Subscribe:

নীল শাড়ি

"মা একটা নীল শাড়ি দাও তো..." ভারি ব্যাস্ত একটা ভাব নিয়ে দ্রুত কথাগুলো বলল নীলা । তার কণ্ঠের উৎফুল্লতাটুকু যেন মা বুঝতে না পারে । আজ ১৪ ফেব্রুয়ারী । কোনোভাবে যদি মা ব্যাপারটা টের পেয়ে যায় তাহলেই হয়েছে !
মা ব্যাপারটা বুঝলেন বলে মনে হল না । বললেন, "আমি নীল শাড়ি কোথায় পাবো?"
"কেন তোমার না কতো শাড়ি !"


"কেন তোমার না কতো শাড়ি!" মা নীলাকে ভালভাবেই ভেংচে দিলেন । "কোথায় দেখলি আমার কতো শাড়ি?"
"আশ্চর্য একটা নীল শাড়ি নেই?"
"উহু । আমার বেশির ভাগই তো লাল । দুই একটা আছে অন্য কালার এর , তবে নীল নেই ।" মা এবার একটু নরম ।
খুব সাবধানে এবং খুব কষ্টে প্রায় বেরিয়ে যাওয়া একটি দীর্ঘশ্বাস চাপল নীলা । "ঠিক আছে কি আর করা ! যাই আপুর কাছে, দেখি আছে কিনা?" বলেই তাড়াতাড়ি যেতে উদ্যত হল নীলা ।
কিন্তু মা পেছন থেকে ডাকলেন, "শাড়ি কি জন্য?"
এই ভয়টাই করছিলো নীলা । আচ্ছা মার কি মনে আছে যে আজকে ১৪ তারিখ? নেই বোধয় । সে ঝাঁঝের সহিত উলটো ঘুরলো । "ভাজি করে খাব । আব্বু পুঁইশাক এনেছে না? ওইটার সাথে দোপেয়াজা করব । মা!! মানুষ শাড়ি কি করে? খায় না নিশ্চয়?"
মা একটু ইতস্তত করে বললেন , "না মানে, কখনও তো শাড়ি পড়তে চাসনি । তাই বললাম আর কি।"
নীলা মায়ের মুখটা ভালো করে দেখল । না সেখানে সরল সত্য ছাড়া আর কিছু নেই । তার মানে আসলেই তার মনে নেই । মনে মনে হাঁপ ছাড়ল নীলা । " আসলে আজ আমরা সব বান্ধবীরা মিলে প্ল্যান করেছি যে শাড়ি পড়ে ঘুরব ।"
"ও তাই বল..." বলে মা তার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন । নীলাও তাড়াতাড়ি ও ঘর ছেড়ে পালাল । একটুও ঘুরে দেখল না । অবশ্য দেখার কথাও না । দেখলে দেখতে পেত তার মা সায়লা আমিন তার এই সদা চঞ্চলা কন্যার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন । তাঁরও কি সেই দুরন্ত সময়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল?

আপুর কাছে যাবে কিনা ভাবছে নীলা । আপুর কাছে যাওয়া আরেক ঝামেলা । মা নাহয় ভুল করে ভুলে গেছে । কিন্তু আপু যা চালু । জীবনেও ভুলবে না । কিন্তু এমন একটা অবস্থা । এখন যাওয়া ছাড়া উপায় নেই । নীল একটা শাড়ি নীলার লাগবেই । আস্তে আস্তে সে শিলার রুমে গেল । শিলা ইচ্ছামতো বই দাগাচ্ছে । মেডিক্যাল এ পড়ে । বেশি বেশি পড়তে হয় । কিন্তু এতই কি বেশি যে এমন একটা দিনেও বসে বসে বই দাগাতে হবে ? শিলাপু টা না একটা বোতল । মনে মনে একটা মন্তব্য করে ফেলল সে ।
নীলাকে দেখে শিলা বলল "বলে ফেলেন মহারাণী , কি লাগবে? "
"কিভাবে বুঝলে যে আমি কিছু চাইছি?
"তুই যেভাবে ফকিরের মতো দাড়িয়ে আছিস ! যে কেউ বুঝবে ।"
অন্য সময় হলে শিলার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত । কিন্তু আজ চিত্র ভিন্ন । নীলা আসলেই সাহায্যপ্রার্থী । সে একটু এড়িয়ে গিয়ে বলল , "আচ্ছা আপু নীল শাড়ি আছে তোমার?"
শিলার মুখটা দপ করে জ্বলে উঠল ১০০ ওয়াট বাল্বের মতো । হাসতে হাসতে বলল, "শাড়ি!... আচ্ছা? তলে তলে এত? ম্যাডামের এখন ১৪ ফেব্রুয়ারী তে শাড়িও লাগে? বলি কামিজ পড়ে কি প্রেম চলে না?..."
"আপু!...তুমি কিন্তু বেশি করছ ! কে বলল যে প্রেম করতে শাড়ি চাচ্ছি? আমরা বান্ধবীরা মিলে ঘুরব । সবাই নীল শাড়ি পরবে । তাই একটা চাচ্ছিলাম আর কি । না দিলে না দিবা ! তুমি না......! সবসময় বেশি বুঝো ।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ... আমরা তো বেশি ই বুঝি । তুমি বুঝো কম ! কম বুঝেই এই দিনে শাড়ি খুঁজো । আমার কাছে নেই শাড়ি-টাড়ি ।"
"আপু, একটু দেখই না । প্লিজ?"
শিলা এইবার একটু নরম হল । আহারে বেচারি । মুখটা কেমন করেছে! বলল, "আচ্ছা দাড়া । দেখি আছে নাকি ।"বলে সে তাঁর আলমারি ঘাঁটতে লাগলো ।
"নীল তো নেই রে । সবুজ একটা আছে । আরেকটা নীলচে বেগুনী । এইটাই পড়ে যা । দূর থেকে নীল নীল লাগে ।"বলে এক চোখ টিপে বলল ,"আর ছেলেরা এতকিছু খেয়াল ও করে না!"
"আপু!...তুমি না বেশি বেশি!" বলে নীলা দৌড়ে ঘরে চলে এল । তার চোখে পানি চলে এসেছে । রুদ্র তাকে কতো করে বলেছে আজ নীল শাড়ি পড়ে আসতে । সেও নীল পাঞ্জাবি পড়ে আসবে । নীলা কিনা শাড়িই ম্যানেজ করতে পারল না । এত কান্না পাচ্ছে কেন? এখন সে কিভাবে যাবে নীল শাড়ি ছাড়া? একশ টা ঘুমের ট্যাবলেট একসাথে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে । খেয়ে ফেলবে নাকি বিশ-তিরিশটা? মায়ের বিছানার পাশেই তো আছে...
"আচ্ছা তোকে না বললাম নীল শাড়ি পড়ে আসতে?"
নীলা এই প্রশ্নটার অপেক্ষা করছিলো অনেক্ষন ধরে । সে অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে এখনও কেন রুদ্র করছে না এই প্রশ্ন? অবশেষে এল।
"কখন বললি?"
"কখন বললাম মানে? সেদিন না বললাম যে নীলাকে দেখব নীলের গাম্ভীর্যে?"
"ইস! ঢং দেখ ! নীলাকে দেখব নীলের গাম্ভীর্যে ! আমার মনে ছিল না যা ।"
"মনে ছিল না !"
"না । কবে না কবে বলেছিস!......
মিথ্যা বলেই যাচ্ছে নীলা । একটু লজ্জাও করছে । তার সামনে যে সুপুরুষটি দাড়িয়ে আছে তার নামই রুদ্র ।এই ছেলেটাকে সে এত ভালবাসে কিন্তু এই তুই এর ফাঁদে পড়ে তার বলাই হয় না । সে জানে রুদ্রও তাকে ভালবাসে কিন্তু তার ভাবতে ভালো লাগে যে একদিন রুদ্র এক তোড়া গোলাপ এনে হাঁটু গেড়ে বসবে তার সামনে । বলবে "আমি তোমাকে ..............."। ভাবনাটাতেও সে লজ্জা পায় । বাস্তবে যদি হত কোনোদিন তবে কি যে হত আল্লাই জানে...
"এই শোন আমার হাত ধর তুই ।" রুদ্রর এই কথায় চমকে উঠল নীলা । রুদ্র কি করে তার মনের কথাটিই বলল ? একেই বোধয় বলে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ । আচ্ছা এই টেলিপ্যাথিক যোগাযোগটা কি শুধু ভালোবাসার মানুষদের মাঝেই হয়? যেমন মা ও ছেলে, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা......
"কি হল বললাম না হাত ধরতে ?"
"হ্যাঁ !......তুই বললি আর আমি হাত ধরে ফেললাম না? কতো মানুষ দেখেছিস আশেপাশে? ধরব না হাত ভাগ।" বলেই নীলা চিন্তায় পড়ে গেল । এটা কি হল? এখন গাধাটা যদি আর রিকোয়েস্ট না করে? ইস! কেন যে সে ভাবটা ধরতে গেল......
"আরে ধর না । আশেপাশে সবাই তো হাত ধরাধরি করেই বসে আছে । আমরা ধরলে দোষ কোথায়?"
এইবার আর নীলা ভুল করলো না । খুব সাবধানে বলল, "ঠিইইক আছে । কি আর করা । এত করে বলছিস ..." বলে কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই রুদ্রর হাত ধরে ফেলল । এই প্রথম । এবং সাথে সাথেই কি একটা যেন হয়ে গেলো ! পৃথিবীটা এত ছোট মনে হচ্ছে কেন? মানুষগুলো কি ছোট ছোট! মনে হচ্ছে সারাজীবন এই হাত ধরে থাকতেও তার কষ্ট লাগবে না । মরে যেতে ইচ্ছে করছে । চিৎকার করে সবাইকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে "দেখো ! দেখো !এই রুদ্র আমার! রুদ্র আমার !"
সেদিন তারা সারা দিন ঘুরলো । কেউ কাউকে বলল না "ভালবাসি" । কিন্তু এমনভাবে ঘুরলো যে ওটার আর প্রয়োজন পড়ে না । কারো কারো ভালোবাসা মুখ দিয়ে শুরু হয় কিন্তু অন্তরে প্রবেশের পথ খুঁজে পায় না । মুখেই রয়ে যায় । আবার কারো কারো ভালোবাসার জন্ম হয় হৃদয়ে কিন্তু তা মুখে আসার পথ খুঁজে পায় না । অব্যক্তই রয়ে যায় ।বড় অদ্ভুত এই ভালোবাসা !
আজ রুদ্রর জন্মদিন । ২৯ আগস্ট । নীলার আজও নীল শাড়ি পড়ে আসার কথা । কিন্তু সে কি করবে? কাল কান্তাকে বলেছিল ওর নীল শাড়িটা দিতে । সে বলেওছিল যে সে দেবে । কিন্তু আজ সকালে ফোন করে বলে, "সরি রে নীলা । আমার ওই শাড়িটা না লন্ড্রি তে । কাল চেক না করেই হ্যাঁ বলেছিলাম । সরি... হ্যাঁ?"
নীলার ইচ্ছে করছিলো কষে একটা থাপ্পর মারে । সামনাসামনি থাকলে হয়ত মেরেই বসত । "না না ঠিক আছে ।", "আমি কিছু মনে করিনি" এইসব বলে সে ফোন কেটে দিয়েছে । এবং আধাঘণ্টা কাঁদার পর একটা সবুজ কামিজ পরেই চলে এসেছে ।
"শুভ জন্মদিন ।"
বলতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো নীলার । এখন নিশ্চয় রুদ্র শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করবে । সে বলতেও পারে না যে তার নীল শাড়ি নেই । কেন পারে না সে নিজেও জানে না । হয়ত রুদ্র তাকে সাথে সাথে একটা নীল শাড়ি কিনে দেবে এই ভয়ে ।
রুদ্রর ওই দিকে খেয়াল নেই । সে বলল, " উহু ওইসব শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না । আমার জন্য কি এনেছিস দে আগে ।"
"কিছু আনিনি তো ! কেন কিছু আনবার কথা ছিল নাকি?" অবাক হবার ভান করলো নীলা ।
"ও তাই না? কথা ছিল না? দাড়া একমাস পরই তো তোরটা । দেখবি তোকে কি দেই? "
"হু, দেখা যাবে ।"
"দেখা গেলে যাবে । এখন চল ।"
"কোথায়?"
"আমার জন্মদিন না? খাওয়াবো তোকে!"
"উরিব্বাবা! এত দরদ! আজ কি টাকা পেলেন নাকি মায়ের থেকে?"
"হুম, চল..."
নীলাকে নিয়ে এক রেস্টুরেন্ট এ বসলো রুদ্র । খাওয়া শেষে নীলা বলল, "মহারাজের হাতখানা দেখি?"
"কেন?"
"আরে বাবা! দেখি না?"
রুদ্র হাত সামনে রাখতেই নীলা ব্যাগ থেকে একটি ঘড়ি বের করে হাতে পড়িয়ে দিল । অনেক দিন ধরে টাকা জমাচ্ছিল যে মাটির ব্যাংকটাতে ওটা সে আজ ভেঙ্গেছে । ভেবেছিল একজোড়া কানের দুল বানাবে । কিন্তু রুদ্রর হাসিমুখ যে তার চেয়েও মূল্যবান। একটা কেন হাজারটা ব্যাংক ভাঙতে পারে সে ওই হাসির জন্য ।
"এটা কি?" রুদ্রর হাসিমুখই বলে দিচ্ছে যে সে প্রচণ্ড খুশি হয়েছে ।
নীলা পড়িয়ে দিতে দিতেই বলল, "এটা কলস ! হাতে পড়িয়ে দিচ্ছি যাতে আমার মাথায় একটা বাড়ি দিতে পারিস!... আশ্চর্য !...দেখতেই তো পাচ্ছিস এটা একটা ঘড়ি!"
"আমার জন্য?"
"না ওই যে ওয়েটার আছে তার জন্য । ভুলে তোকে পড়িয়ে দিয়েছি । খুলে ফেলি?"
রুদ্র কিছুতেই আনন্দ ঢাকতে পারছে না । সে বলল, "আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ । আমি যে কি খুশি হয়েছি টা বলে বোঝাতে পারব না । আর এই যে শুনুন আমি আপনাকে ভালবাসি ।"
যুদ্ধে অকস্মাৎ বোমা পড়ে নীলা জানে । রাজনীতিতেও পড়ে। কিন্তু এই অবস্থায় এমন অকস্মাৎ এই বোমার শিকার হবে টা নীলার কল্পনাতেও ছিল না ।
"কি?" নীলার ব্যাপারটা বিশ্বাসই হচ্ছে না । সে নিশ্চিত যে সে ভুল শুনেছে । সারাদিন ওসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে মাথাটাই গেছে। "কি বললি?"
"বলেছি যে আমি তোকে ভালবাসি । ভালোবাসার মানে জানিস না? নাকি ওটা শিখিয়ে দিতে হবে? দয়া করে এটাকে আবার কৌতুক ভাবিস না । আমি সিরিয়াস । অনেক আগে থেকেই বলব বলব ভাবছিলাম......"
রুদ্র ছেলেটা আসলেই দিশেহারা । নীলার ফর্সা গালটা যে লাল থেকে আরও লাল হতে হতে রক্তিম বর্ণ ধারন করছে তাতে তার খেয়ালই নেই । বকেই যাচ্ছে তো বকেই যাচ্ছে ।ভালোবাসার সংজ্ঞা ! কতো প্রকার ! ও কি কি.........
সেদিন থেকে ঠিক দু বছর পরের কথা । ২৯ আগস্ট । নীলা তার বেডরুমে বসে আছে রুদ্রর জন্য । একটি নীল শাড়ি পড়ে বসে আছে সে । অনেক কষ্টে একদম নিজের টাকা দিয়ে শাড়িটি কিনেছে নীলা ।হুহ! দেখো এইবার! আমার নীল শাড়ি! হালকা কাজ করা কিনারটা । নীলাকে এই শাড়িতে মানিয়েছে খুব ।

নীলা বসে আছে রুদ্রর জন্য । ওই জগত থেকে আসা যায় নাকি সে জানে না... তবুও অপেক্ষায় আছে...। আসেনা কেন রুদ্র?.........



(বিঃদ্রঃ নীলার সেই ভালোবাসার পরদিন মানে ৩০ আগস্ট এক সড়ক দুর্ঘটনায় রুদ্র মারা যায় । নীলা তা বিশ্বাস করে না । তাই সে প্রতি বছর ২৯ আগস্ট এক নীল শাড়ি পড়ে বসে থাকে । তার বিশ্বাস রুদ্র একদিন আসবেই............)-

Farhad mahmud

No comments:

Post a Comment