Subscribe:

ভালো থাকিস, খুব ভালো

আজ ঘুম থেকে উঠতে অমন দেরী হয়ে গেল, দৌড়-ঝাঁপ করে রেডী হয়ে বাসা থেকে বেরুলাম; ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালাদের জানিস না তো ইদানীং কী হয়েছে- কোত্থাও যাবে না বেটারা। ওভারব্রীজটার নীচেই দেখি সেই ফুলওয়ালীটা, বালতিতে এক গাদা লাল আর হলুদ গোলাপ নিয়ে বসে আছে; হলুদ কুঁড়িটা দেখেই অফিসে যাওয়ার তাড়া ভুলে গেলাম। যেই কিনতে গেলাম টাকাটা বের করে, হঠাৎই মনে পড়ল, কার জন্যে কিনছি! তুই তো নেই কাছাকাছি কোথাও! মানিব্যাগটা জিন্সের পকেটে চালান করে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম গোলাপ কলিটা বাড়িয়ে দেওয়া হাতে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ফুলওয়ালী!


তোর উজ্জ্বল মুখটা ভাসছিল চোখে- ফুল দেখলেই কী যে এক দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত তোর চোখে মুখে! দেখলেই কেনা চাইই, যেদিন কোন কারণে কিনতে চাইতি না আমার খুব ইচ্ছে করত তোকে ফুল কিনে দিতে কিন্তু সামনাসা্মনি কেন যেন কখনোই ফুল দেওয়া হয় নি। ফুল পেতে বা নিজের জন্যে কিনতে কখনোই ভালো লাগে না আমার, চোখের সামনে ঘরে ফুলদানীতে রাখা ফুলের শুকিয়ে যাওয়া দেখাটা খুব অপছন্দ। অথচ প্রতিদিন যখন ভোরের আলো গায়ে মাখতে আমি জগিং এ বেরুতাম; শাহবাগের সেই ফুলের দোকানগুলো দেখলেই তোর কথা মনে পড়ত! দারোয়ানকে কতদিন ম্যানেজ করেছি হলে তোর রুমের দরজায় ফুল রেখে আসে যেন- ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলেই গোলাপ কুঁড়ি দেখে বিস্মিত আর সাথে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি লাগা তোর চেহারাটা কল্পনা করতে খুব ভালো লাগত যে আমার!

আচ্ছা, ওই আবীর চৌধুরী নামক ক্রিমিনালটা তোর সাথে প্রথম দেখা করতে আসার দিনে কি ফুল এনেছিল? মনে পড়ছে না, তুই অবশ্য আমাকে একদম ডিটেইলেই বলেছিলি তার সাথে তোর দেখা হওয়ার কথা , রাগ হজম করে আমি শুনতাম কেবল তখন তোর সুখী মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে। কী করব বল! শা**র (স্যরি, তুই জানিস আমি গালি-গালাজ করতে পারি না, কম খ্যাপাস নি তুই আমায় এ নিয়ে!) কথা শুনলেই মেজাজটা এমন গরম হয়ে যায়, কখনোই জেলাসী থেকে নয়, তোর ভালোবাসা নিয়ে অমন ছিনিমিনি খে্লেছিল বলেই তাকে ঘৃণা করতাম। তোর মুখে তার নাম শুনলে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠত এই ভেবে যে একটা কীটস্য কীটের জন্যে তুই তোর মনের দরজা কে জানে সারাজীবনের জন্যেই বন্ধ করে রাখছিস কি না!

ঐ কুত্তাটা (আবারো স্যরি!) যেদিন তোকে ফোন দিল দেশে ফিরে এসে - মনে পড়ে আমার পাশে রিকশায় বসে তুই কাঁপছিলি; অনেকটা আনন্দ আর খানিকটা ভয়! কিছুতেই আমার মাথায় আসত না অমন একটা ছেলের জন্যে অত ভালোবাসা তোর কোত্থেকে আসে! সেদিন আমাদের সারা সন্ধ্যা একসাথে বেড়ানোর কথা ছিল কোন একটা এসাই্নমেন্ট জমা দেওয়ার আ্নন্দে; তুই যখন করুণ মিনতিভরা চোখে আমার দিকে তাকালি আমি মানা করতে পারি নি- আমিও কি চাই নি এর একটা দফা-রফা হোক! আমি রাগ করি নি বা দুঃখও পাই নি বরং অনেক দিন পরে তোর হাসিমুখ দেখে আমার ভারী ভালো লাগছিল। বার বার বলছিলি আমাকে তার সাথে পরিচিত হতে; 'ও সত্যিই খুব কিউট! তুই একবার পরিচিত হয়ে দেখ! রাগ করিস না প্লিজ!' আর তাই আমিও গিয়েছিলাম বোকার মতো পরিচিত হতে, তোকে খুশী করার জন্যে আর দেখতে কী এমন চিজ সে যাকে তোর মতো একটা অসাধারণ মেয়ে এতখানি ভালবাসে।

সে তোকে ডাকত 'অনি' বলে; আর তাই অন্য কেউ তোকে এই নামে ডাকুক তুই চাইতিস না- হায় রে অবুঝ ভালবাসা! আমি কিন্তু তোকে তোর পুরো নামটা 'অনিন্দিতা' বলেই ডাকি সব সময়; কারণ তুই সত্যিই 'অনিন্দিতা', তুই 'নন্দিতা'। আমি তোর প্রেমিক ছিলাম না; তোকে জান্টুশ, ফান্টুশ, লি'ল বার্ড, লি'ল এঞ্জেল এর কোনটাতেই ডাকতে রাজী নই আমি- তোর যে কোন নিন্দা করা যায় না, শুধু তোকে ভালবাসা যায়।

'ভাই, দেইখ্যা চলেন না রাস্তা! মরবেন তো!'- রিক্সাওয়ালাটা একদম গায়ের উপরেই উঠিয়ে দিল রিক্সা, ব্যাটারা কোথাও যাবে না কিন্তু চালাতে গেলে আর হুশ থাকে না, ভুলেই যায় তার ইঞ্জিন নেই- পাল্লা দিতে চায় বাস আর গাড়ীগুলোর সাথে। অবশ্য রিক্সাওয়ালারই বা কী দোষ! তোর কথা ভাবতে গেলে আমিই তো স্থান-কাল ভুলে যাই! মনে পড়ে তোর? টি এস সি তে ডাসের পেছনে বসে আমার আর তোর সেই নিরর্থক কথামালা, কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামত, গাড়ীগুলোর হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যেত অথচ আমাদের কথা ফুরোত না! কী নিয়ে গল্প করতাম রে আমরা অত? আমার তো মনেই পড়ছে না, তোর মনে আছে?

হা হা হা! কী ছেলেমানুষই না ছিলাম আমরা! একটুতেই কী ভীষণ মান-অভিমানের খেলা! বাসে দুজন দুদিকে মুখ করে থাকা সারাটা সময়, অথচ আমাদের গন্তব্যস্থল একই আর ভাবতামও হয় তো একই কথা! নাহ! কী বোকা আমি! আমি ভাবতাম তোকে নিয়ে আর তুই নিশ্চয়ই আবীরের কথাই ভাবতিস! তুই কখনোই চাইতিস না তৃতীয় কাউকে না নিয়ে আমরা কোথাও যাই, ভয় পেতিস নিশ্চয়ই রাগারাগি করে আমরা আবার মুখ দেখাদেখি আর কথা বলাবলি বন্ধ করে জার্নিটাই খারাপ করব! আচ্ছা, আবীর কেমন ছিল? রাগ করত না তোর সাথে? আমার মতো খারাপ ব্যবহার নিশ্চয়ই করত না!

কী বোকা তুই! প্রায়ই কেন যে বলতিস, তোকে দেখতে ভালো নয় বলেই সেই গর্দভটা তোকে ছেড়ে গিয়েছে! কতোবার যে আমি তোকে বলতে চেয়েছি- 'তুই সুন্দরের কী বুঝিস!' পহেলা বৈশাখে লাল-সাদা শাড়ীতে, কোকঁড়া চুলে গোঁজা রজনীগন্ধা আর কপালে সেই গোল লাল টিপ, আমার বুকের ভেতরটায় বড্ড চিনচিনে একটা ব্যাথা হতো রে! করুণা হতো সেই গাধাটার উপর, কীভাবে পারে সে তোকে ছেড়ে যেতে! আর যেবার তুই সময়ের অভাবে শাড়ী পরতে পারলি না, আর আমায় অভিশম্পাত করলি! আমি তোকে দিয়েছিলাম এক গাদা গোলাপ, শাহবাগের সেই ফুলবাজার থেকে কয়েকশ একসাথে কিনে! ওগুলোকে জাত করে ফুলদানীতে পাচার করলি আর কত রাগ আমার উপর! আমিই বোকা, তোর উপরের রাগটুকু চোখে পড়ল আড়ালের আনন্দটুকু না! ইশ, পারিস কীভাবে তোরা এত লুকোতে!

শোন, সেদিন কী হলো! রিক্সাওয়ালা বলে কি, 'ভাইজান আপ্নে কি পাগল? ইমুন কইরা হাসতেছেন কেন?' তোকে ভেবে ভেবে এখন আমার পাগলই হওয়ার অবস্থা! অথচ তখন যে কেন.....। জানিস, আমার সামনের সীটে একজোড়া কপোত-কপোতী বসেছে, সেই বাসে ওঠার পর থেকে মান-অভিমান চলছে, এখন ছেলেটি উদাস মুখে বাসের ভিতরটা দেখছে, আর মেয়েটা অশ্রুভরা চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে! কোথা থেকে এত চোখের জল পাস তোরা, বল তো! ঘন কোকড়া চুল মেয়েটার, একদম তোর মতন!

জানিস, সেদিন ইচ্ছে করে আমি তোর দেরী করিয়ে দিয়েছিলাম যেন তুই শাড়ী না পরিস; একটু সাজলেই সবাই তোর দিকে তাকায়, তোর প্রশংসা করে, আমি তোর প্রেমিক নই তবুও আমার ভালো লাগে না। সাধারণের মাঝে প্রতিটা দিন তুই আমার কাছে অনন্যসাধারণ হয়ে থাকতিস! আমি তোর যোগ্য নই রে একদমই! তোর সরলতা, নিষ্পাপ হাসি, উচ্ছলতা সবকিছু বড্ড বেশী ছোট করে দিত আমার কলুষিত মনকে তোর কাছে। তোর জন্যে নিশ্চয়ই কেউ কোথাও আছে, আমার চেয়ে অনেক ভালো আর অবশ্যই ওই আবীরের চেয়েও। যে তোকে অনেক ভালবাসবে, অনেক অনেক। তোর সারল্য মাখা হাসি কখনো ম্লান হতে দেবে না। তুই অভিমান করলে আমার মতো পালটা রাগ করবে না, তুই যে বড্ড ছেলেমানুষ! তোর সাথে কি রাগ করে থাকা যায়! সে তোর সকল দোষ নিজের মাঝে নিয়ে নীলকন্ঠ হবে!

আমি প্রায়ই কল্পনা করি, লম্বা ঢ্যাঙ্গা একটা ছেলে ছোট্ট মতো তোর পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙ্গে তোর মান ভাঙ্গাচ্ছে; খুব সুইট লাগে রে আমার! তোর মন খারাপের সময়ে তোকে সে কখনোই একা ছেড়ে যাবে না আমার মতোন। তুই অভিমান করে ফিরিয়ে দিলেও বার বার সে তোদের নতুন বাসার বারান্দার নীচে এসে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তুই যে ফুল বড্ড ভালবাসিস! আমার মতো তোকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে ইচ্ছে করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে না কয়েকশ ফুলের ফুলদানী। তুই যে বড্ড বেশী অভিমানী, আমি পারি নি সেই অভিমানের পেছনের ভালবাসাটা বুঝতে; কেউ একজন নিশ্চয়ই পারবে! আমার মতো সে তোকে কাঁদাবে না! হা হা, হয় তো হেঁড়ে গলায় গান শুরু করবে, তখন যে তুই আর কিছুতেই মুখ গোমড়া করে থাকতে পারবি না! তোর মুখের একটুখানি হাসির জন্যে সে হাজারবার নিজেকে বিকিয়ে দেবে!

আবীর চলে যাওয়ার পর যে দরজাটাকে কঠিনভাবে তালাবদ্ধ করেছিস, শুধু তুই তোর সেই মনের দরজাটা একটু্খানি খোলা রাখিস, তাকে সূর্যের একটুখানি আলো হয়ে ঢুকতে দিস সেই ফাঁক গলে; সে তোকে আলো ঝলমলে সুন্দর এক আকাশ উপহার দিবে!


-Urmi Mustari

No comments:

Post a Comment