Subscribe:

আমি রাজাকার বলছি

আজ পনেরই ডিসেম্বর। ২০১১ সাল। বাঙ্গালী জাতির জীবনে সহজ-সাধারন একটা দিন। বিশেষ কিছু না। কাল ষোলই ডিসেম্বর। আরেকটি সহজ সাধারন দিন। এদিনেরও বিশেষ কোন মূল্য নেই বাঙ্গালীর জীবনে। বছরের আর সব দিনের মতই সাধারন একটা দিন। তবে কিছু কিছু বেঈমান বাঙ্গালী আছে। তারা এই দিনে উৎসব পালন করে। বিজয়ের উৎসব। আমি সেরাজ আলী (ত্থুক্কু। আমিতো এখন সিরাজুল কাদের) সুরমা দেয়া চোখে দেখি আর মনে মনে হাসি। হাসি আর দেখি। আরে বেটা, কিসের বিজয় তোদের? যত্তসব আজগুবী প্যাচাল আর রূপকথা। '৭১ এ সামান্য 'গন্ডগোল' হয়েছিল বটে। কিন্তু সেটাতো পাকি ভাইদের পবিত্র হাতে হাত রেখে বেশ ভালোভাবেই সামলেছিলাম।


'৭১ এর নীলনকশার মূল হোতা শেখ মুজিব। তাকেতো পঁচাত্তরেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। শাস্তি দিয়েছে তারাই যাদের জন্য সে শত্রুতা করেছিল আমাদের সাথে। আর পাকিস্তানী ভাইদের সাথে। যাদের জন্য ৭ই মার্চে আগুন ঝরিয়েছিল। হয়তবা তার দোষ ছিল। কিংবা তার ভাগ্যই ছিল এই। ২০১১ সালে এসে দেখলাম '৭৫ এর খুনী ভাইদের ফাঁসী দেওয়া হয়েছে। মনটা সেদিন বিষন্ন হয়েছিল। আরে বাঙ্গালরা, মুজিবের খুনীদের বিচার করতে তোমাদের লাগল ছত্রিশ বছর। তোমরা আবার বিজয় দিবস পালন কর।!

'৭১ এ মুজিবকে গ্রেপ্তারের পর বাঙ্গালীরা হতাশ ছিল। অন্যদিকে আমরা ছিলাম প্রফুল্ল। কিন্তু হঠাৎ করেই পাশার দান উল্টে গেল। রেডিওতে কেউ একজন বলে,'আমি মেজর জিয়া বলছি।' সাথে সাথে দৃশ্যপট বদল। বাঙ্গালীরা আবার ঘেউ ঘেউ শুরু করে। আমরা বাঙ্গালী দমনে মন দেই। এই জিয়া সেই জিয়া যে জিয়া শুধু জাগিয়েই ক্ষান্ত হয় নি। প্রত্যক্ষভাবে 'গন্ডগোলে' আমাদের কাজ কঠিন করে দেয়। তাকেও শাস্তি দিয়েছিল কিছু বাঙ্গালীই। কারন সে বাঙ্গালীকে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিল। হয়তবা তার দোষ ছিল। কিংবা তার ভাগ্যই ছিল এই। এরপরও কি তোমাদের 'বিজয়' দেখে আমি হাসবো না??

'৭১ এর দিনগুলি এখনো চোখে ভাসে। রাজার মতো ছিলাম নয়টা মাস। 'গন্ডগোল' শুরুর এক মাসের মাথায় গ্রামে মিলিটারি ভাইদের আগমন। শুরু হয় আমাদের রাজত্ব। গঠিত হয় শান্তিবাহিনী। রাজত্বের সূচনা তখনই। আমাদের কাজ তেমন একটা ছিল না। কাজ বলতে গ্রামের কোন কোন যুবক 'গন্ডগোল' এ গেল বা যেতে পারে তাদের লিস্ট বানিয়ে পাকি ভাইদের হাতে দেওয়া, পাকি ভাইদের সবরকম চাহিদার দিকে নজর রাখা, ক্যাপ্টেন সাহেবের জন্য প্রতিদিন একটা করে 'মাল'
পাঠানো। এইত। বিনিময়ে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয় আমাদের।

পৃথিবীতে সবচে মজার কাজ হল অন্যকে ভয় দেখানো। সেই কাজটা আমি আমার রাজাকার ভাইদের নিয়ে বেশ নিষ্ঠার সাথেই পালন করেছিলাম। মানুষজন ভয়ে কাঁপত। আর আমি আড়ালে গিয়ে হাসতাম। মুক্তিদের লিস্ট বানাতে গিয়ে অমুক্তিদেরও ঢুকিয়ে দিতাম লিস্টে। সবাইকে না। যারা আগে আমাদের সাথে বানচোতগিরি করেছিল তাদেরকে। এখনো মনে আছে আমার, আজাদ একবার আমাকে গালি দিয়েছিল 'রাজাকারের বাচ্চা'। ওরে রাজাকারগিরি দেখানো হয়েছিল। বোঝানো হয়েছিল যে রাজাকারদের গালি দিতে নেই। রাজাকাররা তোমাদের আব্বা হয়। ন্যাংটা আজাদ যখন গ্রামময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল আমরা তা দেখে আমোদিত হয়েছিলাম।

হাজী সাহেব ভালোমানুষ টাইপের লোক ছিলেন। সাদা দাঁড়ি-সাদা চুল-সাদা ভ্রু। স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার। পাকিদের সাথে সম্পর্ক রাখেন নাই। একদিন বাজারে সবার সামনে চড় মেরেছিলাম তাকে। আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলে হারামজাদা। পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গিয়েছিল। থাপড়া খেয়ে বুড়ার চোখে পানি ছলছল করছিল। কিন্তু গাল বেয়ে নিচে নামে নি। বৃদ্ধদের চড়িয়ে মজা আছে। বয়সের জন্য চামড়া লুতুলুতু হয়ে যায়। পরেরদিন হাজী সাহেব মারা যান। চড় খেয়ে না। গলায় দড়ি দিয়ে। শালার বাঙ্গালী। কিছুদিন পর তার ছেলের বউকে 'ক্যাপ্টেন' সাহেবের কাছে পাঠাই। উনি খুশি হয়েছিলেন।

ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম। এক বনে এক বাঘ থাকে। প্রতিদিন তার গুহার সামনে একটি করে পশু রেখে আসতে হয়। একাত্তরে গল্পটার অন্য সংস্করন দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের এলাকার মিলিটারীদের লিডার ছিল এক ক্যাপ্টেন। নাম স্মরন নাই। এটা খুবি লজ্জার কথা। উনি আমাকে যথেষ্ঠ স্নেহ করতেন। ভালো মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। এক ওয়াক্ত নামাযও তাকে কাযা পড়তে দেখি নাই। ক্যাপ্টেন সাহেবের দুইটা নেশা ছিল। মদের নেশা আর 'কাঁচা মাংসের নেশা'। প্রতিদিন তাকে 'কাঁচা মাংস' দিতে হত। মাঝে মাঝে তার খাওয়া মাংস আমরাও খেতাম। যেদিন যেদিন মাংসে আমরাও মুখ দিতাম সেসবদিন শিকারের অবস্থা কাহিল হয়ে যেত। সাবিহাতো লোড নিতে না পেরে মারাই গেল। দিনগুলি মিস করি। সেইযে আমার নানা রঙের দিনগুলি।

বর্তমানে চোখ ফেরাই। আমি এবং আমার শান্তিবাহিনীর ভাইয়েরা এখন আর রাজার মত না থাকলেও খুব একটা খারাপও যে আছি তা না। এখন আমি কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেই, হাতে থাকে তসবিহ (এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনি), চোখ মুবারকে সুরমার ছোঁয়া দেই, কড়া আতরের গন্ধে নিজেরই মাথা ধরে যাওয়ার অবস্থা। আগে বেশ কষ্ট হত এমন অভিনয় করতে। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বেশ লাগে। তাছাড়া উপায় কি? বাঙ্গালী রং-ঢং ভালো পায়। ধর্ম নিয়া ঢং আরো ভালো পায়। এটা অবশ্য ব্যাকআপ ব্যবস্থা। বাঙ্গালী হল গোল্ডফিস। কয়েক সেকেন্ড আগের পুটুমারা খাওয়াও মনে রাখতে পারে না। অবিশ্বাস?? এইত সেদিন শিবিরের নতুন এক ছেলে এসে পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়ে গেল। পোলার ছোট খালার নাম সাবিহা। সেই সাবিহা যে লোড নিতে পারে নাই। সে যখন পায়ে হাত দেয় আমার আবার ওর খালার কথা মনে পড়ে যায়।

ভবিষ্যত?? ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ। আমাদের তরুন তুর্কীরা রগ কাটার কাজে হাত পাকিয়েছে। ভবিষ্যতে তাদেরকে গলা কাটার ট্রেনিং দেয়ার পরিকল্পনা আছে। কিছু কিছু মানুষ অবশ্য আজকাল বেশ ঝামেলা পাকাচ্ছে 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই' স্লোগান তুলে। আপাতত কাজ হল নিজেদের সংঘবদ্ধ করা ও শক্তি সঞ্চয় করা। সময়-সুযোগ বুঝে মরন কামড় বসাতে হবে। পবিত্র পাকিস্তানের সাথে হয়তবা মিলতে পারবো না। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশকেই একখন্ড
পাকিস্তান বানানোর প্ল্যান আছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

কালকে আবার 'মুক্তিযুদ্ধঃ আমার অহংকার' নামের একটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যেতে হবে। কি যে যন্ত্রনা।!!-

Imran Niloy

No comments:

Post a Comment