Subscribe:

ছাগল-নামা ! ( একটি ছাগল প্রেমের গল্প )

গতবার কোরবানীর সময় একটা ছাগল কিনা হইলো। সাধারনত প্রতিবার ঈদের সময় আমি গরুর হাটে যাবার দিন কেটে পরি। আমার বাবা আর মেজ চাচা দুজনে গিয়ে গরু কেনে শেয়ার করে। আমি চান্সে ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ায় বিরক্তিকর কাজটা কাজিনদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে।


ক-বছর আগে ঈদের শেষমুহুর্তে তিলোত্তমা ঢাকা যখন গরুর লাদা, ময়লা পানি আর খড় বিচালীর গন্ধে হাবিয়া দোজখের কাছা-কাছি, সেই মুহুর্তে কিছু ছাগল ওয়ালা মহল্লার রাস্তায় রাস্তায় কয়েকটা রোগা পটকা ছাগল নিয়ে ঘুরছিলো। ছাগলকে বলা হয় গরীবের গাভী। খুব গরীব-প্রান্তিক লোকেরা ছাগল পালে পরম আদরে। কিন্তু দারিদ্রের কাছে হেরে গেলে সেগুলো চলে আসে ঢাকার বাজারে, আর আমরা ঢাকাবাসী সেটাকে কেটে কুটে খেয়ে ফেলি। সেরকম এক ছাগল ওয়ালা কিভাবে জানি আমার বাবার হাতে ছাগলটা গছিয়ে দিল।



ছাগলের দড়ি হাতে বাসায় ঢুকতেই আব্বু আম্মুর রোষানলে পড়লেন। এই পটকা ছাগল কিনলা কেন? এটারে রাখবা কই, হেন তেন। চাচার বাড়িতে জায়গা আছে, কিন্তু ছাগল নিয়ে অতদুর রেখে আসা যায় না। তাই ঠিক হলো গরু ওখানেই থাকবে আর ছাগল থাকুক বারান্দার সামনের জায়গাতে। গ্যারেজে জায়গা নেই, বাসায় বারান্দার সামনে গ্রীল দেয়া অংশের বাইরে একটা জায়গা আছে, ওখানে কিছু গাছ পালা রাখা আছে, সেগুলো সরিয়ে ছাগল রাখা হলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই মহানন্দে সে একটা পাতাবাহারের গাছ, কয়েকটা গোলাপ খেয়ে ফেলে আমার ক্যাকটাস কালেকশানের মধ্যে হামলা চালালো। ক্যাকটাস গাছ গুলো আমার অতি যত্নের ছিল, বেশ কাটাওয়ালা, সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে খুব সহজে কপ কপ করে সেগুলো খেয়ে হজম করে ফেলে বাথরুম পর্যন্ত করে ফেললো। বেচারাকে কিছু বলার উপায় নেই। নিতান্ত গোবেচারা ছাগল, সামনে গেলেই দাড়ি নাড়িয়ে গায়ের সাথে মাথা ঘসতে থাকে। খুবই আহলাদী।

জ্বালাতন শুরু হলো রাতে। ছাগুলে বারান্দার পাশেই ড্রয়িং রুম। অনেক রাত পর্যন্ত আমি বাবা মায়ের সাথে ঐরুমে ছিলাম। সবাই চলে আসতেই ছাগল শুরু করলো গলা ফাটিয়ে কান্না। যারা গ্রামে থেকেছে তারা হয়তো ছাগলের কান্নার চেনেন। বাচ্চা ছেলের মত তারস্বরে করুন আর্তনাদ। সেই শব্দ সহ্যকরার খুব কঠিন। বুক ভেঙ্গে যায়। আমরা তরিঘরি করে বারান্দায় যেতেই ছাগল চুপ। ভালো মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে দাড়ি নাড়াতে থাকে। একটূ আগে চিল্লায় চিল্লায় কান্নার কোন লক্ষনই নাই। ফিরে আসতেই আবার ঝামেলা। এতো মহাজ্বালতন। বুঝতে পারলাম গ্রামের চাষী সম্ভবত ছাগলটাকে তার সাথে নিয়েই ঘুমাতো (গ্রামের খুব গরীব বিশেষ করে মহিলারা ছাগল পালে এবং যেহেতুর তাদের থাকার ঘর দোর থাকেনা, তাই সাথে নিয়েই ঘুমায়)। সে মানুষ ছাড়া একা একা থাকতে অভ্যস্থ না। আমরা পালাক্রমে সবাই মিলে ছাগলকে সঙ্গ দিলাম।একবার আব্বু থাকে, কিছুক্ষন পর আম্মু, তার পরে আমি, কাজের মেয়েটা, একা রাখলেই চিল্লায় চিল্লায় কাঁদে। ঈদের আরো একটা রাত বাকী। ভয়ে সবার অবস্থা কেরোসিন। যেই হোক রাত দুটো আড়াইটার দিকে ছাগল ঘুমালে আমরা চুপিসারে চলে আসলাম। ভোড়রাতে সূর্যের আলো ফুটতে বাকী থাকতেই সে বুঝে গেল আমরা ফাকি দিয়ে পালিয়েছি, সে শুরু করলো গলা ফাটিয়ে কান্না। সে কি কান্না, কাঁচা ঘুম ফেলে সবাই দৌড়ে আসলাম। এই ছাগল কিনে তো পুরা ফ্যামিলির মাথা পাগল করে দেবার অবস্থা করলো।

গল্পটা শেষ করতে ইচ্ছা করছে না। ঈদের দিন সবাই মিলে বেচারাকে ধরে কেটে কুটে খেয়ে ফেললাম। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তার প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে শুরু করেছিলেন, একদিন মেয়াদে ছাগলটাও অনেক প্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। ঢাকা শহরে প্রান কেন্দ্রে একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে বসে যতই মায়া জন্মাক ছাগল পোষা সম্ভব নয়।

পোষা প্রানীর ক্ষেত্রে ছাগল আর বিড়ালের উপরে কিছু হয়না। দুটোই খুব আদুরে আর ন্যাকামীতে ওস্তাদ। এমন ছাগল দেখেছিলাম যেটাকে প্লেটে না দিলে খেত না। ব্যাপার আজব, সারাজীবন ছাগলকে ঘাটে মাঠে ঘাস খেয়ে চড়ে বেড়াতে দেখেছি। আদর পেয়ে বখে গিয়েছিল।আমার এক ভাই একবার একটা ছাগল পুষেছিলেন শখ করে। কি ভাবে জানি কই থেকে ছাগল যোগার করে এনেছিল, কুরবানীর মাসখানেক বাকী, এটাকে ততদিন বাড়িতেই রাখা যাক। বাড়ির পিছে বাউন্ডারী ওয়ালের ভেতরেই একটা বড় জায়গা আছে, অনেক ঘাস, চড়ে বেড়াতে পারবে। আমার এক আপার এক ছেলে হলো তার কিছুদিন আগে। দুলাভাই রেডক্রিসেন্টের লোক, শখ করে জীন হেনরী ডুনান্টের আদলে ছেলের নাম রেখেছিলেন হেনরী। ভাইয়ার এই ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হয়নি বাকীদের, মুসলমানের ছেলের নাম হেনরী। আমার ঐ চাচাতো ভাই প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে ছাগলের নাম রাখলো হেনরী। আপা অবশ্য ব্যাপারটায় তীব্র বিরোধিতা করলেন। ভাইয়া ভাংলেন না মচকালেন, ছাগলের নাম রিমিক্স করে করা হল হানরু। (এটা একটু সন্দেহের ব্যাপার, ভাইয়া অল্প দিন হলো বিয়ে করেছেন, ওনার শ্বশুরের নাম হারুন),

হানরুর চড়ে বেড়ানোর জায়গা ছিল বাড়ির পিছনের জায়গাটা। ওখানেই তাকে রাখা হত। হানরুরুরুরুরু বলে ভাইয়া ডাক দিলেই ছুটে আসতো। অল্পদিনেই দেখা গেল হানরুর ঘাসের চেয়ে অন্য খাবারে রুচি বেশী। বিশেষ করে পিছে রোদে শুকাতে দেয়া কাপড় চোপড় খেতেই বেশি পছন্দ। আমার বড় চাচীর (ঐ ভাইয়ার মা) শাড়ি তার ফেভারিট ডিশ। একদিন চাচীর নতুন শাড়ি কপকপ করে খেয়ে ফেলে প্রমান করলো, “ছাগলে কি না খায়”। চাচী ভাইয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার চেষ্টা করলেন কয়েকবার। হয় ছাগল থাকবে নইলে তুই। কিছুতেই কিছু হলো না। ছাগলে সব খায়, শাড়ি ছাড়াও কাগজ এবং আঙ্গুর, কলা আর মিষ্টি আলুর প্রতি হানরুর সীমাহীন প্রীতি দেখা গেল। আমাকে পড়াতে আসতেন তখন আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরটার এক দুর্ধর্ষ টিচার। বাচ্চা কাচ্চাদের কঠিন মাইর ধোর করার জন্যে কিংবদন্তি তুল্য খ্যাতি। স্যারকে একদিন হোমওয়ার্ক না করার কারন হিসাবে বলেছিলাম হানরু আমার খাতা খেয়ে ফেলেছে। হানরু বাধা থাকতো না। ঘুরতে ঘুরতে ঘরে ঢুকে পড়তো, স্যারের পাঞ্জাবীর কোনা চিবিয়ে দিয়েছিল একবার। তারপরেও স্যার পাত্তা না দিয়ে আমাকে কঠিন ধোলাই দিলেন। আমার অজুহাতকে প্রমান করতেই যেন স্যারের জুতো জোড়া নাই হয়ে গেল। আমার একটা কুকুর ছিল, “বাঘিরা’ নামের। কিন্তু সে বিশেষ লাজুক স্বভাবের। অচেনা লোক দেখলে ঘেউ ঘেউ করার বদলে শরমে সে ভিতর বাড়িতে পালাতো। আমি হলফ করে বললাম এটা বাঘিড়ার কাজ নয়, হানরু স্যারের জুতো নিয়ে পালিয়েছে।

এবং ঈদের সময় হানরুকেও কেটে কুটে খেয়ে ফেলা হলো। ঐ ভাইয়া কাজটা করেন নি। আরেক আমাদের আধিয়ার (রংপুর অঞ্চলে বর্গাচাষীকে আধিয়ার বলে) যত্নের সাথে কাটাকুটি করলো। আমি তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রির বাচ্চা। গলা ফাটিয়ে হানরু হানরু বলে কাঁদলাম। ভাইয়া সারাদিন দরজা লাগিয়ে বসে থাকলেন। আমার সাথে যোগ দিলেন আমার বড় চাচী, প্রায়ই যার শাড়ি ছাগল খেয়ে ফেলতো। উনি আগে ছাগলটাকে দুচোখে দেখতে পেতেন না। কেউ সেবারে ছাগলের মাংস স্পর্শ করতে পারলো না।
:P :P :P

Blog ID= সৌম্য
somewhereinblog.net

1 comment: