"অন্য" ব্যান্ড এর ভোকাল প্রতীক তার মরহুম বাবার ডায়েরিতে লেখা একটা কবিতা নিয়ে বসেছে । মিউজিক করার চেষ্টা করছে । সুরও ঠিক করে ফেলেছে । আজ ব্যান্ডের সবাইকে নিয়ে বসেছে । খুলে বললো গানটার পিছনের কথা ।
প্রতীকের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন । যুদ্ধের আগে কবিতাটি লিখেছিলেন । যা গত কয়েকদিন আগে প্রতীক তার বাবার ডায়েরি খুঁজে পায় । প্রথম পড়াতেই তার মনে ধরে যায় । আন্ডারগ্রাউন্ডের কয়েকটা ব্যান্ডকে নিয়ে মিক্সড এ্যালবাম বের হবে । সেখানে তার এই গানটা সিলেক্ট হয় । আর সে গানটার মিক্সিং এর কাজ অল্প কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হবে । গানটার লিরিকটা শোনা যাক--
যদি হারিয়ে যাই
কথা : দেলোয়ার হোসেন
সুর : প্রতীক
ব্যান্ড : অন্য
আমি যদি হঠাৎ হারিয়ে যাই
ভীষণ দু:খী মানুষের মতো
আমি যদি নিঃসঙ্গ কষ্টে
কামনার সময়কে ফাঁকি দিই
তবে কি তুমি উদাসীন আবেগে
জর্জরিত হবে না,সীমাহীন শূন্যতায়
ছড়াবে না দীর্ঘশ্বাস ?
প্রিয়তম সময় চুপচাপ
বুকের গোপন হাড়ে যন্ত্রণার
চমৎকার বিরহ মানচিত্র আঁকে ।
স্মৃতিমগ্ন কয়েকটি বৎসর,
উষ্ণ ভালবাসায় কঠিন অপেক্ষা
আজ অভিমানে ছিঁড়ে ফেলে সমস্ত উচ্চাকাশ ।
ইচ্ছে করে নিজেকে দুঃখ দিয়ে যদি
তোমার গভীরতম অবহেলার
চরম কৃতিত্ব অর্জন করতে পারি,
আমি সূর্যকে ডেকে বলবো
তুমি ক্লান্ত ভীষণ,
এবার আমাকে জ্বলতে দাও ।
২
গানটা ভালোই হিট হয় । "আনন্দ আলো" তে তাদের ব্যান্ড নিয়ে একটা ফিচার হয় । তখন তাদের এই গানটার কয়েকটা লাইন তুলে ধরা হয় । সবাই প্রশংসা করে তাদের । এ গল্পটার এখানেই শেষ নয় । শুরু । আফরিনা নামক এক মহিলা এই ফিচার পড়েন । তারপর "অন্য" ব্যান্ড এর ভোকাল প্রতীকের সাথে দেখা করতে চান । প্রতীকের নাম্বার সংগ্রহ করে উনি চলে যান প্রতীকের বাসায় ।
৩
প্রতীকের ড্রয়িং রুমে গিয়ে প্রতীকের বাবা দেলোয়ারের ছবি দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন । জিজ্ঞেস করেন, দেলোয়ার কই ? এই মানুষটাকে আমি ৩৯ বছর ধরে খুঁজছি । তোমার কি হন তিনি ? প্রতীক সময় নিয়ে বলে, আপনি রিলাক্স হয়ে বসেন । আমি আপনাকে সব বলবো । দেলোয়ার হোসেন আমার বাবা । দুই বছর হলো মারা গেছেন । আমি বাবার একমাত্র ছেলে । আফরিনা প্রতীককে জড়িয়ে ধরে বললেন,তুমি দেলোয়ারের ছেলে ? আমি তোমার আন্টি । "যদি হারিয়ে যাই" গানটা তুমি কই পেলে ? এই কবিতাটা তো দেলোয়ার আমার জন্য লিখেছে । ও আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় । কিন্তু আমি সাড়া না দিয়ে ওকে অপমান করেছি । এটা ৬৯ এর ঘটনা । তারপর এই কবিতাটা ও আমাকে লিখে দেয় । পরে ৭০ এর দিকে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক হয় । কারণ এ কবিতাটা আমার মনে খুব ধরে । কিন্তু তোমার কাছে আসলো কিভাবে ? প্রতীক তার বাবার ডায়েরিটা এনে দেখালো । আফরিনা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন । দেশ স্বাধীনের ৩৯ বছর পর ফিরে পেলেন তার ভালোবাসার মানুষের ঠিকানা । কিন্তু মানুষটাকে পেলেন না ।
৪
প্রতীক আফরিনার কাছে সব জানতে চাইলো । আফরিনা খুলে বললেন সবকিছু ।
ঢাকা ভার্সিটিতে একই বিভাগে ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন দুজনে । ১৯৭০ এর প্রথম দিকে দু'জনে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন । পড়ালেখা শেষে বিয়ে করার পরিকল্পনা করেন । কিন্তু ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় । আফরিনা বেনাপোল বর্ডার দিয়ে ভারতে চলে যান । আর দেলোয়ার যুদ্ধে যোগ দেন । শেষ বার যখন দেখা হয় তখনো জানতেন না এটা তাদের শেষ দেখা । দেশ স্বাধীন হয় । তিনি দেশে ফিরে আসেন । খুলনায় বাবার বাড়িতে উঠেন । আবার এই বাড়ির ঠিকানা দেলোয়ার জানতেন না । আফরিনা কয়েক বার ঢাকায় আসেন দেলোয়ারের খুঁজে । হলে খোঁজ নেন । কিন্তু পাননি । বিয়ে করেননি । অপেক্ষায় ছিলেন একদিন আসবে ফিরে দেলোয়ার । মাঝে মাঝে ভাবতেন মানুষটা মারা গেছে বোধহয় যুদ্ধে । প্রচন্ড ভালোবাসার কারণে আর কোন সম্পর্কে জড়াননি । সাধারণ একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবনটা পার করে দিয়েছেন ।
এই কথাগুলো বলে কাঁদতে লাগলেন তিনি । প্রতীক পাশে গিয়ে বসে কিছু বলতে চেষ্টা করলো । কিন্তু বলা হয়নি । উনি প্রতীকের মাথায় হাত রেখে বলেন, আমাদের স্বপ্ন ছিল সংসার করবো । আমাদের সন্তানরা স্বাধীন দেশে বেড়ে উঠবে । বাংলা ভাষা চর্চা করবে । তুমি তোমার বাবার স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখো । তোমার বাবা আমাকে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছেন কিন্তু সংসার দিতে পারেননি । মানুষটার কোন দোষ নেই । হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে প্রতিদিন । সেও ভেবেছে আমি মারা গেছি । তোমার মা কই ? প্রতীক চুপ করে থাকলো । প্রতীকও কাঁদছে । হঠাৎ বললো, আন্টি আমার মা আমার জন্মের ৫বছরের সময় মারা যান । বাবা যুদ্ধের অনেক পর বিয়ে করেছেন । ১৯৮২ সালে । আমার জন্ম ১৯৮৪ তে । বাবাও বোধহয় আপনাকে অনেক খুঁজেছেন । এতো বড় বাসায় আমি একা থাকি । কোন কিছু করতে হয় না । বাসার ভাড়া যা পাই তা দিয়ে চলে যায় আমার । গান করি,পড়ালেখা করি ।
৫
একটা দেশ স্বাধীন হয় অনেক মানুষের ত্যাগের কারণে । সময় যায় মানুষ সেসব ভুলে যায় । একজন আফরিনা স্বাধীন একটা দেশ পেয়েছেন । আর কিছু পাননি । এরকম হাজারো আফরিনা হারিয়েছেন সবকিছু । কেউ বা স্বামী,কেউবা সন্তান,কেউ বা বাবা-মা । আমাদের প্রজন্ম কোনদিন জানতে চাইবে না সেসব আফরিনাদের কথা । তাদের সে সময় নেই ।
-মাহমুদুল হাসান রুবেল
No comments:
Post a Comment