Subscribe:

শেষের ওপাশে

১.
♫♪Walking down the street

Distant memories

Are buried in the past forever

I fallow the Moskva

Down to Gorky Park


Listening to the wind of change♫♪

গানের কথাগুলো বার দুয়েক বেজেই শেষ হয়ে গেল। আসিফ আবারও ফোন করল নিঝুম কে, কিন্তু নিঝুম ফোন ধরল না। আসিফ আনমনে নিজের চশমার কাঁচ মুছতে থাকে।আজকাল অফিসের পর নিঝুম দেরী করে বাড়ি ফিরছে, এমনকি ছুটির পর আসিফ ফোন করলেও ধরে না। আজ তবুও আসিফের মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল যে হয়ত ফোনটা ধরবে, কিন্তু না...ধরল না।গাড়ি ওয়ারলেসের কাছে সিগন্যালে আটকে আছে।সন্ধ্যা আসি আসি করছে।একটু পরেই ঝুপ করে লালচে আকাশটা কালো হয়ে যাবে। গাড়ির কাঁচটা নামাতে যেয়েও নামায় না আসিফ, বরং এফ,এম রেডিও অন করে বসে...সাথে সাথেই গান বেজে উঠে।


“আমার ভীনদেশি তারা

তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি...

আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়,

আমার একলা লাগে ভারী”



 আমার একলা লাগে ভারী...আমার একলা লাগে ভারী...বিড়বিড় করে আসিফ। একটু একটু করে একটা জমাট বিষন্নতা ওর মনটা গ্রাস করে।



২.


প্রতিদিন অফিসের শেষের দিকে নিঝুমের হাতে কাজ থাকে না বললেই চলে। সব কাজ সময় মত করে ফেলে শেষের দিকে নিঝুম আর কোন কাজ খুঁজে পায় না। এই স্বভাবের জন্যে ওর অফিসের সবাই ওকে খুব পছন্দ করে। বিকেল ৫.৩০ বাজে। ওয়াশ রুম থেকে বের হওয়ার আগে নিজেকে আয়না এক ঝলক দেখে নেয় ও। একটু পরই শ্রেষ্ঠ ওর কেবিনে আসবে। কিছুক্ষণ গল্প করেই তারা বের হয়ে যাবে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে...তারপর রাত ৮টা পর্যন্ত আড্ডা চলবে, ঘুরে বেড়ানো চলবে...এরপর তাকে বাসার সামনে ড্রপ করেই শ্রেষ্ঠ ফিরবে। এইভাবেই দিন যাচ্ছে তাদের।নিঝুম আয়নায় নিজেকে দেখে খুশি হয়ে কেবিনে ফিরে যায়। গিয়ে দেখে শ্রেষ্ঠ বসে আছে। মুখে মিটিমিটি হাসি।নিঝুম একটু অবাক হয়...কি ব্যাপার?এত্ত খুশি কেন?



-নিঝুম তোমাকে এই গাঢ় নীল ড্রেসে অসাধারণ লাগছে...উচ্ছসিত হয়ে বলে শ্রেষ্ঠ।

-থ্যাঙ্কস। আমার নিজের ডিজাইন করা ড্রেস। এখন বল তুমি এত খুশি কেন? ভ্রু নাচায় নিঝুম।

-আজ তোমাকে অন্যরকম এক কফিশপে নিয়ে যাব। অনেক ভাল পরিবেশ।সেখানের কেক আর কফি খেতে ফাটাফাটি,ম্যাম।

-আচ্ছা বাবা,যাব আমি। তুমি যাও লাস্ট ফাইল টা সাবমিট করে এস আগে।

-এক্ষুনি যাচ্ছি,  আমার blue fairy…চোখ মটকায় শ্রেষ্ঠ।

নিঝুম এক গাল হাসে।পাগল একটা ছেলে শ্রেষ্ঠ।স্মার্ট,ব্রিলিয়ান্ট,আর সারাক্ষণ সবাইকে সব কাজে এত্ত উৎসাহ দেয় যে, ওর পাশে থাকলেই সময় যেন হূ হূ করে চলে যায়। এমন অন্যরকম একটা ছেলেকে যে কিভাবে এর বউ ডির্ভোস দিতে পারে কে জানে। কপালের উপরের চুলগুলো আলতো করে সরাতে গিয়ে চোখ পরে সেলফোনে ৪টা মিসকল জ্বলজ্বল করছে।হাতে নিতেই দেখে আসিফ ফোন করেছিল, সাথে একটা ম্যাসেজও আছে। তাতে লেখা-“আজ কাজ শেষ করে একটূ জলদি বাসায় এসো প্লিজ”  সাথে সাথে মেজাজ খিচড়ে যায় নিঝুমের।অসহ্য,আজকে তাকে শ্রেষ্ঠর সাথে বেড়ুতে হবে, সব প্ল্যান করা শেষ আর আজই এইরকম বেখাপ্পা ম্যাসেজ এল আসিফের। তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়া মানেই হল একঘেয়ে লাগা। আসিফ এসেই টিভিতে নিউজ বা খেলা দেখবে তারপর খাবার চাইবে, তারপর সারাদিনের কিছু বস্তাপঁচা কাজের কথা বলে অফিসের কিছু কাজ করে মরার মত ঘুমাবে। যত্তসব।নিঝুম ম্যাসেজের উত্তর পাঠায়- “অফিসে মিটিং এ আছি,ফিরতে আজও দেরি হবে।তুমি খেয়ে নিও”



৬টা বেজে ৫ মিনিট নিঝুম আর শ্রেষ্ঠ একটা সাদা গাড়িতে করে তাদের ঝলমলে সন্ধ্যা কাটাতে চলে যায়।



৩.


আসিফের মুঠোফোনটা টুনটুন করে বেজে উঠে...নিঝুমের ম্যাসেজ পড়ে তার নিজেকে কেমন যেন পরাজিত মনে হতে থাকে। তার বার বার মনে হচ্ছিল আজ হয়ত নিঝুম একটু তাড়াতাড়ি বাসায় আসবে। একসাথে দুজন ডিনার করবে,খেতে খেতে সে আজ কিছু মজার কৌতুক বলবে নিঝুমকে যা শুনে ও খিল খিল করে হাসবে। ওদের প্রেমের প্রথম দিকের দিনগুলোর মত।কি কি কৌতুক বলবে তাও সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল আসিফ। আজকাল নিঝুম কেমন শক্ত শক্ত ভাবে কথা বলে ওর সাথে সব কিছুই আজকে সহজ করতে চাইছিল, কিন্তু নিঝুমের উত্তর পেয়ে চুপ্‌সে গেলো সে। পরক্ষণেই মনে হল, হয়ত নিঝুম ইচ্ছে করেই এমন ম্যাসেজ লিখেছে...আসলে ও বাসায় চলে এসেছে তাকে চমকে দেওয়ার জন্যে।ভাবতেই আসিফের মন ভালো হয়ে যায়। আজকে নিঝুমের জন্যে কোন গিফট নিলে বেশ হয়। গাড়িটা ঘুরিয়ে সে তার চেনা সব চেয়ে বড় গিফট শপের কাছে যেতে থাকে। হঠাৎ করে তার শরীরটাও বেশ ঝরঝরে লাগছে।কেন যেন বার বার মনে হচ্ছে বাড়ি ফিরলেই নিঝুম কে সে দেখতে পাবে।


গিফট শপের পাশেই নতুন খুব বড় একটা কেক এন্ড কফিশপ দেখে থমকে যায় আসিফ, ভাবে গিফটের সাথে কেক ও নিয়ে যাবে আজ। শপটার নামও বেশ লাগে তার-ALBINO…নামের অর্থটা কি কে জানে।


গাড়ি পার্ক করেই নিজের মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে সে গিফট শপে দিকে এগিয়ে যায়।



৪.


কফির মগে চুমুক দিতেই নিঝুমের সারাদিনের ক্লান্তি চলে গিয়ে কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব কাজ করে। অসাধারণ কফি...সে একটু আচ্ছন্নতা নিয়ে শ্রেষ্ঠর দিকে তাকায়...এই মানুষটির পছন্দের তারিফ না করে পারে না সে। আজ পর্যন্ত সে যতটুকু দেখেছে ততই অবাক হয়েছে, একটা মানুষের সব কিছু এত পারফেক্ট হয় কিভাবে? শ্রেষ্ঠ হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করেই যাচ্ছে...


 “বুঝলে নিঝুম,তোমাকে আমি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী পড়তে দিব। যোগীন্দ্রনাথ বসু খুব চমৎকার ভাবে তার জীবনী নিয়ে বই বের করেছেন।অসম্ভব সুন্দর বই।একটা মানুষের জ়ীবনে যে কত্ত ভ্যারিয়েশন তা তুমি বুঝতে পারবে বইটা পড়লেই। “মেঘনাদবধ” তো নিশ্চয় পড়েছ? তাঁর জীবনীতে বাল্যকাল থেকে শুরু করে,হিন্দু কলেরজের তৎকালীন অবস্থা,তাঁর কাব্যের দোষ,কবিতা লেখা,খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করা...তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, নাটক লেখা, শেষ জীবনে করা ব্যারিস্টারি ব্যবসাসহ সব কিছু লেখা আছে।মানুষের মন যে কত বিচিত্র তা তুমি আরও বুঝতে পারবে। যে মধুসূদন একদিন “বংলাভাষা ভুলিয়া যাওয়াই ভালো” বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন নি, সেই মানুষটি পরে বাংলা ভাষার প্রতি অসীম অনুরাগী হয়ে গিয়েছিলেন...বুঝছ?



 এক পলকের জন্যে নিঝুমের ঘোর কাটে, এতক্ষণ সে মন্ত্র মুগ্ধের মত সব কথা গিলছিল।মাথা নাড়ে ও। শ্রেষ্ঠর এই গল্পগুলো বড্ড ভালো লাগে ওর, কি পড়ছে,কি ভাবছে সব শেয়ার করবে। শ্রেষ্ঠর ডান হাতটা ছুঁয়ে বলে-আমাকে দিও তো বইটা, আমি যদিও বই খুব কম পড়ি তাও পড়ে জানাবো তোমাকে কেমন লাগেছে আমার।

শ্রেষ্ঠর চোখ আনন্দে চকচক করতে থাকে। সে বেশ যত্ন নিয়ে নিঝুমের হাতটা ধরে রাখে।


নিঝুমের বাড়ি ফিরতে আজ প্রায় ৯.৩০ বেজে যায়। বাড়ির কাছে এসে, ড্রপ করার সময় শ্রেষ্ঠ হুট করে বলে-নিঝুম একটা কথা বলতো...

-কি কথা আবার?শ্রেষ্ঠর প্রশ্ন করার ভঙ্গী দেখে নিঝুম হেসে ফেলে।

-আমি যদি তুমি হতাম তুমি যদি আমি...কে বেশি ভালবাসত?আমি নাকি তুমি??

নিঝুম অবাক হয়ে বলে-মানে কি? তারপর একটু থেমে বলে-উমম...মনে হয় উত্তর হবে আমরা।রাইট!!!

গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে নিতে শ্রেষ্ঠ জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে-উত্তর হয়নি...ভাবতে থাক আমি বাসায় গিয়ে ফোন করলে তারপর বল আমাকে।


নিঝুম বাসার দিকে পা বাড়ায়। ব্যাগ থেকে সেলফোনটা বের করে দেখে, এতক্ষণে একবারও আসিফ আজকে ফোন দেয়নি।



৫.


রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। নিঝুম নিজের ঘর গোছগাছ করছে। আজকে সন্ধ্যায় বাইরে বেশ বাতাস ছিল, আর সেই বাতাস এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। মনে হয় ঝড় হবে।আসিফ আসার পর থেকে নিঝুমের সাথে কোন কথা বলেনি, স্টাডি রুমে বসে আছে...হয়ত কোন কাজ করছে। তবুও মনের মাঝে কোথায় যেন নিঝুমের একটু খচখচ করতে থাকে। নিজে থেকেই স্টাডি রুমে চলে যায় ও। আসিফ জানালার কাছে বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে। বাইরে নারকেল গাছের পাতা প্রচণ্ড বাতাসে এপাশ ওপাশ আছ্‌ড়ে পরছে। ঘরে ধুলো আসছে,কিন্তু আসিফের কোনই বিকার নেই। নিঝুম আসিফের এই নির্বিকার ভাব দেখে অবাক হয়। কী বলবে বুঝতে পারে না...আসিফ জানালা থেকে মুখ না সরিয়েই বলে-মিটিং কেমন হল আজ?

-হুম ভালো।কাজের অনেক চাপ আজকাল।তুমি ডিনার করেছ?

-না খেতে ইচ্ছে করছিল না।একটু পর বসছি।

-জানালা খুলে রেখেছ কেন? ধুলো আসছে তো...

আসিফ নরম গলায় আপনমনে বলে-আসুক না ধুলো...আসুক না ঝড়...খারাপ লাগছে না আমার। তারপর একটু থেমে বলে-তুমি কি আর কিছু বলবে...!!!



নিঝুম মাথা নেড়ে চলে যেতে গিয়েও হঠাৎ থমকে গিয়ে বলে-আচ্ছা বলতো...-আমি যদি তুমি হতাম তুমি যদি আমি...কে বেশী ভালবাসত?আমি নাকি তুমি??

আসিফ এইবার ঘরে বসে নিঝুমের চোখে চোখ রেখে বলে-উত্তর হবে “তুমি” কারণ তুমি মানেই হল আমি...

নিঝুম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে-উত্তর আমরা কেন হবে না?

আসিফ মৃদু হেসে বলে অপশন তো ছিল “আমি নাকি তুমি” তাহলে আমরা কেন হবে?তুমি তো এই কথায় আমরা বা আমাদের জন্যে কোন অপশন রাখোনি।

নিঝুম আর কথা খুঁজে পায় না।তড়িঘড়ি করে নিজের ঘরে চলে আসে।বাইরে ঝড়ের সাথে টিপটিপ বৃষ্টিও হচ্ছে।জানালাগুলো লাগাতে থাকে ও...শুনতে পায় আসিফ ডাইনিং টেবিলে টুং টাং করে কি কি যেন রাখছে।

কিছুক্ষণ পর ডাইনিং টেবিলে গিয়ে নিঝুম অবাক হয়ে যায়...রুম অন্ধকার।তার মাঝে টেবিলের উপর একটা ব্ল্যাক ফরেষ্ট কেক রাখা, কেকের উপরে বেশ কিছু মোমবাতি জ্বলছে।পাশে একটা গিফট প্যাক।আসিফ আসেপাশে কোথাও নেই।কেকের উপরে লেখা আছে-“নিঝুম তোমার জন্যে”

নিঝুম এক পা দু পা করে টেবিলের আরো কাছে যায়, হঠাৎ করে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে।হৃৎস্পন্দন এতটাই বেড়ে গেছে যে মনে হচ্ছে ওর নিজের কানেই তালা লাগবে। কিছু একটা হয়েছে, কোন একটা বড় ভুল...নিঝুম প্রচন্ড এক শঙ্কা নিয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো ক্যালেন্ডারের পাতায় আড়চোখে তাকায়। আজ ৫ই মে!! নিঝুম যেন ইলেক্ট্রিক শক খায়।আজ ওদের বিয়ের ২ বছর হল। অথচ নিঝুমের মনেও নেই!! নিঝুম দ্বিতীয় বারের মত ধাক্কা খেল যখন ও দেখল টেবিলে কেকের পাশে কেকের বক্সটা রাখা আর তাতে লেখা কেকশপের নামটি-Albino..যেখানে আজ সন্ধ্যায় ও শ্রেষ্ঠর সাথে ছিল।



৬.


নিঝুমের পা দুটো মাটির সাথে আটকে গেছে। নিজের শরীরটা কে বড্ড বেশি ভারী মনে হচ্ছে তার। ক্লান্ত লাগছে খুব।কোনক্রমে সে চেয়ার টেনে বসে পরে।অন্ধকার ঘরে মোমের আলো ছাড়া কোন আলো নেই,শব্দ নেই,শুধু বাইরের ঝড়ের শো শো শব্দ। হঠাৎ নিঝুমের চোখ পরে, টেবিলে উপর একটা সাদা খাম। হাত বাড়িয়ে নেয় সে। খুলে দেখে আসিফের লেখা চিঠি।দুরুদুরু বুকে সে মোমের আলোয় চিঠির পাতা খুলে বসে...


“ নিঝুম,

আজ আমাদের বিয়ের ২ বছর হল। আমি সকাল থেকে ভেবেছিলাম দিন শেষে তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।আমাদের আটপৌরে, সাদামাটা জীবনের মুহূর্তগুলো আমরা একসাথে আজ আবার নতুন করে সাজাবো...কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। আজ নিজেকে আমার খুব ব্যর্থ,পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে।প্রথমে তোমার উপর খুব রাগ লাগছিল,কিন্তু তারপর মনে হল তুমি নিজেও আসলে আমাকে নিয়ে ভাল নেই। বরং সমস্যায় আছ।আমি তোমাকে ভালো রাখতে পারিনি।কিন্তু নিঝুম, সমস্যা থেকে পালানো কোন কাজের কথা না। আমি একটি উদাহরণ দেই-বিখ্যাত ফটোগ্রাফার কেভিন কার্টার আফ্রিকায় একটি মুমূর্ষ বাচ্চার ছবি তোলেন যার পেছনে বসা একটি শকুন তার মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। এর কিছু দিন পর তিনি এই শোক সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করেন। কারণ ঐ সময় বারবার উনার নিজের বাচ্চাদের কথা মনে পড়ছিল। আজ এখানে এই বাচ্চাটির জায়গায় তার বাচ্চাও থাকতে পারত। ছবিটি দেখে যে কোন বিবেকবান মানুষের চোখ ভিজে আসবে। আমি উনাকে দোষ দেই না। কিন্তু তারপরও আমি বলব এটা উনার ভুল একটি সিদ্ধান্ত। সুইসাইড করে উনি কারো কোন উপকারে আসেননি। বরং আজ তিনি বেঁচে থাকলে এমন অনেক বাচ্চার প্রাণ বাঁচাতে পারতেন। কারণ উনাকে সৃষ্টিকর্তা যে ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা হয়ত অন্যকে দেননি। এটাকে এভাবে নষ্ট করা ঠিক না।


বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ইচ্ছা না থাকলেও অনেক সময় আমাদের ভুল জায়গায় থাকতে হয়। হয়ত এখানে না থেকে তোমার থাকার কথা ছিল অন্য কোন জায়গায়, অন্য কারো সাথে।আমি বিয়ের সময় অনেক কথা দিয়েছিলাম তোমাকে, কিছুই আর রাখতে পারিনি। এক সময় বুঝতে পেরেছি অনেক অনেক দূরে সরে গেছি আমি।আর বোকা কথাগুলো হারিয়ে গেছে। জানো,কর্পোরেট জগতটা খুব কঠিন একটি জায়গা। এখানে আবেগের কোন জায়গা নেই। ইচ্ছে না থাকলেও আমাদের অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। এ ছাড়া কোন উপায় থাকে না।গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানীর সাথে আমার কোম্পানীর লিগ্যাল ফাইট চলছে। এখন আবার শুরু হয়েছে ব্যাংক এর সাথে লিগ্যাল ফাইট। অথচ এই জিনিসগুলি আমি বরাবরই অপছন্দ করতাম। কিন্তু উপায় নাই যে কোন অবস্থায় আমাদের মামলা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ এটা শুধু কেইস জেতার বিষয় নয়। এ হচ্ছে দানবের সাথে একজন মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তোমাকে কতবার এই কথাগুলো জানাতে যেয়েও জানাইনি...মনে হয়েছে শুনে কষ্ট পাবে অনেক। যাই হোক,থাকুক এই প্রসঙ্গ।এই নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছে না।

আমি এখন আর স্বপ্ন দেখি না। কিন্তু আমি জানি তোমার অনেক স্বপ্ন। স্বপ্ন সবাই দেখে

কিন্তু সবাই এই স্বপ্নকে ধরতে পারে না। আন্তরিক ভাবে কিছু চাইলে সেটা অনেক সময় পাওয়া যায়। একদিন হয়ত এই স্বপ্নগুলি ঠিকই তোমারর হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিবে। যদি নিজের মত করে সব কিছু করা যায় তাহলে একটা সময় সব কিছুর মাঝেই আনন্দ খুঁজে পাবে।আমি শুধু তোমাকে এতটুকু বলতে পারি...তুমি মুক্ত...নিজের স্বপ্নের পৃথিবী তুমি মনের মত করে সাজিয়ে নাও।আমি কখনো বাঁধা দিব না বরং খুশি হব।

এই চিঠি পড়ে যদি তোমার খুব রাগ হয় তবে আমার আর কিছুই করার নেই। আর যদি রাগ না হয় তবে তুমি চাইলে আমরা একসাথে আজকে রাতে শেষবারের মত ডিনার করতে পারি, কেকটা কাটতে পারি। এই দু বছরের টুকরো টুকরো সময়গুলো আজ আমার কাছে উদার এক আকাশের মতই বিশাল...

আসিফ”



নিঝুমের চোখ নিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। এক এক করে আগের সব কথা মনে হচ্ছে তার। আসিফ সব চেয়ে সাধারণ আর কৃত্রিমতা ছাড়া মানুষ ছিল বলেই তো ও আসিফ কে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিল। অথচ ও নিজেই দিনের পর দিন আসিফের সাথে প্রতারণা করে গেছে। তাকে একঘেয়ে ভেবে গেছে।বিন্দু বিন্দু করে ভুলে ভরিয়ে ফেলেছে ওদের পৃথিবী। নিঝুমের মনে হয় ওর স্বপ্নগুলো, সুখগুলো, আসিফ কে দেয়া কথাগুলো সারা ঘরে চক্রাকারে ঘুরছে আর ঠা ঠা করে হাসছে।নিঝুম আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে আর কাঁদতেই থাকে...

আসিফ নিঃশব্দে এসে নিঝুমের সামনে দাঁড়ায়, নিঝুমের মাথায় আলতো করে হাত রাখে...বাইরে তখন ঝড়ের সাথে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।নিঝুম মুখ তুলে তাকায়।আসিফ কোনমতে নিজেকে শান্ত করে বলে-কেকটা কেটে ফেলি!! নিঝুম চোখ মুছে মাথা ঝাঁকায়। হাত বাড়িয়ে ছুরিটা নিতেই আসিফ এগিয়ে এসে কেক কাটার জন্যে ওর সাথে হাত ধরে।হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে গান বেজে উঠে...



“You fill up my senses

like a night in the forest

like the mountains in springtime,

like a walk in the rain

like a storm in the desert,

...like a sleepy blue ocean

you fill up my senses, come fill me again.”

নিঝুম চমকে যায়, এই গানটা শ্রেষ্ঠর রিংটোনের জন্যে সেট করা আছে। তার মানে শ্রেষ্ঠ ফোন করেছে। ধাঁধাঁর উত্তর জানতে ফোন করেছে সে। ওর সাথে কথা বলতে ফোন করেছে...।না...আজ থেমে যাক বদলে যাওয়া হাওয়াটুকু।নিঝুম আসিফের হাতটা শক্ত করে ধরে...মোম গলে গলে কেকের উপর পরে যাচ্ছে...এর মাঝে জ্বল জ্বল করছে লেখাটা...”নিঝুম তোমার জন্যে” বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে।হয়েই যাচ্ছে। থেকে থেকে ভেতরের ঘর থেকে গানের লাইনগুলো ভেসে আসছে...নিঝুমের চোখ হঠাৎ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে...আচ্ছা,আজ সারারাত আসিফের সাথে গল্প করে কাটালে কেমন হবে!! সকালের নতুন আলো দুইজন একসাথে দেখলে কেমন হবে!!!নিঝুমের হাত কাঁপছে।চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।সে বুঝতে পারছে না এই আবেগ কি আনন্দের নাকি কষ্টের...


বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে...মোমের আলোয় ঘরের চারপাশটা অদ্ভুত মায়াময় লাগছে...।


(আজকাল আমাদের চারপাশে ত্রিপাক্ষিক জটিলতা ভরা সম্পর্ক অনেক বেশি, এই সব সম্পর্কে কখনোবা নিঝুমরা ভুল করে আবার কখনো বা আসিফরা ভুল করে...মানুষের এই সব ইনফাচুয়েশনগুলো অনেক ঠুনকো হয়, খুব সহজেই ভেঙ্গে যায় নয়ত বা লম্বা সময় টেনে এনে ধপ করে পরে শেষ হয়ে যায়। শেষ পরিনতি কিন্তু সেইম। আসলে একটা সম্পর্কের নাটকীয় রুপ কিংবা কুৎসিত রুপ মানুষই দিতে পারে, তাই থাকুক অনুভূতির প্রাবল্য, সব সম্পর্ক সব সময় বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক..."সব সময় বৃষ্টির বেগ বাড়ুক আর মোমের আলোয় সব কিছু অদ্ভুত মায়াময় লাগুক...লাগতেই থাকুক...)




-একুয়া রেজিয়া

No comments:

Post a Comment