Subscribe:

অবকাশের বিচিত্র সমাপ্তি

মহেশপুরে মেলা চলছে। এ নিয়ে গ্রামবাসীর উৎসাহ ও উত্তেজনার শেষ নেই। নিস্তরঙ্গ এক গ্রামে জনকোলাহলের ঢেউ পড়ে গেল। সৈকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শীতকালীন অবকাশে সে তার গ্রাম মহেশপুরে এসেছে। মেলার মাঝামাঝি সময়ে এলেও মেলা দেখতে সে গেছে শেষ দিন – মেলারও শেষ, তার ছুটিরও সমাপ্তি।


মেলায় এ...সে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মেলা নামে চললেও এখানে মূল আকর্ষণ যাত্রা, চরকা খেলা নামক জুয়া আর লটারিতে। কিছু দোকানপাট আছে অবশ্য, সেখানে ভাল কোন জিনিস নেই। তবু অসম্ভব ভীড়, ভীড় সারা মেলা জুড়েই।

এক পাড়াতো ভাইয়ের জোরাজুরিতে অনিচ্ছা স্বত্তেও সে একশ টাকা দিয়ে একটি লটারি কিনেছে। সেই লটারিও অদ্ভুত কিসিমের - নাম, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার লিখে দিতে হয়। টিভি-ফ্রিজ, হুন্ডা আরও বহু কিছু মিলিয়ে লাখ লাখ টাকার পুরস্কার দেয় নাকি। সৈকতের পাড়াত ভাই মারাত্নক উৎসাহী হয়ে আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে তো ফেলেও দেয়া যায় না, মানি ব্যাগে ঢুকাল সে লটারিটা। 

সন্ধ্যার মধ্যে বাড়িতে চলে গেল সে। কাল সকালে তার ট্রেইন। সব গোছাতে হবে।


২ 
আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে সৈকত বসে আছে। কুমিল্লার আগে একটি মালবাহী ট্রেইন লাইনচ্যুত হয়েছে। মহানগর প্রভাতী আসতে ৩ ঘণ্টা দেরি হবে। 

বাচ্চা একটি ছেলে এসে দাঁড়াল তার সামনে। করুণ গলায় বলল, ভাইয়া, ১০টা টেকা দিবেন? কাল দুপুর থেইকা কিছু খাইবার পারি নাই। ভাত খামু।

সৈকত পাষাণ হৃদয়ের নয়। সে বলল, আমার সাথে হোটেলে চল। তোর বিল আমি দিয়ে দিব।

ছেলেটি ফাঁপড়ে পড়ে গেল। সে বলল, না ভাই, আপনারে এত টাকা খরচ করতে দিমু না, ১০ টাকাতেই হইব!

সৈকত বলল সে কোন টাকা দিবে না। খাওয়ার বিল দিতে পারবে।

ছেলেটি সৈকতের দিকে তাকিয়ে ভয়াবহ এক গালি দিয়ে দৌড়াতে লাগল। সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকায় সামনে এক কুলির গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। মাথায় বড় ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে থাকা কুলিও পড়ে গেছে। পড়ে থাকা অবস্থাতেই কষে এক চড় বসিয়ে দিল সেই বাচ্চাটির গালে। 

১১ টা ৩৩ এর ট্রেইন আসল ২ টা ২৫ এ। সৈকতের পাশে দুই বয়স্ক ভদ্রলোক রাজনীতি নিয়ে কঠিন আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন। এক পর্যায়ে তা তর্ক-বিতর্কে পরিণত হল। এক জন আওয়ামী লীগই সেরা, অন্য জন বিএনপিই ভাল বলতে চান।

সৈকত বিরক্ত হয়ে গেল। এক আমলে জীবন শঁপে দিতে হবে হাওয়া ভবন আর মৌলবাদীদের হাতে। আরেক আমলে জাতি পুড়বে শেয়ার বাজার আর ‘বন্ধুপ্রতিম ভারতের’ আগুনে। রাজনীতি নিয়ে সব আলোচনা ও ভাবনাই কী দিনশেষে অর্থহীন নয়?

সে উঠে বগির দরজার সামনে চলে গেল। 

ট্রেইনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সৈকত। এক দল হিজড়া এসে তাকে ধরল। 
-কী রে নায়ক! তুই কোথায় যাবি? 
-আমি ঢাকায় নামব। 
-আমরাও ঢাকায় যামু। নায়ক তোর শার্ট তো সুন্দর – সৈকতের গায়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে দলনেতা বলল। 
সৈকত বুঝল এরা ঝামেলা করবে। মানি ব্যাগ বের করে সে ১০ টাকা বের করল। 
দলনেতা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, তোর সাথে কি টাকার সম্পর্ক চাই আমি! আয় না নায়ক আমার বুকে? 

কিছুটা ভয়ার্ত গলায় বলল, সরুন, আমি আমার সিটে চলে যাই। 
হিজড়া দলনেতা বলল, না তুই আমার সিটে চল। আমার কোলে বসাবো তোমারে বন্ধু! – বেসুরো গলায় গানের মত করে অনবরত গেয়ে যাচ্ছে বৃহন্নলার দল। 

অবশেষে সন্ধ্যার আগেই বাসায় এসে পৌছেছে সৈকত। তার মনে হয়েছিল এই ট্রেইন কোন দিনও বুঝি আর গন্তব্যে পৌছাবে না। কিন্তু ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই পৌছে গেল।

বাসায় ঢুকতেই সৈকতের ৫ বছর বয়সী ভাগ্নে নিভৃত বলল, আমার জন্য কী এনেছ মামা?

তার বোন ও ভাগ্নে আজ সকালেই তাদের বাসায় এসেছে। সৈকত তা জানত না। সে বলল, ভুল হয়ে গেছে, কিছু তো আনি নি মামা!
-কেন, আমার জন্য না বড় হাতি আনবে বলেছিলে?
-হাতি তো পাই নি আব্বু। অন্য কিছু দিলে হবে?
-এক লক্ষ টাকা দাও তাহলে।
-এক লক্ষ টাকা কত জান?
-হ্যাঁ, অনেকগুলো ৫০০ টাকা।
-অনেকগুলো ৫০০ টাকা দিয়ে তুমি কী করবে?
-খেলব। বাসার সবাইকে প্রতি দিন একটি করে দিব!

সৈকত হেসে ফেলল। বলল, একদিন অবশ্যই তোমাকে এই উপহার দিব মামা, তোমার খেলার বয়স সেদিন হয়ত থাকবে না। তবুও দিব।

রুমে শুয়ে আছে সৈকত। ছুটি ও ট্রেইন জার্নির ধকল তার চোখে-মুখে। তার মোবাইল বেজে উঠল। কিন্তু রিসিভ করতে ইচ্ছা করছে না।

আবার বাজতে শুরু করেছে সেটি। অনিচ্ছার সাথে সে তা রিসিভ করল।
-হ্যালো, জুবায়ের হোসেন সৈকত বলছেন?
-জ্বী।
-আমি মহেশপুর মেলা কমিটির সভাপতি। গতকাল মেলার শেষ দিনে আপনি একটি টিকেট কিনেছিলেন যেটির নাম্বার T2605। আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, এটি কাল প্রথম পুরষ্কার লাভ করেছে। আপনি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এসে পুরস্কার নিয়ে যাবেন। পুরস্কার হল - একটি মোটর সাইকেল অথবা নগদ এক লক্ষ টাকা। আপনি কোনটি নিতে চান? 

কিছু না ভেবেই সৈকত বলল, এক লক্ষ টাকা।

ড্রইং রুমে খেলতে থাকা নিভৃতর কাছে গেল সৈকত সাথে সাথে। আনন্দিত গলায় বলল, মামা, আমি তোমার খেলনা এক লক্ষ টাকা কালই দিয়ে দিব।

নির্বিকার ভঙ্গিতে নিভৃত বলল, তোমার কালকের ৫০০ টাকা রেখে বাকিটা দিও!
                                               --------------------0---------
-----------

Sazib
30.12.11

No comments:

Post a Comment