Subscribe:

বৃষ্টিস্নাত একটি ফুল এবং......

আকাশের আজকে মন খারাপ।মেঘলা হয়ে আছে সেই সকাল থেকেই।মনে হচ্ছে যে কোন মূহুর্তে বর্ষণ শুরু হয়ে যাবে।কিন্তু সেই মূহুর্তটা আর আসছে না।অবস্থাটা হয়েছে অনেকটা পানিভর্তি ছলছল চোখের মত।পানি আর গড়িয়ে পড়ছে না।চোখের কোনায় এসে অদৃশ্য শক্তি বলে আটকে গেছে।


রাখির আজকে কোচিংয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই।কোচিংয়ে আবার পরীক্ষা চলছে।আজকে পুরো দুই চ্যাপ্টারের ওপর পরীক্ষা।ওর প্রিপারেশন খুব একটা ভাল না।কাল রাতে পড়তে পারেনি।গত কয়েকদিন একটানা রাত জেগে পড়তে গিয়ে ঘুম হয়নি বেশি।আর তাই কালকে পড়তে পড়তে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।বৃষ্টিটা নামলে সে বেঁচে যায়।কোচিংয়ে আর যেতে হবে না।ওর আবার ঠান্ডার ধাত আছে।তাই আম্মুই যেতে দেবে না আর সেজন্য কোচিংয়ের ঐ খাটাশ পলাশ ভাইয়াটা ওকে কিছু বলতেও পারবে না।   

রাখি বুঝতে পারে না যে এত ছেলেমেয়ে থাকতে পলাশ ভাইয়া শুধু কেন তার পেছনেই লেগে থাকেন।সে তো খুব একটা দুষ্টুও না আবার খুব খারাপ ছাত্রীও না।তাও কোন পরীক্ষায় খারাপ করলে কিংবা ক্লাসে না গেলে আম্মুকে জানাতে উনি দু’মিনিটও দেরি করেন না।আর সবার সামনে অপদস্থ করায় তো উনার সীমাহীন পারদর্শিতা।

রাখি পঞ্চমবারের মত বারান্দায় এসে আকাশের অবস্থা দেখল এবং একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।রাতের আগে বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে না।আর এখন বাজে বেলা তিনটা।চারটায় কোচিং।আম্মু আর একটু পরেই তাগাদা দেয়া শুরু করবে।স্কুল থেকে আসতে না আসতেই এক চোট বকা খেয়েছে।এখন আবার খেতে চায় না!আপনমনে গজগজ করতে করতে রাখি ওর রুমে ঢুকল।সাথে সাথে আম্মুর গলা শোনা গেল,   
-কিরে!এখনও রেডি হসনি?চারটায় না কোচিং?এত বড় হয়ে গেছিস তাও এখনও যদি আমাকে তাগাদা দিয়ে সব কাজ করাতে হয় তাহলে কিভাবে জীবনে উন্নতি করবি? 
রাখি ভ্রু কুঁচকে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বলল,  
-কই আর বড় হলাম!এস,এস,সি টা তো অন্তত পাশ করতে দাও তারপর বড় বল।মাত্র তো টেনেটুনে ক্লাস টেনে উঠলাম।
আম্মু বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন,  
-ঠিক আছে যা।আর পাকামো করতে হবে না।রেডি হয়ে কোচিংয়ে যা।আজকে না পরীক্ষা?
রাখি গম্ভীর হয়ে বলল,
-হুম!গত কয়েকদিন ধরেই তো হচ্ছে।দেখছ না রাত জেগে পড়ছি!
-তাই তো!তুই তো আবার পরীক্ষা না আসলে পড়িস না।আমি তো আরো ভাবছিলাম যে মেয়ে আমার ভালো হয়ে গেছে।
আম্মুর কথা বলার ভঙ্গি দেখে রাখি হেসে ফেলল।আম্মু তাতে আরো বিরক্ত হয়ে বললেন,
-এত না হেসে দয়া করে কোচিংয়ে গিয়ে আমাকে উদ্ধার কর।সিমলার সাথে যাবি আজকে?
-দেখি!ও যাবে কিনা জানি না।একবার ওর বাসা হয়ে যাব।ডাকতে না গেলে আবার রেগে ফুলে থাকবে।  

২.
সিমলাদের বাসাটা জানি কেমন।দিনের বেলাতেই অন্ধকার।রাতের বেলা রাখি কখনো আসেনি।তখন না জানি কেমন গা ছমছম করা পরিবেশ থাকবে।অবশ্য আজকে দিনটাই তো মেঘাচ্ছন্ন।তাই হয়তো বাসাটাকে আরো বিষন্ন দেখাচ্ছে।কলিং বেল চাপ দিতেই ভেতর থেকে সিমলার বাবার গলার আওয়াজ শোনা গেল,‘কে?’রাখি বলল,‘আংকেল আমি!’দরজা খুলে গেল।সিমলার বাবাই দরজা খুলেছেন।
-স্লামাইকুম আংকেল!
-ওয়ালাইকুম আসসালাম!
-ভাল আছেন আংকেল?
-হ্যাঁ ভাল আছি।তোমার কি খবর?আরে!বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?আসো আসো ভেতরে আসো!
রাখি ভেতরে ঢোকার পরে আংকেল দরজা আটকে বললেন,
-তোমার আব্বু কেমন আছেন?পোস্টিংয়ের কি হল?
-আব্বু তো এখনও ঢাকাতেই।এই মাসের মধ্যেই পোস্টিং হওয়ার কথা!আংকেল সিমলা কোথায়?কোচিংয়ে যাবে না?
আংকেল সোফায় বসতে বসতে বললেন,
-ওতো বাসায় নেই।
-কোথায় গেছে?
-সিমলার মামাত ভাইয়ের জন্মদিন।একটু আগে বাসার সবাই সেখানেই গেল।
-ও আচ্ছা!আপনি যাননি কেন?
-এমনিই যাইনি।শরীরটা ভাল লাগছিল না।অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাই বাসায় চলে এসেছি।
-ও!আচ্ছা আংকেল আমি তাহলে এখন যাই।কোচিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে।সিমলা আসলে বলবেন যে আমি এসেছিলাম।
এই বলে রাখি দরজার দিকে পা বাড়ালো।হঠাৎ খেয়াল করলো আংকেল পেছন থেকে ওর হাত টেনে ধরেছেন। রাখির অন্তর অজানা আশংকায় কেঁপে উঠল।কিছু বলার আগেই শক্তিশালী দুটি হাতের সুকঠিন বলয় তাকে হিংস্রভাবে আক্রমণ করল।অনেক কাকুতি মিনতি চিৎকার কান্নাকাটি করেও রাখি সেই মানুষরূপী জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষা পেল না!বাইরে তখন অঝোর ধারায় শ্রাবণের জল ঝরছে।আকাশ কেঁপে কেঁপে উঠছে বিদ্যুতের ঝলকানিতে!


৩.
কে যেন কলিংবেল চাপছে!এখন এই সময়ে আবার কে এলো?রাখির আসতে তো আরো ঘণ্টা খানেক দেরি আছে।এসব ভাবতে ভাবতে আম্মু দরজাটা খুলে থমকে গেলেন।তার সামনে রাখি দাঁড়িয়ে আছে।বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু!ওর সাথে তো ছাতা ছিল।তাহলে ভিজল কেন?আর এত আগেই বা চলে এল কেন?কিছু জিঙ্গেস করার আগেই রাখি দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল।পেছন থেকে আম্মু বললেন, 
-কিরে কি হয়েছে?এত ভিজলি কিভাবে?কোচিংয়ে যাসনি?
বাথরুম থেকে শাওয়ারের শব্দের সাথে সাথে রাখির চিৎকার করে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।রাখির আম্মু ভয়ার্ত গলায় আবারো প্রশ্ন করলেন,
-কি হয়েছে মা?বল আমাকে।
বলতে বলতে তার নিজেরও চোখে পানি এসে গেল।রাখি তাদের একমাত্র মেয়ে।ছোটবেলা থেকে অনেক আদরে মানুষ।প্রচন্ড অভিমানী।কি জানি কার সাথে ঝগড়া হয়েছে!এই সব ভেবে নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে আবারো বাথরুমের দরজা ধাক্কিয়ে বললেন,
-দরজা খোল মা!কি হয়েছে বল!এত ক্ষণ গোসল করলে অসুখ করবে!দরজাটা খুলে আমাকে বল দেখি কি হয়েছে!
বাথরুমের দরজা খুলে রাখি ওর আম্মুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।ঠিক তখন দূরে কোথায় জানি একটা বাজ পড়ল!   

সারা রাত রাখি ঘুমাতে পারেনি।আম্মুর কোলে মাথা রেখে দুজনেই জেগে ছিল।বাইরে শ্রাবণের বৃষ্টি যেমন থামেনি তেমন তার চোখের পানিও অঝোর ধারায় ঝরেছে।ও এখন কি করবে?মরে যেতে ইচ্ছে করছে!ওর সাথে কি সবাই আগের মত কথা বলবে?ওর বন্ধুরা কি ওকে আগের মত ভালবাসবে?আব্বু আম্মু কি সেই আগের মত ওকে আদর করবে?নাকি সবাই তাকে খারাপ ভাববে?সে কি এখন বাসার বাইরে যেতে পারবে?ওতো কিছু করেনি।তাহলে ওর সাথেই কেন এরকম হল?ও কি খুব খারাপ মেয়ে?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আবারো ওর চোখে পানি চলে এল।ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমি এখন কি করব কেউ আমাকে একটু বলে দাও!  

আম্মু ওকে বারবার বলেছে এসব কথা কাউকে না বলতে!আব্বু আসলেই ওরা ঢাকায় চলে যাবে।তখন আর কেউ কিচ্ছু জানবে না।কিছু বলতেও পারবে না।সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।ভোরের দিকে যখন চোখ বুঝে এসেছিল তখন সেই বিকেলের ঘটনা তার মানসিক চিত্রপটে আবার ভেসে উঠল।আর্তচিৎকার দিয়ে সে বিছানায় উঠে বসল।আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে সে কাঁপতে লাগল।তার জীবনটা কেন এরকম হয়ে গেল!কেন!


৪.
পাশের ঘরে আব্বু আম্মু কথা বলছে।রাখিকে নিয়েই কথা হচ্ছে।আম্মু মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন।আব্বুর গলার স্বরও ভাঙ্গা।
-ঐ জানোয়ারের বাচ্চাকে আমি খুন করে ফেলব।আমার বাচ্চা মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ করলো!ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।
এই কথা শুনে আম্মু আঁতকে উঠে বললেন,
-না!কাউকে কিচ্ছু জানানো যাবে না।জানাজানি হলেই কেলেংকারি।মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারব না।একটাই মেয়ে আমাদের।থানা পুলিশ করতে গেলে সবাই জেনে যাবে।তখন মেয়েকে বিয়ে দিব কিভাবে?চল আমরা এই এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে যাই।ওখানে ওকে ভাল একটা স্কুলে ভর্তি করে দিব।এখানকার কারো ছায়াও আমি আর ওকে মাড়াতে দিব না।আর থানা পুলিশ করেই বা কি লাভ।যা গিয়েছে তাতো আর ফিরে আসবে না!

এই কথা গুলো বলে আম্মু আবারো কাঁদতে লাগলেন।আব্বু আম্মুর কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।মেয়ের বাবা হিসেবে তিনি কি কিছুই করতে পারবেন না!প্রতিবাদ করার পথটাও যে বন্ধ।তাতে মেয়েরই সর্বনাশ হবে।চোখের পানি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।ছেলেমানুষের মত শব্দ করে তিনি কাঁদতে লাগলেন!মানুষ এত অসহায়!আর তার অসহায়ত্বের পরিমাণটা তিনি এখন উপলব্ধি করলেন।তার ভেতরে একটা অসহ্য অদম্য রাগ পাগলা ঘোড়ার মত ফুঁসে উঠতে লাগল আর তার যন্ত্রনায় তিনি কুঁকড়ে যেতে লাগলেন!  


৫.
আবার সেই দুঃস্বপ্ন!ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল রাখি।ঘুমের মাঝেই কাঁদছিল সে।পাশের ঘরে আম্মু আব্বু ঘুমাচ্ছে।ওর এত দিনের শোবার ঘরটা আজকে খালি।সব জিনিষপত্রই প্রায় গোছগাছ করা শেষ।ওরা কালকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।আজকেই এখানে ওদের শেষ রাত।ওর চোখের কোল ছাঁপিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।ওরা চলে যাবে শুনে আজকে রাখির সব বান্ধবীরা ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল।আম্মু কারো সাথেই দেখা করতে দেয়নি।ওরা এখান থেকে চলে গেলেই নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে।রাখি আর ঐ দুঃস্বপ্ন দেখবে না।আবার ও পড়াশুনা করবে।নতুন স্কুল নতুন বন্ধু।সব কিছু নতুন!       

কিন্তু রাখির কেমন অস্থির লাগছে।ওর কেবলই মনে হচ্ছে যে ওরা পালিয়ে যাচ্ছে।মানুষ নামে এক পশুর আছে হেরে পালিয়ে যাচ্ছে।ওর সাথে যা হয়েছে এতে তো ওর কোন দোষ নেই।তাহলে ও কেন এত কষ্ট সহ্য  করবে।সবাই মুখ বুজে চুপ করে সইবে কেননা ও একটা মেয়ে এই জন্যে?কেন কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না?ঐ পশুটা এত বড় অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে?বাইরে ভোরের সূর্য দেখা যাচ্ছে।রাখির ঘরের বাইরে যে গাছটা আছে তার পাতাগুলো অসম্ভব সবুজ।পাতার গায়ে বৃষ্টির পানির কণাগুলো মুক্তোদানার মত চিকচিক করছে!      

রাখি ওর জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছে।জীবন একটাই।চাইলেই তা আবার ফেরত পাওয়া যাবে না।তাই জীবনের এই ব্যাপারে সে আপোষ করবে না।কোনভাবেই না।ঘুরে দাঁড়াবার সময় হয়েছে।আর একটু পর রাখি ওর আব্বুকে নিয়ে থানায় যাবে।জানুক সবাই।তার যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।কিন্তু ঐ পাষন্ডটার শাস্তি সে দিয়ে ছাড়বে।এই সিদ্ধান্ত নেবার পর নিজেকে অনেক হালকা লাগছে।আব্বু আম্মু হয়তো আপত্তি করবে।কিন্তু বুঝিয়ে বলার মত শক্তিও সে সঞ্চয় করেছে।কতদিন আর ছোট থাকবে!এইবার একটু বড় হবে সে।একটিবারের মত।অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্যে।অন্যায়কারীকে শাস্তি দেয়ার জন্যে!  

রাখি আয়নার সামনে দাঁড়াল।নিজের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।দুদিন আগেও সে আহ্লাদী একটা মেয়ে  ছিল।অথচ আজকে সে নিজের ভেতর এক অজানা শক্তি অনুভব করছে!জানালা গলে একফালি সূর্যালোক ওর মুখে পড়ল।নতুন এক দিনে সূচনা হল সাথে নতুন এক রাখির!     




-- মাহমুদা রীমা

2 comments:

  1. jibone jodi coster case here jawa hoy tobe se jibon ortohin...

    ReplyDelete