Subscribe:

দিলিপ আর ন্য আয়ে

২২ নভেম্বর ১৯৭১: নির্দেশ এসেছে সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে। পাড়ি দিতে হবে সীমান্ত। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জাহাঙ্গীর আলমের(দিলীপ) নেতৃত্ব এগার জনের একটি গেরিলা দল প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন এই বিপদ সংকুল সীমান্ত যাত্রার জন্য। এগার জনের মধ্যে চার জন একে বারেই নতুন। ট্রেনিং এর জন্য যাচ্ছেন সীমান্তের উপারে।


যাত্রার আগে গভীর রাতে মায়ের কাছে এসেছেন বিদায় নেবার জন্য। অবুঝ মায়ের মনকে কি সহজে মানানো যায়?
 
মা বলেন,"যাসনে বাপ,থেকে যা আমার সাথে।"
 
স্মিত হেসে জাহাঙ্গীর আলম উত্তর দেন,"এখানে থাকলেতো পাঞ্জাবীরা মেরেই ফেলবে"।

মায়ের সরল স্বীকারোক্তি,"মারলে মারুক। এক সাথে মরবো।"

অবুঝ মাকে থামিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বিদায় নেন,"দোয়া করো মা। ফিরে আসবো তাড়াতাড়ি। "
 
➽ ২৩ নভেম্বর ১৯৭১: সহযোদ্ধা ছোট ভাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থেকে নৌকায় তুলে দেন পুরো দলটিকে। শুরু হয় অনির্দিষ্ট পথে যাত্রা।

➽ ২৭ নভেম্বর: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া। রাতে আশ্রয় নেবার জন্য পুরো দলটি থামল একটি বুদ্ধ মন্দিরে। পুরো দলটি সতর্ক। কারণ এই এলাকাটি বিখ্যাত দুই রাজাকারের তাণ্ডবে নিষ্পেষিত।
 
➽ ২৭ নভেম্বর মধ্যরাত: যা ভয় ছিল দলনেতা জাহাঙ্গীরের তাই হল। মধ্যরাতে পাকবাহিনীর একটি দল এবং রাজাকাররা ঘিরে ফেললো পুরো মন্দির। ধরা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা পুরো দলটির।
 
ধরা পড়লো জাতির এগার সূর্য সন্তান। পাকিস্তানিরা রাজাকারের পিঠ চাপড়া বাহবা দিতে লাগলো,"তুম লোগ সাচ্চে মুসলাম হো। ইয়ে মুক্তি লোগ কাফের হে। "
 
➽ ২ ডিসেম্বর ১৯৭১ : শেষ বারের মত দেখা গেল এই গেরিলা দলটিকে রাণীরহাট বাজারে। ট্রাকে তুলছে পাকিস্তানীরা। চোখে নেই কোন ভয়,রয়েছে তীব্র ঘৃণা পাকিস্তানীদের প্রতি। আর রয়েছে একটি স্বপ্ন,স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।

যুদ্ধ এক সময় শেষ হল। অনেকেই ফিরে এলো। কিন্তু ফেরেনা জাহাঙ্গীর। মা তবুও আশায় বুক বাঁধেন ছেলে ফিরে আসব। যে ছেলের বাঘের মত সাহস তাকে আটকে রাখা কি অতই সোজা? তাছাড়া ছেলে তাকে কথা দিয়েছিলো ফিরে আসবে।
 
এরপর? মা প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতে থাকেন তার প্রিয় ছেলে জাহাঙ্গীরকে। দেখেন ছেলে তার মাথার পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অভিমানের সুরে মা জিজ্ঞেস করেন,"কেমন আছিস বাবা তুই? ঘরে আসিস না কেন? রাতেই কেন শুধু আমার কাছে আসিস,দিনে কোথায় যাস?যুদ্ধতো অনেক আগেই শেষ। চুপ করে আছিস কেন? "
 
এভাবে কেটে যায় পাঁচটি বছর। পুত্র শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা জোহরা বেগম। বাসার সবাই চিন্তিত মাকে নিয়ে। এরপর আরও একদিন এলো দিলিপ মায়ের স্বপ্নে। তবে এবার এসে আর থাকলো না চলে গেল। মা জিজ্ঞেস করেন,"কোথায় যাস দিলিপ?কোথায় যাস?"

সেদিন দিলিপ আর জবাব দেয় নি। এরপর দিলিপ আর আসেনি মা জোহরা বেগমের স্বপ্নে। আর কখনোই না। দিলিপ চিরকালের মত হারিয়ে গেল রাতের আঁধারে। এখনো বেঁচে আছেন জোহরা বেগম। বয়সের ভারে নানা বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত জোহরা বেগম আজো ছল ছল করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠেন,

"আর দিলিপ আর ন্য আয়ে"।

==========

মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে৷
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা
তাঁরা কি ফিরবে না আর?
তাঁরা কি ফিরবে এই সুপ্রভাতে-
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে৷

মুক্তির মন্দির সোপান তলে...
লেখা আছে অশ্রুজলে ৷

==========



==========
পরিচিতি:  শহীদ জাহাঙ্গির আলম আমাদের পেইজের ফ্যান সরওয়ার আলম সাংকুর বড় চাচু। মাত্র ২১ বছর বয়সে স্বাধীন বাংলাদেশ এর স্বপ্নে বিভোর এই যুবক জীবনকে তুচ্ছ করে ভাইকে সাথে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে। মাকে কথা দিয়েছিলেন ফিরে আসবেন। কথা রাখেন নি। কিন্তু দেশ মা এর কথা রেখেছেন। স্বাধীন করেছেন এই দেশ। ৭১ এর ডিসেম্বর এর শুরুর দিক এ ১নং সেক্টর(চট্টগ্রাম) এর রানিরহাট নামক এলাকায় পাক বাহিনির হাত এ নিহত হন এই বীরযোদ্ধা। অনেক শহীদের মতই তার লাশও আর পাওয়া যায় নি। 




হে একাত্তরের বীর সেনানী,হে একাত্তরের মায়েরা,আমরা তোমাদের ভুলবোনা,তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেব না। এই শপথ নিলাম আজ এই বিজয়ের মাসে ।




-সাদমান সাদেক

No comments:

Post a Comment