিন ঘোড়া থেকে নেমে জায়নামায মাঠে বিছিয়ে যোহরের নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি যখন অনেক ছোট ছিলেন, তখন তাঁর বাবা হাজী মেহরাব উদ্দিনকে দেখতেন জমির নানান সমস্যা কাইজ্জা ছাড়াই মিটিয়ে ফেলতেন। তারপর জায়নামায বিছিয়ে সেই জমিতেই নামায পড়তে দাঁড়িয়ে যেতেন।
মাঠে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মানুষগুলোকে দেখা গেল পাশের পুকুর থেকে ওযু করে এসে এই প্রখর রৌদ্রের মাঝে হাজী খামির উদ্দিনের পেছনে একে একে নামাযে দাঁড়িয়ে গেছে গামছা বিছিয়ে।

নামায শেষে মাঠে কাজ করতে থাকা লোকগুলো পিলার আর তাঁরকাঁটা খুলে ফেলতে লাগল। সুলতান শিকদারের হুকুম অমান্য করেছে বলে সুলতানের জমিতে যে আর তারা থাকতে পারবে না জানেন হাজী খামির উদ্দিন। তাই একটু আগে সবাইকে ডেকে বলে দিয়েছেন আজ থেকে তাঁর জমিতে আধিয়ার হিসেবে থাকবে তারা। লোকগুলোর অবশ্য তা নিয়ে অত শত ভাবনা নেই। জানেই যে হাজী খামির উদ্দিন জেনে শুনে এতগুলো মানুষের ক্ষতি হতে দেবেন না।

সূর্যটা তেঁতে উঠেছে। আগুণ ঢালছে যেন। খামির উদ্দিন পুকুর পাড়ের উঁচু টিলা মত জায়গাটায় একটা গাছের নিচে বসে আছেন। বাতাস আসছে এখানে। হাতের ছড়িটা নাড়াচাড়া করতে করতে আনমনে তাকিয়ে আছেন দূরের মাঠগুলোর দিকে। পিলার ওঠাতে থাকা লোকগুলোর দিকে মনোযোগ নেই তাঁর। ছোট বোন সালেহার কথা মনে পরছে।
হাজী খামির উদ্দিন ও হাজী মেহের অকসের ছোট একটা বোন ছিল। সালেহা আক্তার। অল্প বয়সে সুলতান শিকদারের সাথে বিয়ে হয়। বংশ মর্যাদায় সুলতানরা ওদের সমান হওয়াতে বিয়েটা হয়েছিল। ভেবেছিল স্বামীর ঘরে গিয়ে সুখী হবে বোনটা। কিন্তু সারাক্ষণ খাটিয়ে মারত মেয়েটাকে। ঘরের ঝিঁ চাকরানীর মত ব্যবহার করত। প্রায়ই নাকি মারধোর করতো। পেটে বাচ্চা এসেছিল দুবার, কিন্তু সুলতান শিকদারের অত্যাচারে দু’বারই গর্ভপাত হয়। শেষের দিকে ভাইয়ের বাড়িতে চলে আসত সালেহা অত্যাচার সইতে না পেরে। তার মাঝে একদিন সুলতান শিকদার আরেকটা বিয়ে করে ফেলে। ভাইয়ের বাড়িতে থেকে কথাটা জানতে পারে সালেহা। ছুটে গিয়েছিল স্বামীর বাড়ি। কিন্তু যাওয়ার সাথে সাথে তাকে তালাক দিয়ে দেনমোহরনার টাকা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয় সুলতান শিকদার। সালেহা ফিরে আসার দু’দিনের মাঝে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। সেই থেকে সুলতান শিকদারকে সহ্য করতে পারে না হাজী পরিবার। নাম শুনলেই ক্ষেপে ওঠে।
অনেক বছর আগের কথা এগুলো। খামির উদ্দিন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। কত বছর হবে? পঁচিশ বছর তো হবেই। সুলেমানের যখন আট বছর বয়স তখন বিয়ে হয়েছিল সালেহার। সুলেমানের মা নূরেমান বিবিকে দেয়া হয় সালেহার সাথে। হাজী বংশে নতুন বৌয়ের সাথে কম বয়সী কাজের মেয়ে পাঠানোর নিয়ম নেই। সুলেমানও গিয়েছিল মায়ের সাথে সাথে। সালেহার সঙ্গেই থাকত নূরেমান বিবি। স্বামী মারা গেছে জমির কাইজ্জাতে গিয়ে। লাঠিয়াল ছিল স্বামীটা।
সালেহার প্রায় সব কাজ করে দেয়ার চেষ্টা করত নূরেমান। একদিন সালেহাকে সবার সামনে মারধোর করছিল সুলতান লাঠি নিয়ে। ঐ সময় নূরেমান বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। রান্না করা ভাতের গরম মাড় ছুড়ে মারা হয় নূরেমানের মুখে। চিরদিনের মত অন্ধ হয়ে যায় সেদিন। সুলেমান সেদিন ওখানেই ছিল, একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নীরবে সব দেখছিল। নূরেমান তার অল্প কদিন পরেই রক্ত বমি করতে করতে মারা যায়। সুলেমানকে খামির উদ্দিন নিয়ে আসে নিজের কাছে।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি সে।


“একটা কথা বলবো?” রহীমা খাতুন পানের বাটা হতে স্বামীর পাশে বসলেন রাতে। হাজী খামির উদ্দিন শুয়ে হাত পাখা নেড়ে যাচ্ছিলেন। ঘরে একটা হারিকেন জ্বলছে। বাহিরে বৃষ্টি নেমেছে। টিনের চালে টানা বৃষ্টির শব্দ। আর কোনো শব্দ নেই।
“হুম বলো।” স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
“খায়রুলের বিয়ের কথা ভাবতেছি। ছেলের বিয়ের বয়স হইছে। আমাদের গ্রামের জায়গিরদারের মেয়ে রাবেয়ারে আমার বড় পছন্দ।”
“হুম।” চুপ হয়ে রইলেন তিনি।
“কি ব্যাপার? আপনি বোধ হয় আমার কথাটা পছন্দ করলেন না?”
“নাহ। তা হবে ক্যানো? সে তো তোমারই ছেলে। তোমার কথার একটা মূল্য আছে।”
“তাইলে? কিছু বলতেছেন না যে?”
“আসলে ব্যাপারটা নিয়া আমিও ভাবতেছি.....”
“আপনার নিজের যদি কোনো পছন্দ থাকে, বলেন।”
“হুম। আমি আর কি পছন্দ করবো? আমার তো জানা শোনা তেমন কোনো মেয়েই নাই। তোমার পছন্দের মেয়ের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিও।”
“সেইটা তো আপনি করবেন। আমি ক্যামনে করবো?”
“ও! আমার করার কথা?” অন্যমনস্ক ভাবে বললেন।
“আপনার কি হয়েছে আসলে বলেন তো? আপনি আমার কথায় মন দিতেছেন না। অন্য কিছু ভাবতেছেন। কি ভাবতেছেন বলবেন?” রহীমা খাতুন একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন।
হাজী খামির উদ্দিন চুপ করে রইলেন।
“কি হইল? বলেন, বলবেন না আমারে?”
অন্য দিকে পাশ ফিরে শুলেন হাজী সাহেব। আস্তে আস্তে বললেন, “মনটা বড় অস্থির লাগতেছে বড় বৌ। সুলতান বহু দিন পর আজকে সালেহার কথা মনে পড়ায় দিলো। বোনটার কথা বার বার মনে আসতেছে তখন থেকে। বুকের ভেতরটা মোচড় খাইতেছে......”
রহীমা খাতুন স্বামীর মাথায় মমতা ভরে হাত রাখলেন, কোমল গলায় বললেন, “যে যাবার, সে তো যাবেই। মন খারাপ করিয়েন না আপনি।”
হাজী সাহেব জবাব দিলেন না। রহীমা খাতুন পানের বাটা রেখে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়লেন। ঘুমাবেন না ঘুমাবেন না - ভেবেও ঘুমিয়ে গেলেন কখন টের পেলেন না। কিন্তু হাজী সাহেব জেগে রইলেন। নির্ঘুম দীর্ঘ একটা রাত কাটতে লাগল অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে।


“মহারাণী” যাত্রাদলের ম্যানেজার গোবিন্দ পাল ধুতির খুট দিয়ে মুখের পানের কষ মুছতে মুছতে রমলার দিকে তাকাল, “কাল রাতি থেকি কিন্তু শো শুরু হয়বো বুঝেচিস? তোর নবাব জাদা স্বামীরে কইস পিরেক্টিস যেনু ঠিক মত করি হয়। নইলে আমি কিরাম করবার পারি ভাল করি জানিস। পয়লা শো থেকি কিন্তু লোক টানতি হইবে। নাইলে কইলাম ভাল পাবিনে। নতুন ইলাকা, নতুন মানুষ, বুঝি শুনি কাম করিবি। মন রাখিবার হইবো।”
রমলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমার মরদ তো তাড়িতো চুর হই আছে দেখিনু শ্যাল। সে করিবে রাজপুত্তুর বিনয় চাঁদের পাট? নতুন লোক দেখোগে বাবু।”
“ও শালার বেটাক আমি শূলে চড়াবো। আমার ব্যবসা লাটে তুলিবার চায়? কুত্তা দিয়া শালার কটি কামড়ায়া দেয়া দরকার! বিনয় চাঁদের পুরা পাট মুখস্ত আছে বলি বেটারে দলে রাখিছিলাম, এখন দেখি পায়ে বসেচে! ভাবিছে নতুন আর কাউরে পাবিনে এই গোবিন্দ পাল? হ্যা? শালার বেটাক লুঙ্গি খুলে তুর্কি নাচন নাচামু দেখিস! ওরে তাড়ি কম নিতে ক, নইলে কিন্তুক খারাপ হবিনে! আমি গেলুম। সক্কাল সক্কাল পিরেক্টিসে যেনু পুরা দল পাই।” উঠে দাঁড়াল গোবিন্দ পাল। ছাতাটা হাতে নিয়ে তাবু থেকে বের হতে গেল, পেছন থেকে রমলা ডেকে বলল, নতুন মায়েটারে অভিনয় কিছু শেখাচ্চ না নাকি? দিনরাত দেখি তাবুর ভিতর পড়ি থাকে? বিনয় চাঁদের ছোট বোন কান্তার পাটে দিলে ভাল হইত। চেহারা ছিঁড়ি ছাঁদ তো ভালই, রাজকন্যার পাটও পাবে। কিছু শেখাও। এইরেম মায়ে ছাওয়াল লোক টানিবার লাগি ফাশ কেলাস। দুই দিন লোকে দেখিলেই দেখবায় মহারাণী যাত্রার নাম গিরামে গিরামে ছরায় পড়িছে!”
“হু। মন্দ বলিসনি। নতুন কেনা মায় ছাওয়াল তো, ভং ধরতাছে। এক রাত আমার লগে শুলি সোজা হয়ে যাবিনে! যাত্রাদলে অত সতীপণা দেখায়ে লাব নাই।” বেরিয়ে গেল তাবু থেকে। রমলা মুখ বাঁকালো। মহারাণী যাত্রাদল এর আগে ময়দান দীঘিতে ছিল দশ দিনের মত। ওখান থেকে আসার সময় পরিচিত এক ডাকাত দলের কাছ থেকে একতা কম বয়সী হিন্দু মেয়েকে কিনেছে গোবিন্দ পাল। তার যাত্রাদলের মেয়েদের যোগান প্রায়ই দেয় ঐ ডাকাত দলটা। কোনো একটা বিয়ের সময় বিয়ে বাড়ি থেকে বেশ কিছু মেয়ের সাথে ঐ মেয়েটাকেও তুলে এনেছিল ডাকাতরা। চেহারা ছিঁড়ি ভাল বলে গোবিন্দ পাল গাঁটের পয়সা খরচ করে কিনে এনেছে মেয়েটাকে। বেশি দিন হয়নি এনেছে। সারাদিন রাত তাবুর ভেতর একা একা বসে থাকে। কিছুই খায় না। কারো সাথে কথাও বলে না। নীরবে হাটুতে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে। রমলা কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে দেখেছিল। টু শব্দ পর্যন্ত করেনি মেয়েটা। মুখ নিচু করে বসে ছিল মাটিতে।
গোবিন্দ পালের দলে মেয়ের অভাব নেই। তাই আপাতত মেয়েটাকে তেমন একটা জোর জবরদস্তি করা হচ্ছে না অভিনয় শেখার জন্য। ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠলে আপনে থেকেই অভিনয়ে মন দেবে। কারণ সে তো আর কচি খুকি নয় যে এটা বুঝবে না- তার ফিরে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। রমলা তাই বেশি কিছু করতে যায়নি। সে নিজেও এই দলে এভাবে এসেছে। এখন আর খারাপ লাগে না এই জীবন। মানিয়ে নিয়েছে। ঐ মেয়েটাও নেবে।
আয়নার সামনে বসে চুল খুলতে লাগল রমলা, লম্বা বেণী খুলতে খুলতে গুণ গুণ করে গান গাইতে লাগল। তার মাতাল স্বামী ধিরেণের গলা শোনা যাচ্ছে বাহিরে। দল বেঁধে আগুণ জ্বালিয়ে বসে তাড়ি খাচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে খুব, আগুণ নিভে যায়নি তাতে। কারণ ওপরে একটা খড়ের চাটাই দেয়া। তার নিচে সব মাতালে এক হয়েছে।
বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। রমলা চুল আচড়াচ্ছে চরুনি দিয়ে। এমন সময় ধিরেণ টলতে টলতে ঢুকল তাবুর ভেতর। ঢুকেই তাবুর দরজার ফিতে লাগিয়ে দিল, “জানু! কি করো গো রমলা! আমার কমলা বিবি!” টলতে টলতে এগিয়ে এল রমলার দিকে।
রমলা স্বামীর দিকে না তাকিয়ে বলল, “দেখবার পারিসনে কী করতেছি?”
“তোমারে এত সুন্দর লাগে ক্যানে বৌ!” স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখল। ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিল রমলা, “যা শালা ভাগ! এতক্ষণ মদে ছিল চুর। এখন আসচে  শইলের জ্বালা মিটাইতে!”
“আহহা! রাগস ক্যান বৌ! তোর কাছে ছাড়া আর কার কাছে যামু? কিবা আছে মোর?” রমলার পেছন দিক থেকে এসে কাঁধে ঝুঁকে এল। মুখে কড়া মদের গন্ধ। রমলা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আবার, “রঙ তামাশা করবি না কইলাম। ভাল্লাগে না আর।”
“ক্যান? নতুন মরদ দরকার? আমারে দিয়া চলে না আর?” খেঁকিয়ে উঠল ধিরেণ। “আমার লগে ত্যাজ দেখাচ্চিস ক্যা? ঐ শালা গোবিন্দর লগে পিরিতি না? শুইবার চাস ওর লগে? যা না, গিয়া শো!”
রমলা রাগের চোটে চিরুনিটা ছুড়ে মারল ধিরেণকে লক্ষ্য করে। লাগল না। ধিরেণ হেসে উঠল, “তোর হাতের টিপ বড়ই কাঁচা রয়া গেল বৌ! আয়, বুকে আয়! একটু আদর করি......”
রমলা রাগতে গিয়েও রাগতে পারল না। গত আটটা বছর এই মাতাল লোকটাকে সয়ে এসেছে সে। যাত্রাদলের মানুষের নাকি মায়া মমতা থাকে না। কিন্তু সে কেন যেন এই মাতাল লোকটার প্রতি গভীর মমতা অনুভব করে। অনুভূতি সীমাবদ্ধ নয়। তার বিস্তৃতি পৃথিবীর আদ্যোপান্ত।

গভীর রাতে রমলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধিরেণের অর্ধ নগ্ন শরীরটা ওর ওপর পড়ে রয়েছে। শুয়ে থেকেই শুনতে পেল ম্যানেজার গোবিন্দ পাল তাস্বরে চেঁচাচ্ছে, “ওরে কে আচিস! নতুন মায়েটা পলায় গেলোরে! কেউ থামাবার পারলিনে! সব কটারে শূলে চড়াবো! যিখান থেকি পারিস মায়ে টারে খুঁজি বার কর!”
ধিরেণ ঘুমের মধ্যেই বলল, “শালার গোবিন্দ চামার মাঝ রাত্তিরে কুত্তার ডাক ডাকে ক্যান? ভূতে ধরছে?”
রমলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “নতুন মায়েটা পালায়েছে বোধ হয়! ম্যানেজারের কান্না হুনে তো তাই লাগতিছে। বৌ মরলিও তো শালা অমন করে না!”

বৃষ্টির তেজ ক্রমশ বেড়ছে রাত বাড়ার সাথে সাথে। বাতাসের পাগলামির কারণে এদিক ওদিক হয়ে তেড়ে আসছে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো। আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা, চারদিকে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে চারপাশ আলোকিত করে বাজ পড়ছে প্রচন্ড শব্দে। তার মাঝ দিয়েই মাথায় মাথাল দিয়ে সুলেমান হাটছে দক্ষিণের জমির আল দিয়ে। খালি পা, লুঙ্গি আর শার্ট ভিজে হায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। খড়ের মাথালটা কেবল মাথাটাই বাঁচাচ্ছে, বাতাসের উল্টো পাল্টা ছোটা ছুটিতে বৃষ্টি পুরো ভিজিয়ে দিয়েছে তাকে। জমির আলগুলো কেবল ভেসে আছে, আর জমিগুলো সব ডুবে গেছে এক সন্ধ্যার বৃষ্টিতে। আল দিয়ে হাটতে গেলেই পানি আর কাঁদা প্যাচ প্যাচ করে ছিটকে উঠছে। ঘন অন্ধকারের মাঝ দিয়ে দক্ষিণে হেটে যাচ্ছে কেবল সুলেমান। এত অন্ধকারের মাঝেও কীভাবে পথ দেখে হাটছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। হাতে বড় একটা লাঠি। লাঠি ঠুকে ঠুকে হেটে যাচ্ছে। যেন দুনিয়ার প্রতি কোনো মোহ বা আকর্ষণ নেই তার।
সুলেমান দক্ষিণে যে জায়গাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা সাপের আস্তানা। ধানী জমিগুলোর পর দুটো টিলায় ঘেরা একটা ছোট পুকুর আছে ঐ জায়গাটায়। টিলা দু’টোর দু’পাশের ছোট খাল মত। টিলার ওপর বিশাল একটা বটগাছ। পুরো জায়গাটায় অসংখ্য বাঁশ খাঁড়া ভাবে গেড়ে দেয়া থাকে। দিনের বেলাতেও দেখা যায় হাজার হাজার সাপ সে সব বাঁশে প্যাঁচিয়ে বসে থাকে। ব্যাঙ ধরে। এ জায়গাটায় কেউ আসে না। সাপের আস্তানা নামে চেনে সবাই জায়গাটাকে। যদিও বিষাক্ত তেমন কোনো সাপ কেউ দেখেনি কখনো এখানে। কিন্তু লোকে বলে বহু বছর আগে এখানে নাকি একটা শঙ্খচূড় সাপ ছিল। মেয়ে শঙ্খচূড়। গ্রামে কেউ পাপ করলে সেইখানে গিয়ে কেঁটে আসতো শঙ্খচূড়টা। এক ছোবলেই প্রাণ হারাত লোকজন। বহু বছর হল সাপটাকে কেউ দেখেনি আর। লোকে বলে পূর্ণিমা-অমাবস্যা রাতে ঐ বটগাছের শেকড়ের মাঝখান থকে বেরিয়ে আসে সাপটা। মেয়ে মানুষের মত রূপ নেয়। তখন তার কাছে কিছু চাইলে নাকি মানত পূর্ণ হয়। এদিকের এলাকায় তেমন হিন্দু থাকে না। থাকলে হয়তো জায়গাটাকে নাগ দেবীর বাসস্থান বলে পূজা দেয়া শুরু করতো।
সুলেমান প্রায়ই একা একা আসে এখানে। এসে গভীর রাতে শুয়ে থাকে বট গাছের নিচে। সাপ খোপের ভয় নেই তার। কেন যে আসে, সে নিজেও জানে না। এসে একা একা বাঁশি বাজায় গভীর রাতে।
দূর থেকেই বিশাল বট গাছটার আবছা অবয়ব দেখা যায় প্রবল বৃষ্টির মাঝে। টিলাগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন বিশাল দু’টো দানব কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। খালের তীর দিয়ে কাঁদা মাড়িয়ে হেটে যেতে থাকল সে। চারপাশে বাঁশের লাঠির ওপর হাজার হাজার সাপ নড়া চড়া করেছে। সুলেমান জানে ওগুলো একটাও বিষাক্ত নয়। তবুও যে কেন মানুশ এদিকে আসে না বোঝে না সে। টিলাগুলোর ঢালে অসংখ্য ইঁদুরের গর্তের মত গর্ত। সাপ থাকে ওগুলোয়। সুলেমান ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এল।
পুকুরটার দিকে খাঁড়া ভাবে নেমে গেছে টিলার পাড়। বট গাছটার অর্ধেক অংশ শূণ্যের ওপর ঝুলে রয়েছে পুকুরের ওপর। আসলে পাড় বাঙ্গায় এমন হয়েছে। সুলেমান বট গাছটার ঝুলন্ত শেকড় বেয়ে পুকুরের ওপর চলে এল। পা ঝুলিয়ে বসল। কোমরে বাঁধা বাঁশিটা বের করল। বাঁশিটা তার না। তার বাবার। সুলেমানের বাবাও বাঁশি বাজাতে ভালবাসত। প্রায়ই এখানে এসে বাঁশি বাজাত গভীর রাতে। এটা অবশ্য সুলেমানের জন্মের আগের কথা। মায়ের মুখে শুনেছিল এসব। তখন থেকেই বাঁশিটা সঙ্গে রাখে সব সময়।
বৃষ্টির তেজ ক্ষিণ হয়ে আসছে। সুলেমান বাঁশির মাঝে করুণ একটা সুর তুলেছে। সুরটা পুকুরের পাড়ে গিয়ে ফিরে আসছে, ছড়িয়ে পড়ছে জগৎময়........ শুনলে বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করতে থাকে। তীব্র একটা কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে.......
বাঁশি বাজাতে বাজাতে চোখে পানি চলে এসেছে সুলেমানের। কিন্তু মাথালের আড়ালে সব ঢাকা পড়েছে। বাঁশির সুরে যেন মিশে গেছে সুলেমানের পুরো চেতনা। আর কোনো দিকে মন নেই তার.......
হঠাৎ পেছন দিকে ধপ করে একটা শব্দ হতেই বাঁশি থামিয়ে ফেলল সুলেমান। লাঠি হাতে ফিরে তাকাল পেছনে। চোখে শিকারী নেকড়ের মত জ্বল জ্বলে দৃষ্টি। অন্ধকারে আবছা ভাবে দেখান গেল বট গাছের ওপাশ থেকে মানবী আকৃতির কিছু একটা বেরিয়ে আসছে! গাছটা খাঁমচে ধরে সোজা হয়ে থাকার চেষ্টা করছে কেউ!
তীক্ষ্ম চোখে তাকাল সুলেমান। আকাশে ঠিক তখনি বিদ্যুৎ চমকালো। অবাক হয়ে দেখলো ভেজা শাড়ি পরা অসম্ভব সুন্দর একটা মেয়ে বট গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো গালের সাথে লেপ্টে আছে। বড় বড় চোখে আকুতি; করুণ দৃষ্টি।
সুলেমান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। অসংখ্য প্রশ্ন ভরা চোখে তাকাল মেয়েটার দিকে। এগিয়ে গেল সাবধানে। সে পৌছানোর আগেই মেয়েটা টলে উঠল, ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। দৌড়ে ছুটে এল সুলেমান। ঝুঁকে বসল মেয়েটার পাশে। কে এ? সেই শঙ্খচূড় দেবী নয়তো?
খপ করে সুলেমানের একটা হাত দু’হাতে ধরল মেয়েটা। কান্না চাপা গলায় বলল, “আমারে বাঁচান! আমি যাত্রাদল থেইকা পলায় আসছি। আমারে বাঁচান। ওরা আমারে কিনা আনছে। আমারে ধরে নিয়া যাবে যদি দেখে ফালায়।” শেষের দিকে অস্পষ্ট হয়ে এল মেয়েটার গলা। জ্ঞান হারাল।
সুলেমান বিমূঢ়ের মত বজ্রপাতের আলোয় দেখলো মেয়েটার দুই পায়ের পাতা ক্ষত- বিক্ষত হয়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে, সাপের দাঁতে কাঁটা দাগগুলোও স্পষ্ট বোঝা যায়। সুলেমান পাথরের মত বসে রইল।
বৃষ্টির বেগ গুটি গুটি পায়ে বাড়ছে কেবল, সেই সঙ্গে বাতাসের মাঝে দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ.........

(চলবে...)

নিথর শ্রাবন শিহাব

No comments:

Post a Comment