মায়ের গল্প আপনারা অনেক শুনেছেন। অনেক সিনেমা দেখেছেন, বাস্তবে তো প্রতিদিনই মা কে নতুন করে আবিষ্কার করছেন। তবে আজকে আমি আপনাদের একটু অন্য ধরণের একটা গল্প শোনাতে চাই। ঠিক গল্প নয়, এ হচ্ছে জাস্ট অনুভূতি শেয়ার।
আমি নিজেই একজন মা। আমার একটাই ছেলে। ও পড়ে বুয়েটে।
ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময় ও একদিন আমায় এসে বলল, মা, আমার ফ্রেন্ডরা বলেছে কোচিং করার সময় এক সাথে থাকবে। তুমি একটা ব্যবস্থা কর।
ভালো করে শুনে জানা গেল, তারা সবাই ঢাকায় কোচিং করতে চায়। তাহলে তো এক বাসায় বা এক মেসে থাকাই ভালো। পড়াশোনা ভালো হবে।
আমি ওর বাবার সাথে কথা বললাম। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। ভালোই তো, ছেলেরা একসাথে থেকে কোচিং করবে, পড়াশোনা করবে, ভালোই তো।
তো আমার ছেলে সহ আরও পাঁচজন একসাথে থাকতে রাজি হল। আমরা একটা ছোটখাটো অভিভাবক সম্মেলন করলাম। সবাই খুশি।
কিন্তু বাসা পাওয়া যাবে তো?
একজনের আব্বা বাসা খোঁজার দায়িত্ব নিলেন। সফল হল তার অভিযান। কদিন পর এসে বললেন, হ্যাঁ, একটা বাড়ি পাওয়া যাবে, তবে দুমাস আগে থেকেই ভাড়া দিতে হবে। ভাড়া মাসিক ১৬০০০ টাকা। বাসা ফার্মগেটে, একদম কোচিঙের কাছে। তিন রুম, দুই বাথরুম, দুই বারান্দা। আমরা থাকব চারতলায়। বাড়িওয়ালা থাকে তিন তলায়।
ব্যস, নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, কোচিঙটা ভালো মত কর বাপ, টাকা একটু বেশি খরচ হলে সমস্যা নেই।
২
এইচ এস সি শেষ হল। আমি, ছেলে আর ছেলের বাপ, তিনজন ঢাকায় এসে বাসায় উঠলাম।
নাহ, বাসাটা ভালোই। খালি চারতলা বলে প্রচণ্ড গরম। তাছাড়া ফ্যান ট্যান সব নিজেদের কিনে লাগাতে হবে।
কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়লাম। বালতি কিনলাম। মগ কিনলাম। রান্না করার জন্য এক গাদি জিনিসপত্র কিনলাম। এক আত্মীয়র বাসা থেকে একটা ফ্রিজও আনার ব্যবস্থা হল। এখন চেয়ার টেবিল খাট সব কিনতে হবে।
অন্যরাও চলে এল।
এবার নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা দেখা দিল। ছেলেপুলেদের সাথে কি কেউ থাকবে? নাকি তাদের একা একা থাকতে হবে?
ছেলেরা বলল, তারা একা একা থাকবে। একা একা বাজার করবে। একটা বুয়া রাখবে, সে রান্না বান্না করে দিবে।
কিন্তু আমরা বললাম, না। তোমরা এখনও ছোট মানুষ, তাছাড়া এসব টেনশনে তোমরা মন দিয়ে পড়াশুনা করতে পারবে না। তাছাড়া, তোমরা এখানে পড়াশোনা করছ নাকি অন্য কিছু করে সময় নষ্ট করছ সেটা কে নজরদারি করবে?
ওরা মেনে নিল। আচ্ছা, ঠিক আছে।
এখন প্রশ্ন উঠল, কে থাকবে?
কারও আব্বা তো থাকার প্রশ্নই আসে না, উনি তো আর রান্না বান্না করে খাওয়াতে পারবেন না। তাছাড়া পুরুষরা সবাই হয় চাকরি নয়তো ব্যবসা করেন।
সুতরাং, আমাদের ভিতর থেকেই কাউকে থাকতে হবে। কে কে থাকবে?
দুজনের আম্মু ডাক্তার। একজনের আইনজ্ঞ। আর দুজন গৃহবধূ। কিন্তু তাদের সবারই বাসায় ছোট ছেলে বা মেয়ে আছে।
একমাত্র আমিই সে, যার গৃহকর্ম ছাড়া আর কোন পেশা নেই এবং যার কোন ছোট ছেলে মেয়ে নেই। সুতরাং, ভাবী, আপনিই থাকবেন।
আমি? একা? এতগুলো ছেলেকে সামলানোর জন্য আমি একা?
জি, একা।
বুঝতে পারলাম, উপায় নেই। এটা ছাড়া আর ভালো কোন অপশনও নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে। তো আমাকে কি কি করতে হবে?
এই ধরুন, সবার জন্য তিন বেলা রান্না করা, হাড়ি পাতিল ধোয়া, দেখে শুনে রাখা...এই তো, এইসব।
মুখে উনি আর বললেন না, টাকা পয়সার হিসাব করা, কাপড় চোপড় ধোয়া, বাজার করা...ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাকে বুঝে নিতে হল।
দায়িত্ব বুঝে নিলাম। ব্যস, শুরু হল আমার নতুন জীবন।
৩
সারাদিন গাধার মত খাটি। দুঃখের ব্যাপার, বেশির ভাগটাই করি পরের ছেলের জন্য।
আমার ছেলেটা সারাদিন পড়ে আর মাঝে মাঝে মোবাইল টেপাটিপি করে। তার বেশি বায়নাক্কা নেই। যত ঝামেলা সব অন্য ছেলেগুলাকে নিয়ে।
একটা ছেলে আছে যে গভীর রাতে কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলে। পুটপুট পুটপুট করে কথা বলতেই থাকে। আমি একদিন ঘুমাতে যাবার আগেও দেখি ওর কানে মোবাইল, উঠে ফজরের নামাজের জন্য অজু করতে যাওয়ার সময়ও দেখি ওর কানে মোবাইল। পুটুর পুটুর... পুটুর পুটুর...
আরেকটা ছেলে সারাদিন মোবাইল টেপে। কানে থাকে হেডফোন।
আরেকটা ছেলে সারাদিন ঘুমায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখ টকটকে লাল হয়ে যায় তার।
নানা জনের নানা কিসিম।
একদিন ওদের রুমে গিয়ে দেখি, আমাকে দেখেই পিছনে এক সেট তাস লুকাল সোনার চানেরা। তার পর থেকে লুকানোও ছেড়ে দিল।
একদিন ওরা রাতে রুম বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমি স্পষ্ট গন্ধ পেলাম যে বস্তুটার, তা একটি জ্বলন্ত সিগারেট থেকে নির্গত ধোয়া না হয়ে যায়ই না।
প্রথম প্রথম ওদেরকে পালা করে বাজার করতে নিয়ে যেতাম। প্রথমে ওরা ভালোই যেত। একবার বললেই সাথে সাথে উঠে যেত।
পরের দিকে ওরা সুর ধরল, আন্টি, পরীক্ষা। আন্টি, অমুক। আন্টি, তমুক।
সুতরাং আমি একাই বাজার করতে শুরু করলাম।
ওরা যেদিন কোচিং থাকে সেদিন কোচিঙে যায়, না থাকলে পড়ে পড়ে ঘুমায়। খাওয়ার সময় হলে খেতে দিই, রাজকুমারেরা ইচ্ছা হলে তখন খায়, নাহলে দুঘণ্টা পরে খায়। তারপর প্লেট ধোয়ার দায়িত্ব আমিই পালন করি।
কোচিং কাছে হওয়ার জন্য প্রায় প্রতিদিনই ওদের বন্ধুরা আসে। হই হল্লা করে। তখন তাদের খাওয়াতে হয়। তারা রাজার হালে মৌজ মাস্তি করে বিদায় নেয়।
এরই মধ্যে একদিন আমি আমার কাজকর্মে সহায়তার জন্য একটা পিচ্চি মেয়েকে পেয়ে গেলাম। ব্যস, কাজ অনেক কমল।
আমি প্রতিদিনই ওদের জিজ্ঞেস করি, বাবা, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? তোমার আম্মু ভালো আছে তো? একটু এসে থেকে যেতে বল...
এর মাঝেই দু একজনের জর হয়, পাতলা পায়খানা হয়। যখন হয়, তখনই আন্টি আন্টি করে অস্থির।
আবার সেগুলো সেরেও যায়। তখন কে আন্টি আর কে আংকেল।
একদিন আড়াল থেকে শুনতে পাই, ‘ঐ মহিলার রান্না খেয়েই এই অবস্থা। এর চেয়ে হোটেলের রান্নাও ভালো’।
কাউকে কিছু বলি না। একাকি কাঁদিও না। স্রেফ ভুলে যাই।
৪
একদিন আড়ালে শুনে ফেলি, ‘এত টাকা লাগে কেন? এত এত টাকা যে মহিলার হাতে দিই, এগুলা কই যায়?’
কোথায় আর যাবে? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, তোমাদের পেটেই যায় বাছাধন।
একদিন আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাই। ব্যস, ফোনের পর ফোন, আপনার কি অবস্থা...রান্না না করলে ছেলেরা খাবে কি?
হাসি পায় শুনে। মরে গেলেও কি বলবে, কি ব্যাপার, মরে যে গেলেন, রান্নাটা করে রেখেছিলেন?
আমার নামে আরও অনেক কথা শোনা যায়। আমি নাকি সবার টাকা নিজের কাজে ব্যবহার করছি। নিজের ছেলেকে নাকি আমি ভালো ভালো খেতে দিচ্ছি, আর অন্যের ছেলেদের নাকি একদমই যত্ন করছি না। তারা নাকি না খেতে পেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে, আরেকটু হলে মারাই যাবে...আহা!
একদিন আমার ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। আমিও সাথে গেলাম।
ব্যস, আমাদের খাবার কি হবে? কে রান্না করবে? আমরা কি না খেয়ে মারা যাব?... ইত্যাদি।
কাজের মেয়েটার বেতন দিলাম। দেবার সময় মনে হল, আমার বেতন কে দেবে? বেতন না হোক, একটু প্রশংসা তো করা যায়। একটু সম্মান তো দেয়া যায়।
থাক, না-ই বা পেলাম ওসব। ওসব আদিখ্যেতা। এখনকার ছেলেরা ওসব ওল্ড ফ্যাশান পছন্দ করে না।
৫
সমস্যা আরও বাড়ল। বাড়িওয়ালা একদিন পানি আর বিদ্যুৎ কেটে দেবার হুমকি দিল।
কারণ? বর্তমান মাসের ভাড়া বাকি পড়েছে, সামনের দুমাসের ভাড়া অগ্রিম দেয়া হয়ে গেছে।
মহাবিপদ। কোথা থেকে টাকা জোগাড় করে একজনের আব্বা বাঁচালেন।
টাকা নিয়ে সমস্যার কোন শেষ নেই। আমার হাজবেন্ড একদিন বাড়ি থেকে শাক সবজি নিয়ে এলেন। আমি তা খাতায় লিখে রাখলাম।
আশ্চর্য, এইটা খাতায় লেখা তাদের পছন্দ হল না। তারা কি ভেবেছে এটা তাদের ফ্রি ফ্রি খাওয়ানো হল?
টাকা পয়সা নিয়েই দুজনের আব্বার সাথে বিশাল একটা ফাইটিঙে জড়িয়ে পড়লাম আমি।
আর কাহাতক সহ্য করা যায়? বুয়েট পরীক্ষার দিন আমি ঘোষণা দিলাম, এখন থেকে আর একসাথে রান্না হবে না। আমি আর আমার ছেলে আলাদা, তোমরা আলাদা।
ওরে বাপরে, যেন পারলে কাঁচাই খেয়ে ফেলে। যেন পরীক্ষার দিন সকালে খেতে পায়নি বলে ওরা মারাই গেছে। যেন এজন্যেই ওরা চান্স পাবে না।
৬
নভেম্বর। সব পরীক্ষা শেষ। সবাই মোটামুটি চান্স পেয়েছে। দুজন মেডিকেল, আমার ছেলে বুয়েট, একজন আর্মি, দুজন কুয়েট।
আজ সবকিছু উঠিয়ে চলে যাবার দিন। আমরা গোছানো প্রায় শেষ করে এনেছি। এখন শুধু যাবার পালা।
ব্যাগের চেনটা আটকাব, এমন সময় দেখি একজন বলছে, আন্টি আসব?
হ্যাঁ, এস।
ওরা সবাই ভেতরে এসে দাঁড়াল। একজনের হাতে কি যেন ধরা।
ওরা জিনিসটা এগিয়ে দিল। আমি বললাম, এটা কি?
ওরা বলল, খুলেই দেখুন।
আমি খুললাম, খুলে দেখি একটা সুন্দর মগ, তার গায়ে লেখা, I love you, Mom.
ব্যস, সবকিছু ভুলে গেলাম। আমাকে কে কি ভুল বুঝেছে আর কে কি গালি দিয়েছে কিছুই মনে পড়ল না। আমি যে বেতনহীন বুয়ার দায়িত্ব পালন করেছি এতদিন তাও মনে পড়ল না।
শুধু এই আমি যেন একজনের মা থেকে ছয়জনের মা হয়ে গেলাম। সবার মা হয়ে গেলাম। সারা বিশ্বের মা হয়ে গেলাম।
................
- Saleh Tias
No comments:
Post a Comment