Subscribe:

অতৃপ্তি

অনেক দিন পর কম্পিউটার টা নিয়ে বসলাম । আম্মার কঠোর নিদের্শে ওটাকে মামার বাসায় শিফট্ করা হয় । প্রায় ২ মাস পর কম্পিউটার নিয়ে বসেই ডেল্টা ফোর্স (black hawk down) গেমটা খেলতে বসে গেলাম । অনেক পুরোনো গেইম ।কিন্তু এটাই আমার ভাল লাগে । মামার রুম এর দরজাটা লাগিয়ে , ফুল ভলিউমে খেলতে লাগলাম ।


হটাত্‍উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ । তাও আবার একাধিক কন্ঠের । ঐ আওয়াজটা এতো বেশিই ছিল যে আমার এতো হাই ভলিউমের গেমসের গোলাগুলির শব্দকেও হার মানালো ।

ভয় পেয়ে গেলাম । লাফ দিয়ে উঠে দাড়িয়েই দৌড়দিলাম শব্দের উত্‍স লক্ষ্য করে । খেয়াল করলাম শব্দটা নানাভাইয়ের ঘর থেকে আসছে । অজানা আশংকায় কেপে উঠলো বুক । আমার চলার গতি একদম কমে গেলো ।
ইদানিং নানাভাই বেশি অসুস্থ । অসুস্থতার কারন জানতে ঢাকার ল্যাবএইড , পিজি , এপোলো সহ আরো অনেক জায়গায় বিভিন্ন টেস্ট করা হয়েছে । ছোট মামা ডাক্তার হওয়ায়, বিভিন্ন বড় বড় ডাক্তারকেও দেখানো হয়েছে । কিন্তু কোন ফলই পাওয়া জায়নি ।
নানাভাই ঢাকা থাকতে মোটেই পছন্দ করেন না । তাই তাকে কুমিল্লায় নিয়ে আসা হয়। প্রচন্ড অসুস্থ তিনি । কিছুই খেতে পারেন না । তাছাড়া খাট থেকে উঠতেও তার। ভীষন কষ্ট হয় ।
বড় খালামনি ঢাকা থেকে এসে গেছেন । তার কোন ছেলেমেয়ে নেই । ফলে তার কুমিল্লা থাকতে কোন সমস্যা হবে না । তাছাড়া নানাভাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান তিনি । নানাভাইয়ের রুম এ ঢুকে দেখি । সবাই কাদছেন ।
আমি অবাক ! হতভম্ব হয়ে গেলাম সেদিন । কেনো যে তারা কেদেছিলেন ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি ।

ঐ দিন দুপুরে মামা তার এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে এলেন । ঐ ভদ্রলোক নানাভাইকে দেখে , বিভিন্ন চেকাপ করালেন । আমি তখন তাকিয়ে ছিলাম মামার দিকে । মামার চোখে কেমন যেনো একটা বিষন্নতা , হাহাকার ! অবাক হলাম । কেননা মামা সবসময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করেন । তাহলে আজকে কি হল ? রাতে বাসায় এসে আম্মাকে ঐ কান্নার কারন বলার জন্য চাপাচাপি করতে লাগলাম । আম্মা জানালেন যে , নানাভাইয়ের নাকি লিভার সিরোসিস হয়েছে ।
এটা শুনে সবাই কাদছিলো , আর বেচারা নানাভাই সবাইকে কান্নার কারন জিগ্গেস করতে করতে , সবার এই সম্মেলিতো কান্না দেখে নিজেই কেদে দিয়েছিলেন ।
কয়েকদিন পর আবার নানাভাইকে দেখতে যাই । এরই মধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে যে নানাভাই আর বেশিদিন বাচবেন না । তার পাকস্থলিতে ক্যান্সার হয়েছে । সবাই মনমরা থাকে । আমারও তেমন ভাল লাগে না ।

ঐ দিন নানাভাইয়ের রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছি । হটাত্‍নানাভাই ডাক দিলেন। কাছে গেলাম । আম্মা নানাভাইয়ের পাশেই বসে ছিলেন ।

নানাভাই বললেন "কে রে ?"
আমি নানাভাইকে দেখে ভয় পাই এখন । ওনার চোখ মুখ সববসে গেছে । মুখের আর শরিরের সব হার গোনা যায় ।কথাও তেমন স্পস্ট নয় । আমি ভয়ে কথা বললাম না ।

আম্মা বললেন "আব্বা । সানভি আসছে ।"

নানাভাই বললেন "সানভি নি রে ! ও । কেমন আছ নানাভাই?"

আমি বললাম "ভাল আছি ।"

আম্মা আবার বললেন "আব্বা । সানভির তো সামনে SSC পরিক্ষা । দোয়া কইরেন যাতে A+ পায় ।"

নানাভাই বললেন "তে তো A+ পাইবো । কিন্তু আমি তো দেইখা জাইতে পারমু না ।"

কষ্টের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো শরীর দিয়ে । দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম ।

এর ৮-১০ দিন পর ।

বৃহঃস্পতিবার ছিল । আমার সামনে টেস্ট পরিক্ষা । পড়াশোনা নিয়ে একটু বেশিই সিরিয়াস ।

বিকালে বাসায় এসে দেখি , বাসায় আব্বা আম্মা নেই । ছোট বোন দুইটাকে জিগ্গেস করাতে বলল , তারা নাকি নানাভাইকে দেখতে হসপিটালে গেছে ।বুঝলাম না কেনো নিয়ে গেলো হসপিটাল । নানাভাই তো হসপিটাল পছন্দ করেন না । এই সব কথা চিন্তা করতে করতেই ফোন এল । রিসিভ করলাম ।

আব্বা ফোন করেছেন । বললেন
"তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসো । তোমার নানাভাই তোমাকে দেখতে চেয়েছেন ।"

তাড়াতাড়ি আমার ছোট বোন দুটোকে নিয়ে কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেলে রওনা দিলাম । এতদিন নানাভাইকে দেখতে যাই নি বলে একটা অপরাধবোধে ভুগছিলাম । পৌছেই সরাসরি নানাভাইয়ের কেবিনে ঢুকলাম । ঢুকে দেখি , আমাদের কুমিল্লার প্রায় সব আত্মীয়রা উপস্থিত । নানাভাই বেডে শুয়ে আছেন ।
বড় খালা তার মাথার কাছে কুরআন তিলাওয়াত করছেন ।

খালা আমাকে দেখে নানাভাইকে বললেন "আব্বা ।সানভি আসছে তো । আপনে না তারে
দেখতে চাইছিলেন ।"

নানাভাই যেনো একটু চোখ মেললেন । আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম । নানাভাই পুরো নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে আছেন । হটাত্‍কয়েকজন ডাক্তার আর মামা ঢুকলেন কেবিনে । মামা নানাভাইয়ের বুক পাম্প করতে লাগলেন । আর অন্যান্য ডাক্তাররা তার পালস্ চেক করতে লাগলেন ।

একটু পর মামা চিত্‍কার করে কেদে দিলেন । আর বাদ বাকি ঘড়ের সবাইও কাদতে লাগলেন । আমি স্তব্ধ । চেয়ে আছি নানাভাইয়ের দিকে । যেনো তিনি ঘুমিয়ে আছেন । একটু পরই জেগে উঠে আমাকে বলবেন "নানাভাই তুমি আসছো?" আমি কাদি নাই । বিস্ময়ের ধাক্কায় কাদতে ভুলে গিয়েছিলাম ।

নানাভাইয়ের লাশ  নিয়ে রাতে গ্রামের বাড়িতে যাই। শুক্রবার জুম্মার পর তাকে দাফন করার কথা ঠিক হয় । ঐ দিন আশে পাশের গ্রামের অসংখ্যা মানুষ তার জানাজায় হাজির হয়েছিলো । তিনি মানুষকে নিস্বার্থভাবে ভালবেসেছেন । মানুষও তাকে ভুলে যায়নি ।

বিকালের দিকে নানাভাইকে দাফন করে সবাই চলে যায় ।

আমি চুপচাপ নানাভাইয়ের কবরের পাশে বসে থাকি । মনে পরে যায় কিছু স্মৃতি ।

ছোট থাকতে নানাভাই আমাকে কাধে নিয়ে ঘুড়তেন । অসংখ্যা গাছ লাগাতেন ।আমাকে দিয়েও লাগাতেন । আর বলতেন এই গাছগুলোর প্রত্যেকটা পাতা নাকি আমার মৃত্যুর পর আমার জন্য দোয়া করবে ।

কথনো তিনি আমাকে বকাঝকা করেন নি । যখন নানুবাড়িতে যেতাম অত্যন্ত ধার্মিক মানুষটি আমাকে নিয়ে নামাযের জামাআত এ যেতেন । গিয়ে সবাইকে বলতেন "এই দেখো আমার নাতি ।" পরপোকারি , নিস্বার্থ মানুষটি একজন সত্‍স্কুল শিক্ষক ছিলেন । কখনো অন্যায়ের সামনে মাথা নত করেননি । মানুষের জন্য একদম নিস্বার্থ ভাবে অনেক কাজ করে গেছেন । আমাকে বলতেন ন্যায়ের পথেচলতে । মানুষকে সাহায্য করতে ।
তার আদর্শে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি ।

"নানাভাই জানো আমি A+ পেয়েছি । আমার লাগানো কাঠাল গাছ , পেয়ারা গাছে এখন অনেক ফল ধরে । জানো ? এখনো বাড়িতে গেলে মনে হয় এই বুঝি জড়িয়ে ধরে আদর করবে । এখন আর কেউ আমাকে ফজর নামাজ পড়ে এসে আমার হাতে একটা বাতাসা গুজে দেয় না । তোমার মত কেউ এখন আর আদর করে কপালে চুমু খায় না । তোমার লাগানো গাছগুলো এখনঅনেক বড় হয়ে গেছে । সেই গাছ গুলোর প্রত্যেকটা পাতা নিশ্চই তোমার জন্য দুয়া করে তাই না ?

আচ্ছা নানাভাই আমার কি কোন ভুল হয়েছিল ?যদি না হয়ে থাকে , তাহলে কেনো এভাবে কিছু না বলে চলে গেলে ? ?"

নানাভাইয়ের শেষ ইচ্ছা ছিল আমাকে একটু দেখার । হয়তো তার সে ইচ্ছা আমি পূরন করতে পারি নি । এক দুঃসহ অতৃপ্তি রয়ে গেছে বুকের গভীরে । আল্লাহতালার কাছে আজকে আকুল আবেদন । আল্লাহ যেনো এই নিঃস্বার্থ মানুষটাকে জান্নাত বাসী করেন ।

FB ID: Ahnuf Sunvee

No comments:

Post a Comment