Subscribe:

ব্যস্ত জীবনে

আনিস সাহেব বসে আছেন তাঁর মেয়ে সাদিয়ার ঘরে। শ্বশুড় বাড়ি। মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করায় গত এক বছর ধরে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। আজ এসেছেন। দীর্ঘ এক বছর মেয়ের ওপর রাগ ধরে রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন জীবনের বাকি ক’টা দিনও না দেখে পার করে দিতে পারবেন। কিন্তু শেষ মেষ আর পারলেন না।


খুঁজে খুঁজে চলে এলেন মেয়ের বাড়িতে হুট করে। বেয়াইন বাড়িতে খালি হাতে যাওয়া খারাপ। তাই আসার সময় তিন কেজি মিষ্টি আর দুই কেজি জিলাপি নিয়ে এসেছেন। ইচ্ছা ছিল বাজার থেকে মাছ টাছ কিছু একটা কিনে নেবেন। কিন্তু প্রথম বার যাচ্ছেন ভেবে আর মাছের বাজারে ঢুকতে গেলেন না। বাড়ির লোকজনের সঙ্গেই পরিচয় নেই তাঁর, এভাবে হুট করে যাওয়াটা নিয়েই ভেতরে ভেতরে দো-টানায় ছিলেন তিনি, তাই বেশি কিছু নিতে পারেননি।

নতুন মাড় দেয়া সাদা পাঞ্জাবীটা এর মধ্যেই ঘেমে পিঠের সঙ্গে লেগে গেছে। সাদিয়ার থাকার ঘরটায় সিলিং ফ্যান নেই। একটা টুলের ওপর টেবিল ফ্যান রাখা। বসেছেন বিছানায়। ফ্যানটা এতক্ষণ চলছিল- একটু আগে কারেন্ট চলে গেছে। ভর দুপুরের কাঠ ফাটা রোদে টিন সেডের বাড়িটা যেন চুলার মত গরম হয়ে উঠছে ক্রমশ। প্রচন্ড রোদ পড়ায় টিন ফাটার শব্দ হচ্ছে, হঠাৎ করে শব্দটা শুনলে মনে হয় যেন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। অনেক দিন এই শব্দটা শোনেননি আনিস সাহেব। তাঁর বাড়ির ছাদ ঢালাই করা।

বিছানায় পা উঠিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে, ঘরে কোনো চেয়ার-টেবিল নেই। সামনে বসার ঘরে সোফা আছে। কিন্তু সেখানে অন্য মেহমান এসেছে বলে সাদিয়া তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। মেয়ের বিছানায় বসে দর দর করে ঘামছেন তিনি। সাদিয়া একটা হাত পাখা ধরিয়ে দিয়ে কোথায় যে গেছে- আসার আর নাম নেই।

মেয়ের থাকার ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তিনি মাথার ওপর বাঁশের চাটাইয়ের সিলিং। এখানে সেখানে মাকড়শার জাল। বিছানার স্ট্যান্ড থেকে গাদা গাদা কাপড় ঝুলছে। এক কোনায় একটা ছোট কাঠের পুরনো ঘূণে ধরা আলমারী। আলমারীটা একদিকে কাত হয়ে রয়েছে। নিচে ইট দেয়া, তবুও হেলে আছে। মনে হয় ঘূণে নিচেরইয়েক পাশ খেয়ে ফেলেছে। বেশ ছোট একটা ঘর। বাড়িটা বেশি বড় না। তবে মানুষ জন অনেক। তার মাঝেই সাদিয়া যতটা পেরেছে নিজের ঘরটা গুছিয়ে নিয়েছে।

হাত পাখাটা দিয়ে বাতাস করেও লাভ হচ্ছে না। ঘেমে নেয়ে গেছেন আনিস সাহেব। বিছানার কাছের জানালাটা দিয়ে গত আধ ঘন্টা হল কড়া রোদ ঢোকা শুরু করেছে। বিছানার বালিশ, তোশক- সব তেঁতে উঠেছে প্রচন্ড রোদে। জানালাটা বন্ধ করে দিলে ভাল হত। কিংবা বিছানাটা এপাশে না রেখে অন্য পাশে রাখলে রোদ পড়ত না। দুপুরের দিকে মানুষ খেয়ে একটু ঘুমায়- সে সময় যদি বিছানায় এ রকম রোদ পড়ে- ঘুমানো তো দূরের কথা- শোয়াই সম্ভব না, সাদিয়া থাকে কি করে?

হঠাৎ পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে ফিরে তাকালেন তিনি। সাদিয়া ঢুকেছে, হাতে একটা গ্লাস, পিরিচ দিয়ে ঢাকা। এসে বাবার দিকে বাড়িয়ে দিল গ্লাসটা।

আনিস সাহেব সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন, “কি?”

“শরবত। লেবুর। বাড়িতে ফ্রিজ নেই বাবা। থাকলে ফ্রিজের পানি দিয়ে বানিয়ে দিতাম।”

গ্লাসটা হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, “বসার ঘরে এত মেহমান কোথাকার?”

“মেহমান না। মুহূরি এসেছে। আমার ভাসুর এনেছেন। জায়গা জমি ভাগাভাগি নিয়ে কথা বার্তা চলছে।” শাড়ির আঁচল দিয়ে গলার ঘাম মুছতে মুছতে বলল সাদিয়া।

“দাঁড়িয়ে না থেকে বোস।” গ্লাসের শরবতটা ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন এক চোটে।

সাদিয়া হাত পাখাটা নিয়ে বাবার সামনে বসল। আনিস সাহেবকে বাতাস করতে করতে বলল, “এই বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টা কোনো না কোনো মানুষ থাকবেই। সারাক্ষণ এলোক সে লোক আসা যাওয়া করছে। মানুষের ভীড়ে মাঝে মাঝে অতিষ্ট হয়ে যাই। চা বানাতে বানাতে বড় ভাবী, মেজ ভাবী আর আমি আসল রান্না বান্না করারই সময় পাই না।”

“কয় ঘর লোক থাকে?” আনিস সাহেব জানালা দিয়ে বাহিরের কড়া রোদের দিকে তাকিয়ে বললেন।

“তিন ঘর। আমার দুই ভাসুরের ফ্যামেলি, আর তোমার জামাইয়ের।”

“বাচ্চা কাচ্চা আছে ওদের?”

“হ্যা। বড় ঘরে তিনটা। মেজ ঘরে দুটো।”

“তোর শ্বশুড় শ্বাশুড়ি?”

“গত বছর মারা গেছে শ্বাশুড়ি। আর শ্বশুড় আব্বা মারা গেছেন বারো তেরো বছর হল।”

“শ্বাশুড়িকে পেয়েছিলি? নাকি তার আগেই মারা গেছে?”

“নাহ, পেয়েছিলাম তো। বিয়ের দু সপ্তাহের মাথায় মারা গেলেন।”

“অ।” চুপ হয়ে গেলেন তিনি।

সাদিয়া অন্য দিকে তাকিয়ে একটানা বাতাস করে যাচ্ছে আনিস সাহেবকে। পিতা কন্যায় এতদিন পর দেখা হওয়ার পরও এমন ভাবে কথা বলছে দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। আনিস সাহেবের খুব অবাক লাগছে। তিনি এত স্বাভাবিক হয়ে কথা বলতে পারছেন কিভাব?

বসার ঘর থেকে তর্কা তর্কির শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে জমি জমা নিয়ে কথা কাটা কাটি হচ্ছে।

খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর আনিস সাহেব বললেন, “তোর ঘরে তো দেখি কোনো ড্রেসিং টেবিল নেই। তোর রূমেরটা নিয়ে আসিস, পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে অযথা।”

ক্লান্ত একটা হাসি হাসল সাদিয়া, “আর ড্রেসিং টেবিল......... বাড়ির রান্না বান্না এখন কে করে বাবা?”

“তোর ছোট ফুফুকে নিয়ে এসেছি। ও স্কুলে মাষ্টারি করে, বাসায় রান্না বান্নার কাজটাও করে দেয়।”

“ও।” সাদিয়া চুপ হয়ে গেল।

আনিস সাহেব লক্ষ করলেন মেয়ের দু হাতে দুটো প্লাস্টিকের চুড়ি, গলায় কিংবা কানেও কোনো সোঁনার কিছু নেই।

“জামাই কি করে এখন?”

“এই টুকটাক ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। শেয়ারে ব্যবসা করে।” হাতের নখের দিকে তাকিয়ে বলল।

“তোর গলা আর কানের জিনিস পত্র কই? চেনটা পরিস না আর?” সামান্য সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলেন। মেয়ে ইন্টার পাস করার পর স্ট্যান্ড করেছে দেখে একটা সোঁনার চেন বানিয়ে দিয়েছিলেন। লকেটে সুন্দর করে সাদিয়ার নাম লেখা ছিল সেটায়।

“পরি তো। এই ঘরের মঢ্যে কে দেখতে আসবে? তাই খুলে রেখেছি। গরমের মধ্যে গলায় চেন দিয়ে রাখলে অস্বস্তি লাগে খুব।” অন্য দিকে তাকিয়ে দায়সারা জবাব দিল সাদিয়া।

আনিস সাহেব আর কিছু বললেন না। সাদিয়ার মা বেঁচে থাকলে এতক্ষণে নিশ্চই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করতেন মেয়েকে। জামাই তারে কখন ফেরে? জামাই কি আদর যত্ন করে ঠিক মত? ঘুরতে নিয়ে যায় তাকে? গলার আর কানের সোঁনা দিয়ে কি জামাই ব্যবসা করেছে? নাকি বন্ধক? নানান প্রশ্ন। কিন্তু আনিস সাহেব এত কথা বলতে পারেন না। মা মেয়েতে যতটা সখ্যতা ছিল- পিতা কন্যায় ঠিক উল্টোটা হয়েছে। তাই হাজারটা প্রশ্ন মনে নিয়ে চুপ করে বসে রইলেন আনিস সাহেব। কারেন্ট এসেছে। টেবিল ফ্যানটা শব্দ করে এদিক ওদিক ঘুরে বাতাস দিচ্ছে। তবুও তিনি ঘামছেন দরদর করে।

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

বিছানার ওপর একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে দিয়েছে সাদিয়া। সেখানে ভাত খাচ্ছেন আনিস সাহেব। ডাইনিং টেবিলে খেয়ে তাঁর দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। এভাবে ঝুঁকে খেতে সমস্যা হচ্ছে, পেটে চাপ লাগছে- কিন্তু কিছু বললেন না মেয়েকে। সাদিয়া হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে বাবাকে। টেবিল ফ্যান ছাড়া, তবুও বাতাস করছে। আনিস সাহেব একবার ভাবলেন বলবেন বাতাস না করতে- কিন্তু বললেন না।

খাবারে তরকারির পদ মাত্র দুটো। সরপুঁটির ঝোল আর ডিম ভাজা। আর কিছু নেই। আনিস সাহেবের খেতে অসুবিধা হচ্ছে। এত শুকনো খাবার খেতে ভাল লাগে না তাঁর, ডাল না হলে গলা দিয়ে ভাত নামতে চায় না।

সাদিয়া নিচু গলায় বলল, “খেতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না বাবা? ডাল শেষ হয়ে গেছে। থাকলে বানিয়ে দিতাম। তুমি তো ডাল ছাড়া খেতেই পারো না। জলপাইয়ের আঁচাড় আছে, দেই?”

আনিস সাহেব জবাব দিলেন না, কেবল বললেন, “জামাই দুপুরে খেতে আসে না?”

“আসে মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ সময়েই আসে না।” হাত পাখাটা বিছানায় রেখে আলমারীর দিকে চলে গেল। আনিস সাহেব দেখলেন আলমারী খুলে সাদিয়া একটা বড় আঁচাড়ের বোয়ম বের করেছে। একটা চামচ আছে সাথে। আলমারীর পাল্লা দুটো আবার লাগিয়ে দিয়ে ফিরে এলো তাঁর কাছে। বোয়মের ঢাকনা খুলে চামচ দিয়ে আঁচাড় বের করে বাবার প্লেটে তুলে দিল।

“নাও। খেয়ে দেখো। আমি বানিয়েছি।” আনিস সাহেবের সামনে বসল। হাতপাখাটা হাতে নিয়ে আবার বাতাস করতে লাগল।

“ফ্যান তো চলছে। বাতাস করিস না।” আঁচাড় দিয়ে খেতে ভালই লাগছে। তাঁর স্ত্রী রাহেলা বেগমও খুব ভাল আঁচাড় বানাতে পারতেন। মায়ের হাত পেয়েছে মেয়ে।

খেতে খেতে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন সাদিয়া অন্য দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এদিকে তাকাচ্ছে না। একটা নিঃশ্বাস ফেললেন আনিস সাহেব। তিনি জানেন সাদিয়া কান্না চাপার চেষ্টা করছে। ওর মাও কাঁদার সময় অন্য দিকে তাকিয়ে থাকত। বিশেষ করে খেতে বসলে।

সাদিয়া অন্য দিকে ফিরে বিছানার স্ট্যান্ড ধরে নখ দিয়ে দাগ কাঁটছে স্ট্যান্ডে এক ভাবে। খেতে খতে আনিস সাহেব শুনতে পেলেন, নিচু গলায় সাদিয়া বলছে, “বাবা? আমাকে ছাড়া থাকতে তোমার অনেক কষ্ট হয়- তাই না?”

আনিস সাহেব খেয়ে যাচ্ছেন। কোনো কথা বললেন না।

চাপা গলায় কান্না প্রকাশ পেল সাদিয়ার, “ও বাবা? আমি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছি বলে খুব কষ্ট পেয়েছো?”

আনিস সাহেবের ভাতের ওপর হাত ধোয়ার অভ্যাস নেই। মোটেও পছন্দ করেন না এটা। ছোট বেলায় সাদিয়া ভাতের ওপর হাত ধুয়ে ফেলত দেখে অনেক মার দিতেন। কিন্তু আজ নিজেই অর্ধেক খেয়ে ভাতের ওপর হার ধুয়ে ফেললেন। সাদিয়া হাত ধোয়ার শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে এদিকে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, “একি! তুমি তো কিছুই খাওনি!”

“পেট ভরে গেছে মা। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য বেশি কিছু খাই না ইদানীং।” গম্ভীর গলায় বললেন।

সাদিয়া কিছু বলল না। হাত মোছার জন্য গামছা এগিয়ে দিল। আনিস সাহেব হাত মুছে উঠে দাঁড়ালেন।

“দাঁড়ালে যে? বসো।”

“নাহ। আজ যাই। তোর ফুফু বিকাল তিনটার দিকে ফেরে। তালার চাবি আমার কাছে। গিয়ে খুলে দিতে হবে। দেরি হয়ে যাবে নয়ত।” মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে তিন হাজার টাকা বের করে সাদিয়ার হাতে ধরিয়ে দিলেন জোর করে, “কিছু ইচ্ছা করলে কিনে খেয়ে নিস। বাড়ি ভরা লোকের মাঝখানে হয়ত অনেক কিছুই খেতে ইচ্ছা করে তোর, পারিস না।” সাদিয়া নিতে চাইল না, কিন্তু আনিস সাহেব শক্ত করে ওর হাতে গুজে দিলেন নোট গুলো। তারপর আবার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

“বাবা?” পেছন থেকে ডাকল সাদিয়া।

“কিছু বলবি?” ফিরে তাকালেন, সাদিয়া বিছানায় এখনো বসে আছে। মুখ নিচু করে রেখেছে।

আনিস সাহেব দাঁড়িয়ে রইলেন মেয়ের জবাবের অপেক্ষায়। কিন্তু কোনো কথা বলছে না সাদিয়া। ফিরবেন আবার দরজার দিকে, হঠাৎ উঠে এসে দু হাত দিয়ে আনিস সাহবের পা জড়িয়ে ধরল সাদিয়া শক্ত করে। তিনি প্রস্তুত ছিলেন না ব্যাপারটার জন্য। জমে গেলেন একদম। টের পাছেন সাদিয়ার নিঃশব্দ অশ্রু জল ফোঁটায় ফোঁটায় তার পায়ের ওপর পড়ছে....

শুনতে পাচ্ছেন সাদিয়া কান্না ভেজা গলায় খুব নিচু স্বরে বলছে, “ও বাবা? তুমি কথা বল না কেনো? ও বাবা? আমি বুঝিনি আমি কি ভূলটা করেছিলাম তোমার কথা না শুনে। তাই বলে আমার সাথে ঠিক করে কথা বলবে না? ও বাবা? আমার অনেক কষ্ট লাগে তো..... এখানে আমার সাথে দু দ্বন্দ্ব বসে কথা বলার মানুষ নেই। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত...... তোমার জামাই রাতের পর রাত বাড়িতে ফেরে না। আমি একে একা থাকি এখানে..... সবাই খুব ব্যস্ত জানো বাবা? আমাকে কেউ চাকরী করতে দেয় না। ঘরে চাল থাকে না , তাও আমাকে চাকরী করতে দেয় না। নিজেরাই সব...... বাবা? ও বাবা? কথা বল না? কত দিন পর দেখলাম তোমাকে। একটু কথা বলো না আগের মত? ও বাবা?”

আনিস সাহেব মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

“আমি না হয় তোমাকে কষ্ট দিয়ে একটা অন্যায় করেছি- তাই বলে তুমি ঠিক মত কথা বলবে না? বাবা?”

আনিস সাহেব খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “আমি জানি কেমন হয়ে গেছিরে মা। বেশি কথা বলতে পারি না আগের মত। তোকে দেখে গেলাম- এটাই বড় পাওয়া আমার জন্য। কোন দিন হুট করে মরে টরে যাই..... আস্তে আস্তে সবাই নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। প্রথমে তোর মা চলে গেল। এখন তুই তোর জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেলি। আমার অনন্ত অবসর কেবল....... অবসরের ধকলে পড়ে আসলে কথা বলার শক্তিটা হারিয়ে ফেলেছি। তুই ভাল থাকিস। তোর বাচ্চা কাচ্চা হলে ওদেরকে এমন ভাবে মানুষ করিস যাতে ওরা অল্প সময়ের সম্পর্কের টানে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কটাকে না ছেঁড়ে। কারণ জন্মের পর থেকে একটু একটু করে ছোট একটা বাচ্চাকে মানুষ করতে কতটা মমতা লাগে- সেটা কেউ জানে না- যখন হঠাৎ করে সম্পর্কে ভাঙ্গন লাগে- তখন বোবা কষ্টের মাঝে বোঝা যায় কত গভীরে শেকড় গেঁথেছিল যে উপড়ে ফেলতে গিয়ে সবটাই মরে গেছে.......”

সাদিয়া কেঁদে যাচ্ছে এখনো। আনিস সাহেব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন তার চোখে পানি জমছে না আর আগের মত। কে জানে, এক জীবনের সমস্ত অশ্রু জল ফুরিয়ে গেছে তাঁর। এখন কেবল শূণ্যতা......

আনিস সাহেব মেয়ের বাসা থেকে বের হলেন যখন তখন প্রচন্ড রোদে সমস্ত নগরী দগ্ধ প্রায়। রাস্তার পিচ গলে গেছে। হাটার সময় সেন্ডেলের নিচে লেগে যাচ্ছে গরম পিচ। তার মাঝ দিয়েও নির্বিক চিত্ত্বে হেটে যাচ্ছেন তিনি। চারপাশে রিক্সা আর বাস, ট্রাকের ভীড়। ফুটপাথ দিয়ে অগণিত মানুষের ছুটে চলা। সবাই ব্যস্ত। সবাই ছুটছে যার যার ঠিকানায়, যার যার লক্ষে। কিন্তু তার মাঝেও চারপাশের ব্যস্ততা ছাপিয়ে অদ্ভূত একটা নৈশব্দময় হাহাকার টের পাচ্ছেন আনিস সাহেব...... ব্যস্ত নগরে জীবনের হাহাকার। সবাই টের পায় না, কেবল তারাই পায়- যাদের রয়েছে অনন্ত অবসর.......

 

( সমাপ্ত )

 

    একটা লাইন কদিন থেকেই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও গল্পের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও দিয়ে দিলামঃ

    মৃত্যু আর  অমরত্বের  মাঝে  কোনো  সম্পর্ক  নেই। অমরত্বের  সঙ্গে  জীবনের  পায়ের  ছাপের  সম্পর্ক  রয়েছে। আপনার  পদচারণা  কতটা  দৃপ্ত ছিল-  সেটাই  নির্ধারণ  করবে  আপনার  অমরত্বের  সম্ভাব্যতা।

 

উৎসর্গঃ
            মোঃ আয়ুব। আমার আব্বু। আমার দেখা পৃথিবীর সব চাইতে খাঁটি মানুষটি। যিনি আমাকে পৃথিবীটাকে তার নিষ্পাপ চোখ দিয়ে দেখতে শিখিয়েছেন। আমি অপেক্ষায় আছি, এক দিন আমি তোমার মত হবো।  



- নিথর শ্রাবণ শিহাব

3 comments: