Subscribe:

শুন্যতার খসড়াপত্র

“নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে- চলে আসে নতুন সময়-

                     পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,

                     নতুনেরা আসিতেছে ব’লে!-


                     আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্থলে

                     কোনো এক মানুষীর তরে

                     যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে!”

                                                                                                                                      - জীবনানন্দ দাশ

                                      …………………………………
 

দীপা তার রাজপুত্রের সন্ধান পেয়েছে।

দীপা তার মায়ের পছন্দমতো একজন সত্যিকারের রাজপুত্রের সন্ধান করছিলো। কথাটি আমাকে বেশ কয়েকবার বলার পরও আমি ভেবেছিলাম সে ঠাট্টা করছে; অভিমানের শোধ নিচ্ছে। একদিন ক্যান্টিনে বসে খাবার সময় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে বলেছিলো, সবার আগে সে আমাকেই তার রাজপুত্রকে দেখাবে। তার চোখের ভাষা সেদিন আমি বুঝতে পারিনি।

এরপর হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা বাসায় ফোন করে জানালো-সন্ধ্যায় সে আসছে। সাথে তার রাজপুত্রও থাকছে।

আমি তখনও বুঝতে  পারিনি কী হতে চলেছে। খাওয়ার সময় হঠাৎ অনুভব করলাম, ছোটো বাচ্চাদের মতো অভিমান হচ্ছে। খেলার পুতুল ভেঙে যাওয়ার মতো কষ্ট হতে লাগলো আমার।

বিকেলবেলা নিজের  ছেলেমানুষী নিজের কাছেই  অসহ্য মনে হলো। ফোন অফ করে বেড়িয়ে পড়লাম আমি।

উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ক্লাবে পৌছে গিয়েছিলাম। অসীম আমায় দেখতে পেয়ে সান্ধ্যকালীন একটা আবৃত্তি শো দেখাতে নিয়ে গেলো।

রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণকুন্তি সংবাদ’ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এরপর আবার কখন জেগে উঠেছিলাম, কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, মাঝরাতে সেদিন অসীমের দরজাতেই কড়া নেড়েছিলাম রাতটুকুর আশ্রয়ের জন্য।

সেদিন সন্ধ্যায় দীপার রাজপুত্রের সাথে আমার দেখা হয়নি। নীল রঙের গাড়িতে করে দীপার আর তার রাজপুত্র এসে বসে ছিলো অনেকক্ষন। আমি জানিনা দীপার প্রিয় রং নীল কিনা। তবে সে হয়তো বেশ পছন্দই করেছিলো সেই নীল গাড়ী আর গাড়ীর নীলরক্তের মালিকটিকে।

একদিন আমার সব বন্ধুবান্ধব মিলে মহা সমারোহে দীপার বাসা থেকে মিষ্টিমুখ করে এলো। দীপার রাজপুত্র-ভাগ্য দেখে বন্ধুরা চমৎকৃত হলো, বান্ধবীরা হিংসে অনুভব করলো। আমি সেখানে থাকার সাহস করে উঠতে পারিনি।

মনে মনে বুঝতে  পেরেছিলাম, অচেনা কোনো রাজ্যে হারিয়ে গেছে দীপা। তাকে ফিরে পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই আমার।

এরপর একটি বছর দীপার সাথে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়নি। এ সময়টা আমার কিছুটা অন্যরকম কেটেছে। ক্লাসে গিয়ে টের পেতাম দীপা নেই। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসতাম। বাসায় এসে মনে হতো সময় কাটানোর মতো কিছু অবশিষ্ট নেই। তখন চুপচাপ ফেসবুকে বসে থাকতাম।

পারিবারিকভাবেও  আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম। রাজনৈতিক কারনে বাবাকে জেলে যেতে হলো। আমার দু বছরের বড় হাসিখুশী বোনটি ডিভোর্স পেয়ে বাসায় ফিরে এলো। এসময় ছোটো মামা আমাদের পাশে এসে দাড়ালেন। তিনি মাকে আশ্বাস দিলেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এর কিছুদিন পরে মামার ছোটো কন্যাটি আত্মহত্যা করলো হৃদয়ঘটিত কারনে।

আমার চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এলো। একমাত্র পুত্র হিসেবে কিছুই করতে পারিনি আমি। প্রচন্ড রকমের আত্মগ্লানি হতে লাগলো তখন। আমিও হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলতাম, কিন্তু আমি বড্ড ভীরু হয়ে জন্মগ্রহন করেছি। নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা আমার।

বন্ধুদের খোজখবর নিতাম না বলে সবাই একে একে দূরে সরে গেলো। অসীম আর অল্প কয়েকজন শুধু থেকে গেলো। তারা মাঝে মাঝে আসতো।

অসীম আমার সবচে কাছের বন্ধু ছিলো। সে আমাকে তার বাইকে করে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতো। আমার মন ভালো করার চেষ্টা করতো। তার এই সহজ-সরল চেষ্ঠা দেখে আমি লজ্জা পেতাম। আমার লজ্জাবোধ তখনো কিছুটা অবশিষ্ট ছিলো।

আমি নিস্তার  পেতে চাইছিলাম। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর খুঁজে পেলাম না। তাই আমি আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসতে চাইলাম।

অসীমের সহায়তায় কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে জড়িয়ে গেলাম। শীতবস্ত্র সংগ্রহ, রক্তদান কর্মসূচী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্তর্জালে সামাজিক যোগাযোগেও কিছুটা আসক্ত হয়ে পড়লাম। আমার একঘেঁয়ে জীবন কিছুটা স্বস্তিকর হয়ে উঠলো।

একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ করেই দীপার ছোটোবোন লোপার সাথে দেখা হয়ে গেলো। ছোটোবেলায় বাসায় গেলে যে সবার আগে ছুটে এসে আমার কোলে বসে দিদির গান শুনতো, সে অনেক বড় হয়ে গেছে এখন।

আমি তাকে এড়াতে চাইছিলাম, তাই না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সে আমায় দেখতে পেয়ে লাফিয়ে উঠলো। কলকল করে অনেক কথা বলে ফেললো যার বেশীরভাগই আমার মাথায় ঢোকেনি। যাবার সময় যখন সে আমায় পাশের দোকান থেকে জীবনানন্দের ‘ধুসর পান্ডুলিপি’ কিনে উপহার দিলো, কেবল তখনই আমার তাকে আইসক্রীম খাওয়ানোর কথা মনে পড়েছিলো।

এরপর থেকে দীপার স্মৃতি আমায় আর কাতর করতো না, আমি হয়তো মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। চারদিক থেকে আমায় এত এত অন্ধকার গ্রাস করে ফেলেছিলো যে আমি অবসাদগ্রস্তের মতো হয়ে পড়েছিলাম। নিরাসক্তিই তখন আমার সবচেয়ে বড় আসক্তি হয়ে ধরা দিয়েছিলো। তবুও মাঝে মাঝে কোনো নক্ষত্রের রাতে ঘুম ভেঙে যেতো, তখন লোপার দেয়া ধুসর পান্ডুলিপির পাতা ওল্টাতাম। সুদর্শনাকে মৃত ঘোষনা করে আমি হেমন্তের ঝরা পাতা হয়ে পথের বুকে ঠাঁই নিয়েছিলাম। নির্জীবের মতো পথের ধারে পড়ে থেকে উপলব্ধি করলাম, এটাই আমার সত্যিকারের নিয়তি।

বছরের শেষদিনগুলো বেশ দ্রুতই কেটে গেলো এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দীপার সাথে আবার দেখা হয়ে গেলো, বোধহয় পরিকল্পিতভাবেই। আমাকে নীল গাড়ীটা পাঠিয়ে অনেকটা জোর করেই উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। যে হারমোনিয়ামটা বাজিয়ে একসময় বহু রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলো, সেটার পাশে বসে সে এমনভাবে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইলো, আমার মনে হলো ভুলগুলো যেন আমারই ছিলো। আমার কাছে কখনোই কোনো কৈফিয়তের উত্তর ছিলোনা, আমি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম হারমোনিয়ামের রীডগুলোর দিকে। ওদের জীবনটাও আমার মতোই সাদাকালো, অন্যের আঙুলের ছোঁয়া পেলে তবেই বেজে ওঠে।

দীপার মুহুর্মুহু অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হতে থাকলাম আমি। মনে হতে লাগলো, সবকিছু আমারই কৃতকর্মের ফল। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, দীপা যা করেছে- ভালোর জন্যেই করেছে। আগে যেভাবে মেয়েটার উপর নির্ভর করে স্বস্তি পেতাম, সেভাবেই নির্ভর করতে ইচ্ছে করলো খুব।

মুখে বললাম, ‘সবকিছু অন্যরকমও তো হতে পারতো’।

দীপা ধরা গলায় বললো, ‘বাবা-মা কখোনই অন্য জাতের ছেলেকে মেনে নিতে পারতো না’।

কত ছোটো আর সহজ উত্তর, কিন্তু বুক খালি করে দেয়ার জন্য কতই না বিশাল। দীপার চোখের দিকে তাকালাম আমি। সেখানে শিশিরের মতো জল জমে আছে। আমার খুব ইচ্ছে করলো সে জলে একটু ছুঁয়ে দিতে।

পাশের ঘর থেকে লোপার গানের আওয়াজ শুনতে  পেলাম। সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত, যেটা দীপা আমার চোখে চোখ রেখে গেয়েছিলো একদিন, এই ঘরটাতে বসে। হঠাৎ করে আমি দীপার কষ্টগুলো অনুভব করতে পারলাম, ঠিক আগে যেভাবে অনুভব করতাম। গানের কথাগুলো আবারো নাড়িয়ে দিলো আমায়। অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহিরে......... আমি আমার চারপাশে এমনই কোনো আলোকশুন্যতা অনুভব করলাম।

অগোছালো পায়ে ঘর হতে বেরিয়ে আসার সময়  চারপাশে একবার তাকালাম। একদা খুব পরিচিত এই ঘরটিকে বড় অচেনা লাগলো। উঠোনের তুলসীতলায়  একটুক্ষণ দাড়ালাম। সন্ধ্যাপ্রদীপটি  তেমনি পড়ে আছে, অথচ বদলে গেছে কতকিছুই। আর হয়তো এখানে আসা হবে না আমার। তবু ভালো থাকুক দীপান্বিতারা।


-শাহনেওয়াজ শুভ

No comments:

Post a Comment