Subscribe:

নীল ডায়েরি

আজ বিকেলে অফিস থেকে একটু আগেই ফিরে এলো অয়ন।

পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চির শরীর টা কে খাট এ শুইয়ে দিল জামা না ছেড়েই।

হালকা ফ্রেম এর চশমা টা ছুঁড়ে দিল বিছানার এক পাশে।

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সে অস্ফুট স্বরে বলল...



'শেষ বিকেলের আলো তুমি কি আমার বন্ধু হবে...?'  

 

অনেক দিন পর হটাৎ দেখা হয়েছে অহনা-র সাথে। ওদের অ্যাড ফার্মের মার্কেট ডেভেলপার এর রুমে অহনা কে দেখে থমকে গিয়েছিল অয়ন।গায়ের রঙ আগের চেয়ে গভীর, আর চুল গুলো যেন আরও বেশি মোহনীয় লাগছিল। মুখে ছিল একটা স্নিগ্ধ প্রশান্তি। সানগ্লাসের আড়ালে চোখ দুটো অদৃশ্য ছিল বলে অয়ন বুঝতে পারছিল না অহনা এখনও তার ওপর রাগ করে আছে কিনা !  

'অয়ন, ইনি আমাদের নেক্সট প্রজেক্ট টা তে পারটিসিপেট করছেন। পরিচিত হয়ে নিন, আর ওনাকে আপনি একটু ব্রিফ দিয়ে দিন ,প্লিজ'

নিজেদের সামলে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা টুকু সেরে নিল দুজনেই।


অয়ন রুম থেকে বের হবার সময় বলল,'প্লিজ, আসুন'   


নিজের রুম এ এসে, অয়ন যখন এক কাপ কফির অর্ডার দিচ্ছে, অহনা সামনের চেয়ারটায় বসে ভাবছে, কতদিন ? উমমম ... প্রায় পাঁচ বছর পর দেখা হোল। অয়ন বেশ পরিপাটি এখন। এক সময়ের আগোছালো অয়ন আজ দেশের সব চেয়ে নাম করা অ্যাড ফার্ম এ কাজ করছে ! যে কিনা রাত বারো টা তেও শুধু তার জন্যই স্টেশনে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিত ভোর চার টায় তাকে ট্রেন থেকে রিসিভ করবে বলে...   

'কেমন আছো তুমি ?'

সেই আগের মত করেই বলল অয়ন। এখন অহনার চোখ দেখা যাচ্ছে। সান গ্লাস টা টেবিল এ রাখা। চোখের নিচে একটু যেন রাত জাগার ছাপ।

'এইতো , চলে যাচ্ছে। তুমি কেমন আছো?'

'আমারও অনেক টা সে রকম ই। চলছে।গতি নেই, তাই বলে থেমে ও নেই'

'ও' অহনা বলল, টেবিল এর এক পাশে রাখা অয়নের সেই নীল ডায়েরি টা দেখে। এখনও অয়ন ডায়েরি টা সাথে রাখে !!!

এক সময় এই ডায়েরীর এক পাশে অয়ন, অন্য পাশে অহনা একটি করে কবিতা লিখত...একদিন এর কাছে, অন্যদিন ওর কাছে ডায়েরি টা থাকত। সব কিছু যেদিন শেষ হয়, সেদিন ডায়েরি টা অহনা অয়ন কে দিয়ে বলেছিল...

'আমার শেষ লেখা টা ছিঁড়ে ফেলে দিও, পড়া হয়ে গেলে'

অহনার খুব জানতে ইচ্ছে করছে... অয়ন কেন ডায়েরি টা এখনও তার কাছে রেখেছে...কিন্তু ও কোন প্রশ্ন করল না।

'তোমার বর কি করছেন?'এখনও কি চিটাগং এই থাকো?'

'হুম, এখনও ওখানেই থাকি।ঢাকায় খুব কম আসা হয়।এবার দুদিন থাকবো'

 

'আচ্ছা, চলো, আগে অফিসের কাজ টা সেরে নেই দুজনে' ...  



ঘণ্টা খানেক পর...

অফিসের কাজ টা দুজন বুঝে নিল। এরপর...

কার্নিভ্যাল রেস্তোরাঁ-র কোণার টেবিল টা তে দুজন পাশাপাশি বসে।লাঞ্চ শেষ।

টুক টাক যে কথাগুলো হলো খাবারের ফাঁকে তাতে কেউ ই এখনও জানতে পারল না নিজেদের জীবন সঙ্গী কে কেমন আছে।

 

অহনা তখন ইচ্ছে করেই অয়নের প্রশ্ন টা এড়িয়ে গিয়েছিল। ওর খুব জানতে ইচ্ছে করছে, অয়ন কি বিয়ে করেছে ? বাইরের ঢাকা শহর টা যত টা না লজ্জাহীন, অহনা তত টাই আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে , কথা টা জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবতে গিয়ে...  

'চল, তোমাকে নামিয়ে দেই'

'চল' অহনা মুখ নামিয়ে বলল।

 

এক সময়ের ডানপিটে অহনা আজ কত বদলে গেছে, অয়ন ভেবে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল চুপি চুপি।   

'একটা কথা বলি?' নিজের ঠিকানার কাছাকাছি এসে অহনা মুখ খুলল।

'বল'...অয়ন গাড়ির মিউজিক টা একটু নিচু করে অহনার দিকে তাকাল অস্থির চোখে...

'ডায়েরি টা একটু দেবে আজ? পুরনো লেখা গুলো খুব পড়তে ইচ্ছে করছে' ।অহনা লজ্জায় লাল হয়ে গেল বলতে গিয়ে।

 

'আচ্ছা,নাও।কিন্তু কোন প্রশ্ন করোনা। পড়া হয়ে গেলে।'  

আজ কের এই কথা গুলো ভাবতে ভাবতে অয়ন কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। ফোন এর চিৎকার এ ঘুম ভাঙল।

 

একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। অয়ন ফোন না ধরে উঠে ফ্রেশ হতে গেল।  

ঘড়ি তে এখন রাত ১১ টা !

১৪ তলার শান্তিনগরের এই ফ্ল্যাট টার বিশাল বারান্দায় আজ এক টুকরো জোছনা এসে নাচছিল...

 

অয়নের হাতে গরম এক কাপ কফি। ও ভাবছিল, ডায়েরি টা পড়া হয়ে গেলে অহনা কি ভাববে তাকে নিয়ে !  

অয়ন আর অহনা দুজন দুজন কে ভীষণ ভালবাসত। কেউ জানত না। কিন্তু যখন জানা জানি হলো, অহনার বাবা অয়ন কে মেনে নিতে পারল না। কারন অয়ন এলাকায় সব চেয়ে বাজে ছেলে হিসেবে পরিচিত।যে কিনা পড়াশুনা ছাড়া আর সব কিছুই করে।


দু একবার থানা তেও যেতে হয়েছিল। শুধুই একটাই গুন ছিল... ভীষণ ভালো গান করত সে। এত সুন্দর গায় , এমন একটা ছেলে কি করে এত নষ্টামি করতে পারে, এই টা ছিল একটা রহস্য, এলাকার লোক ওকে যত ভালবাসত ওর গান শুনে, ঠিক তত টাই ঘৃণা করত ওর মাস্তানি দেখে।অহনা অয়নের গান শুনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।   


একদিন অয়নের গান শেষে একটা নীল ডায়েরি দিয়েছিল অহনা। সেই থেকে ওদের প্রেম এর শুরু। আর আস্তে আস্তে অয়নের ভালো হয়ে যাওয়ার গল্প টাও শুরু হয়। কিন্তু তবুও আগের কুখ্যাতির জন্য ওর বাবা ওদের প্রেম মেনে নিতে পারে নি।  

শেষ দিন অহনা ডায়েরি তে লিখেছিল...


'আমি তোমাকে ভালোবাসি না। এতদিন যা ছিল তা শুধুই এক ধরনের মোহ ছিল।অনেক ভেবে দেখলাম, তোমাকে বিয়ে করার মত সত্যিকার এর প্রেম আমার মধ্যে নেই। ভালো লাগা টা আছে আগের মতই, কিন্তু সেটা ভালোবাসা নয়।কিছু মনে করো না।আমার বিয়ের কথা হচ্ছে।আর যাকে বিয়ে করার জন্য বলা হচ্ছে তাকে আমার পছন্দ হয়েছে।আজ রাতেও আমাদের কথা হবে ফোনে। ও আমাকে পছন্দ করেছে। আমার মা বাবার ইচ্ছেতেও তুমি নেই।আমাকে ক্ষমা করে দিও'  

সেদিন অয়ন সারা রাত অহনা দেড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। অহনা কে অনেক অনুরধ করেছিল একবার একটু কথা বলার জন্য। এতদিনের প্রেম কি করে মিথ্যে হয় টা অয়ন কিছু তেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু অহনা সেই সুযোগ তাকে দেয় নি।

 

অয়ন চিটাগং ছেড়েছিল সেদিন ভোর বেলাতেই।   

আবার ফোনের চিৎকার। অয়ন দেখল সেই অচেনা নম্বর।

 

ফোন টা রিসিভ করল অয়ন।   

ওপাশে ভেজা গলায় কে যেন বলল,

'ঘুম ভাঙ্গালাম? সরি'

এতদিন পরেও গলা টা চিনতে একটু ও ভুল হলো না, অহনা ! অয়ন বলল,' নাহ জেগে ছিলাম, তুমি এত রাতে?'

'ঘুম আসছিল না, ডায়েরি টা পড়ছিলাম। শেষ লেখাটায় এসে চোখ ভিজে গেল, এ তুমি কি করেছ অয়ন?'

'আমি তোমাকে বলেছিলাম কোন প্রশ্ন করতে পারবে না।আমি আমার মন কে বোঝাতে পারি নি। মন টাও সত্যি টাকে মিথ্যে বলে মেনে নিতে পারে নি'

'আমি কাল তোমার সাথে দেখা করতে চাই অফিস টাইম এর পর ।'

'আচ্ছা, তুমি ঘুমাও এখন, কাল সারা রাত ট্রেন জার্নি করেছ, আজ রেস্ট নাও
'অয়ন এর গলা কেঁপে এলো কথা শেষ করতে গিয়ে।

'তুমিও শুয়ে পড়,তুমি অনেক শুকিয়ে গেছ...পারলে এক গ্লাস দুধ গরম করে খেয়ে নাও'

'ওকে, শুভ রাত্রি'...

 

অয়ন শুনল...একটা কান্নার সুর... লাইন টা কেটে যাবার আগে...   

পরদিন......

ডায়েরি টা ফেরত দিল অহনা।আজ রাত দশটায় চিটাগং যাবার ট্রেন অহনার। অয়ন বলল,'আমি তোমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসব?'


'না' অহনার জবাব।

বাসায় ফিরে ডায়েরি টা খুলে দেখল অয়ন। অহনার সাথে আর কোন দিন ই হয়ত দেখা হবে না ওর। ভাবতেই মন টা যেন বৃষ্টি তে ভিজে উঠল। কি ভীষণ শুন্যতা ওকে আঁকড়ে ধরল। অনেক ক্ষণ চোখ ভেজানোর পর । ও যখন শেষ লেখা টা পড়তে গেল, দেখল...

একটা লাইন...

'আমি সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, কারন আমি চাইনি আমার মত তোমার জীবন টাও নষ্ট হয়ে যাক... আমি আজো একা থেকে গেছি... কিন্তু ভাবতেই পারি নি... তুমিও এভাবেই একা রয়ে যাবে...

 

এরপর লাল গোলাপের পাপড়ির রঙ এ লেখা একটা লাইন........ ...... I love you'  

!!!!!!

অয়ন দেখল...ঘড়ি তে ৯ টা ৩০ ।

শান্তিনগরের রাস্তায় একটা প্রিমিও ছুটে চলেছে কমলাপুর স্টেশনের দিকে...দুর্দান্ত গতি তে...

অয়ন এর খুব ইচ্ছে করছে...

ডায়েরি তে অহনার আজ লেখা শেষ লাইন টার উত্তরে বলবে...

অহনা কে আজ সে আরও একবার বলবে...

'I love you too....'

সময় যেন আজ ইচ্ছে করেই একটু জোরে ছুটছে...

অয়ন গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল,

আজ সে কিছুতেই হারবে না...  

 


~BluE ButterflY~

 নীল প্রজাপতি

1 comment: