Subscribe:

নীলচে ভালোবাসা

পার্কের ভিতর মাঝারি সাইজের ভাস্কর্যটার বেদীর উপর বসে আছি। পাশে বসে আছে একটা অষ্টাদশী তরুনী। বেশ অস্বস্তি বোধ করছি।আমার একুশ বছরের জীবনকালে আমি এর আগে কখনো কোন তরুনীর এত কাছে বসিনি। দরদর করে ঘামছি সেই কখন থেকে। বডি স্প্রে টা কতক্ষন সার্ভিস দিবে বিধাতা জানেন। মেয়েটার শরীর থেকে অবশ্য অদ্ভূত মিষ্টি একটা সুবাস আসছে। কিন্তু সে সুবার আমার নাসিকারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারছে না। মস্তিষ্ক নিজের ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে চিন্তিত।


চেষ্টা করছি নরমাল থাকতে।কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারছি না। মেয়েটা একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে, আবার অন্যদিকে ফিরে মুখ টিপে হাসছে। আমি মিনমিন করে বললাম “বেশ গরম পড়েছে”।
বলেই বুঝতে পারলাম বছরের হাস্যকরতম কথা বলে ফেলেছি।

আজ পহেলা জানুয়ারী। ইংরেজী নববর্ষ। শীত এখন পুর্নোদ্যমে তার দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে। গরম লাগার কোন কারন নেই। মেয়েটা নিশ্চয় বুঝে ফেলেছে আমি নার্ভাস। লজ্জার ব্যাপার। মেয়েটাকে এখন ভুল প্রমান করতে হবে। একটু দূরে বাদামওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। কিঞ্চিত ভাব নিয়ে ডাকা যায়। তারপর বাদাম কিনে তাকে বাদামের মাপ বিষয়ক কিছু র‌্যান্ডম ঝাড়িঝুড়ি দেওয়া যায়। যেই ভাবা, সেই কাজ। মুখ খুলে বাদামওয়ালাকে ডাকতেই বুঝতে পারলাম একটু আগে গড়া আমার বছরের হাস্যকরতম ঘটনার রেকর্ড খুব কম সময়ের মধ্যেই ভেঙ্গে দিয়েছে আমার এই ডাক। ভোকাল কর্ড বিশ্বাসঘাতকতা করল, আমার মুখ দিয়ে নারীকন্ঠ বেরিয়ে এসেছে। বাদামওয়ালা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠল “জ্বী আপা”।


আমার পাশে বসা তরুনী এবার সশব্দে হেসে উঠলো।
-তুমি এত নার্ভাস কেন?
-কই নার্ভাস না তো!
-হুম, সেটা দেখতেই পারছি।

আমি চুপ করে রইলাম। তরুনী বলল “চলো উঠে হাঁটি একটু”।
প্রস্তাব পছন্দ হলো আমার। বসে বসে ডিমে তা দেবার চেয়ে হাঁটাই ভাল। উঠে পড়ে হাঁটতে লাগলাম দুজন। পার্কটা বেশি বড় না। পুরোটা ঘুরে আসতে মিনিট দশেক লাগে। সাধারণত এখানে বিকালে কপোত-কপোতীরা বাকবাকুম করে। একুশটা বছর দেখে এসেছি। আজ আমি একজন কপোত। আর তরুনী একজন কপোতী। বাকবাকুম বিশেষ করা হচ্ছে না। এখনো নার্ভাস লাগছে আমার।

পার্কটা আজ একটু ফাঁকা। বছরের প্রথম দিন। সবাই হয় রিকশায় ঘুরছে, না হয় কোন রেস্টুরেন্টে বসেছে। আজ আমার ওপেনিং ম্যাচ। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মত শুরুতে তাই কিছুটা নার্ভাস। পাশা্পাশি হাঁটতে হাঁটতে কখনো ওর হাতের সাথে আমার হাতের স্পর্শ হচ্ছে। বেশ কয়েকবার এরকম হলো। হাফ-ভলি বল…সুযোগটা নিলাম। তামিম ইকবালের মত রিস্ক নিয়ে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে সজোরে হাঁকালাম। হাতটা খপ করে ধরে ফেললাম। বল আকাশে উড়ছে। ব্যাটসম্যানের মনে উত্তেজনা, ক্যাচ হবে নাকি ছয় ! আমার প্রতিটা রক্ত কনিকায় আলোড়ন। হাতটা কি ও ছাড়িয়ে নিবে? এক সেকেন্ড গেল…দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড……এভাবে এক মিনিট। বুঝতে পারলাম বল মিড অন ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে সিমানার বাইরে। ছক্কা!

সেদিন বাকিটা সময় ওর হাত ছাড়িনি। কথা হয়ত খুব বেশি হয়নি। তবে হাতের এই বন্ধনটা ডাটা ক্যাবলের মত কাজ করেছে। আমার আবেগগুলো ওর ভিতর স্থানান্তরিত হয়েছে। নতুন এ জীবনের ইনিংসের শুরুটা সব মিলিয়ে খারাপ গেল না।



তরুনীর নাম ছাড়া কাহিনী চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর। মহিয়সী এই নারীর নাম তুর্না। আমাদের কলোনীতে ওরা যেদিন প্রথম এল সেদিনই ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ব্যাপারটা অবশ্য যেরকম শোনাচ্ছে ঠিক সেরকম নয়। প্রথম দর্শনে এর পূর্বে আরো শ’খানেক রমনীকে ভালোবেসেছি। কিন্তু তুর্নার কথা আলাদা। এই মেয়ের সাথে আমার ভাগ্য লেখা।

কাহিনীর শুরুটা জানতে হলে আরো এক মাস রিওয়াইন্ড করতে হয়। আমার বন্ধু কৌশিকের বাসা আমার পরের রোডে। বিকালবেলা ওর বাসার ছাদে বসে ওর অনভিজ্ঞ গিটারের তালে বেসুরো গলার গান শুনছিলাম। নতুন গিটার শিখছে কৌশিক। কেউ যখন প্রথম প্রথম গিটার শিখে, তার একজন ভিকটিম থাকে যাকে সে তার এই শিল্পকর্ম শোনায়। কৌশিকের একমাত্র ভিকটিম আমি। অদ্ভুত গিটারের সুরের ঝনঝনানি আর বেসুরো গলার কম্বিনেশানে মেজাজ যখন তুঙ্গে, তখনই পাশের ছাদে তাকিয়ে দেখি একটা পরী দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ থেকে পড়ল নাকি পাতাল ফুঁড়ে উঠল ঠিক ঠাউরে উঠতে পারলাম না। কৌশিককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম কলোনীতে ওরা নতুন এসেছে।কৌশিকের গার্লফ্রেন্ড আছে…সে এই মেয়ের দিকে নজর দিবে না। অতএব, এই পরীটা আমার। কৌশিককে এই মেয়ের সকল তথ্য কালেকশানে নিয়োজিত করলাম। সে দায়িত্ব নিল এক শর্তে। প্রতিদিন তার গিটার বাজানো শুনতে হবে। বড় কিছু পেতে হলে ছোটখাট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমি মেনে নিলাম। সাথে বোনাস হিসাবে প্রতিদিন পরীটাকে দেখার সুযোগও মিলল।

এরপর সবকিছু স্বাচ্ছন্দে চলতে লাগল।মেয়েটার সেল নাম্বার জোগাড় হল। কল দিলাম। প্রথমে ঝাড়ি, তারপর আস্তে আস্তে কথা বলা, একসময় সেটা রেগুলার হয়ে যাওয়া। যা হয় আরকি! কাহিনীর মোড় ঘুরে গেল সেদিন, যেদিন আমার মাথায় পাগলামিটা চেপে বসল। দিনটা ছিল ১লা ডিসেম্বর। হঠাৎ করেই রাত নয়টায় মনে হল আমার এই মেয়েটাকে প্রেম নিবেদন করতে হবে। এরকম খুচরা প্রেম নিবেদন করার ইচ্ছা আমার পূর্বেও অনেকবার জেগেছে। কোনবারই পারিনি। কিন্তু এবারের কথা আলাদা। আগেই বলেছি এই মেয়ের সাথে আমার ভাগ্য লেখা।
যেই ভাবা সেই কাজ। মাকে বললাম রাতে কৌশিকের বাসায় থাকব। বলে বেরিয়ে পড়লাম। কৌশিকের বাসায় বাসায় গিয়ে ওকে সব প্ল্যান বললাম। কৌশিক সেদিন বেঁকে বসলে আমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। আমাকে অবাক করে দিয়ে কৌশিক কোন রকম অবজেকশান ছাড়াই রাজি হয়ে গেল। আমি ১০০ টা মোমবাতি কিনে আনলাম। রাত বারোটায় ডিসেম্বরের কনকনে শীতের মধ্যে তুর্নার বাসার সামনে রাস্তায় সেই মোমবাতিগুলো স্থাপন করলাম। তারপর একে একে সবগুলো জ্বালালাম।

তুর্নাকে যখন ফোন দিলাম তখন রাত দেড়টা বাজে। কল দিয়েই ঝাড়ি খেলাম। অনেক্ষন কাকুতি মিনতি করার পর সে তার বারান্দায় এলো।রাস্তার ওপর ১০০ টা মোমবাতি দিয়ে লেখা “I LOVE U.” Love সাইনটার মধ্যে (A+T) লিখে দিয়েছি।
এরকম মরিয়া প্রোপোজাল পেয়ে পরীটার কি হাল হয়েছিল তা বলার অ্পেক্ষা রাখেনা। আমি পৃথিবীর বিরলতম পুরুষদের একজন যে প্রেম নিবেদনের সাথে সাথেই “হ্যাঁ” উত্তর পেয়েছে।পরের দু’দিন ছিল আমার জন্য পরম সুখের। আমি যতবারই ফোন দিয়েছি, ততবারই ও কেঁদে ফেলেছে। মেয়েটার চোখ থেকে একেক ফোটা জল ঝরে পড়েছে, আমার ভালোবাসা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে পৃথিবীর বেশিরভাগ সুন্দর নারী এবং নর জন্মগতভাবে কিঞ্চিত অহংকার সাথে নিয়ে মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে ল্যান্ড করে। তুর্না নামের মেয়েটা ল্যান্ড করার সময় ভুল করে তার অহংকার মায়ের গর্ভেই রেখে চলে এসেছে। গুনগত মানের দিক দিয়ে আমি যে ধরনের ছেলে, এ ধরনের ছেলে কে ধুর্ত মেয়েরা টিস্যুপেপারের মত ব্যাবহার করে। ব্যাবহার করা শেষ হয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে। তুর্না এসব প্রতিভা নিয়ে জন্মায়নি। সে আমাকে পাগলের মত ভালোবেসেছে। এত ভালোবাসা…এত্ত ভালোবাসার উৎপত্তি কোথায় আমি ভেবে কুল পাই না।



আমাদের একসাথে কাটানো প্রথম ভ্যালেন্টাইন ডে। শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে রাজকন্যার সাথে দেখা করতে পেরেছি। লোকালয় থেকে বেশ দূরে একটা লেকের পাড়ে বসে আছি দুজন।রাজকন্যা বেশ রাগান্বিত আমার উপর।আসার পর কোন কথা বলেনি।

-কিছু বলো।
রাজকন্যা চুপ।
-দেখ এত কষ্ট করে এত ঝামেলা কাটিয়ে তোমার সাথে আসলাম।এখন তুমি কথা বলছ না।
রাজকন্যা এবার মুখ খুলল।
-এক কাজ কর, তুমি তাহলে চলে যাও। আমি এখানে বসে থাকব।
-রাগ করছ কেন? তুমি জানো কত কষ্ট করে আম্মুকে ট্যাকেল দিয়ে এসেছি?
-আসছে বীরপুরুষ আমার ! আমি মেয়ে হয়ে ম্যানেজ করতে পারি, আর তুমি ছেলে হয়ে পারোনা? ছাগল কোথাকার !
আমি চুপ করে থাকি।
রাজকন্যা এবার ফুঁসে উঠে।
-আসল কথা বলতেছ না কেন? ঘুম থেকে উঠছ কয়টায়?
আমি ভয়ে ভয়ে মিনমিন করে বললাম “বারোটায়”।
-আজব ব্যাপার ! আজ আমাদের প্রথম ভ্যালেন্টাইন ডে।সকালে তোমার আমাকে নিয়ে বের হবার কথা। আমি ফোন দিতে দিতে শহীদ হয়ে যাইতেছি। আর তুমি ঘুমাইতেছ।
আমি মাথা নীচু করে থাকি।
-এত দেরী করে উঠছ কেন?রাত্রে কি করো? মানুষের বাড়িতে চুরি করো নাকি?
অবস্থা বেগতিক। আমি বললাম “ফ্রেন্ডদের সাথে মুভি দেখেছি”।
-গ্রেট ! তোমাদের একসাথে মুভি দেখা মানে তো আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠা। কি মুভি দেখছ? ঐ রোড ট্রিপ, ইউরো ট্রিপ, আমেরিকান পাই ঐগুলাই তো?
-আরে না। গতকাল দুইটা রোমান্টিক মুভি দেখছি।
-কি মুভি?
-মাই স্যাশি গার্ল আর এ ওয়াক টু রিমেমবার।
-ফ্রেন্ডদের সাথে দেখছে রোমান্টিক মুভি। তোমাকে ছাগল বলে সম্মান দেওয়া হয়ে গেছে। তুমি একটা বিশালকায় গরু। তুমি এখানে আসছ কেন? গোয়ালে গিয়ে খড় চিবাও যাও।
-গরুর রাখাল যে এইখানে। তাই গরুও এইখানে। রাখাল এবং গরু…একটা আত্মিক সম্পর্ক।
-চুপ থাকো ! আর তোমার ব্ল্যাক কালার বাদে অন্য কোন ড্রেস নাই? মানলাম ব্ল্যাক পছন্দের, তাই বলে সবকিছু ব্ল্যাক পরতে হবে? সবসময় একটা শোকদিবস শোকদিবস ভাব। আজকের দিনে কালো না পরলে চলতো না? দেখে মনে হইতেছে কেনিয়ার জাতীয় পোষাক পরছে।

ঝাড়ি খেতে খেতে হঠাৎ অনুভব করি কচ্ছপ জাতটা বেশ লাকি। অস্বস্তিকর পরিবেশে খোলসের ভিতর ঢুকে যেতে পারে। আমার সে উপায় নেই। আমি বিশালকায় গরু। বসে বসে ঝাড়ি হজম করতে থাকি। পরে গিয়ে জাবর কাটব। রাজকন্যা আঙ্গুল উঁচিয়ে ভাষন দেওয়ার ভঙ্গিতে ঝাড়ি দিয়েই যাচ্ছে। রাগে ওর মুখের উজ্জ্বল গৌরবর্নের চামড়া ঈষৎ লালচে রঙ ধারন করেছে। আমি খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম “জানো, তোমাকে স্ট্রবেরির মত লাগছে”।

রাজকন্যা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কঠিন রাগ আর ঈষৎ লজ্জার সংমিশ্রনে গালটা এবার পুরাই লাল হয়ে গেল।মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বসে থাকে সে।


একটা ব্যাপার বলা দরকার।এই মেয়ের রাগ সুনামির মত আসে, আবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শান্ত হয়ে যায়। এই মেয়ে জীবনের একটি দিনও রাগ করে আমার সাথে কথা বন্ধ করেনি।

সেদিন অনেক কথা বলে ও রাগ ভাঙ্গার পর।আমার বাহু ধরে, কাঁধে মাথা রেখে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে।আমাদের বাসাটা কি রঙের হবে, বাসার ডিজাইনটা কি রকম হবে, আমাদের রুমটা হবে আকাশী নীল রঙের যাতে ঘুমানোর সময় মনে হয় এক টুকরো আকাশ আমাদের মাথার উপর আছে। রুমের সাথে বিশাল একটা দক্ষিনমুখী বারান্দা থাকবে। সেখানে সে আমার সাথে “টাইটানিক” স্টাইলে দাঁড়িয়ে থাকবে। ছেলে হোক, মেয়ে হোক; আমাদের একটাই বেবি থাকবে। তার রুমটা হবে পিঙ্ক কালারের। কত্ত কত্ত প্ল্যান। এসব প্ল্যানের কোনটাই আমাকে বিশেষ আকর্ষন করেনা। কিন্তু এগুলো বলার সময় ওর নীলচে চোখে ছোট্ট কিশোরীর মত যে হাজারো রঙের স্বপ্ন খেলা করে, সেগুলোকে আমি খুব ভালোবাসি।




আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমাদের জীবন ছিল নিঁখুত। কিন্তু কারো জীবনই নিঁখুত হয় না।ভালোবাসার উ্লটো পিঠটাও তাই জেনে নিন।

আমরা দুই ভাই বোন। বড় আপু আমার থেকে চার বছরের বড়। আমার বাবা প্রচন্ড রাগী মানুষ। বড় আপুর একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। তিনি সে সম্পর্ক মেনে নেননি। আপু ছেলেটার সাথে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। বাবা আপুকে আমার থেকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। ইস্পাতের মত কঠিন মানুষটা আপুর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাচ্চার মত কান্নাকাটি করে আপুকে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেন।আপু ফিরে আসেনি। সে তখন তার নতুন পরিবারের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে ব্যাস্ত।

এ সমস্ত টেনশানে বাবা স্ট্রোক করেন। অনেক সেভেয়ার, বারো ঘন্টার মাথায় বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান।পড়ে রই আমি আর আম্মু।আমি তখন কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছি।বাবার মৃত্যুর পর আমাদেরকে বেশ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়। আম্মু প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। তার আয়ে আমার পড়ালেখা এবং পরিবারের অন্য দিক চলে। জীবনের ঐ পাঁচটা বছর আমি আর আম্মু দু’জনে অনেক কষ্টে দিনানিপাত করেছি।
আব্বুর মৃত্যুর পর আম্মুও কেমন যেন হয়ে গেলেন। সংসারের বাবার দায়িত্ব পালন করে আমাকে দেওয়ার মত সময় আর পেতেন না। আমাদের দেখা হত শুধুমাত্র খাবার সময়। মায়ের সাথে আস্তে আস্তে আমার দূরত্ব বেড়ে গেল। আমিও ছাড়া পেয়ে মুক্ত পাখির মত উড়তে শুরু করলাম। কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সারাদিন বাইরে থাকি। রাত্রে বাসায় ফিরি। যে আমি সারাজীবন স্মোকারদেরকে ঘৃণা করে এসেছি, সে আমি চেইন স্মোকার হয়ে যাই।সাহসটা একসময় এত বেড়ে গেল যে বাসায় সিগারেট খেতে শুরু করলাম রুমের দরজা বন্ধ করে।আমার জীবনটা অন্যপথে চলে যাচ্ছিল।


একদিন রাতে বাসায় ফিরেছি। আমার ফোনের চার্জারটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আম্মুর রুমে খুঁজতে গিয়ে দেখি আম্মু হাতে একটা এলবাম নিয়ে বসে আছেন। এগিয়ে গিয়ে দেখি আম্মুর চোখ ফোলা। আম্মুর পাশে বসলাম। আম্মু পাথরের মত স্থির হয়ে আছেন।
-আম্মু কি হয়েছে?
আম্মু স্থির বসে রইলেন।
-আম্মু বলো কি হয়েছে? চলো খেতে দাও, ক্ষুধা পেয়েছে।
আম্মু আমার দিকে ফিরলেন। তার চোখে ভয়ংকর শূন্যতা। আমি আম্মুকে ভয়ে ভয়ে বললাম, “আম্মু কি হয়েছে বলবা তো”।
আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠালেন। “অনন্ত, সোনা মানিক, তুইও আমাকে সবার মত ছেড়ে যাসনা”।আমি ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম আজ আপুর জন্মদিন। আম্মু এলবামে ফ্যামিলি পিকচার গুলো দেখছিলেন। আমি আম্মুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি, জানিনা কি বলতে হবে।

আম্মুর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। আমাকে আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একই কথা বারবার বলতে লাগলেন, “অনন্ত, সোনামানিক আমার, তুইও আমাকে ছেড়ে যাস না”।
-যাবোনা আম্মু। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? কখনো কোত্থাও যাব না।
আম্মুর কান্নার বেগ বাড়তেই লাগল। যতক্ষন পর্যন্ত না শান্ত হলো আমি তাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম।

সেদিন অনেকদিন পর আম্মু আমাকে আবার নিজ হাতে খাইয়ে দিল। রাতে আমাকে ছোটবেলার মত কোলের মধ্যে আঁকড়ে ধরে ঘুমালো। একদম কোলের ভিতরে আগলে রাখল। যেন একটু ছাড়লেই তার ছেলে হারিয়ে যাবে।

সেদিন আমি আমার আম্মুর কোলের ভিতর শুয়েই জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নেই।আমার জীবনে ঐ রাতটা না আসলে হয়তোবা নষ্ট হয়ে যেতাম। জীবন অন্যরকম হতো।


পরদিন সকালে তুর্নাকে ফোন দিয়ে পার্কে আসতে বললাম।গিয়ে দেখি ও আমার আগেই উপস্থিত।ওর হাতে কি যেন একটা কাগজ। ওর পাশে গিয়ে বসলাম। তুর্না গোসল করে এসেছে। ওর উজ্জ্বল ত্বক, ভেজা ভেজা চুল আমার কাজটাকে আরো কঠিন করে দিচ্ছে। ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। কিন্তু আমি যে কাজ করতে এসেছি সেটা আমাকে সম্পন্ন করতেই হবে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম…
-তুর্না তোমার সাথে ইম্পর্টান্ট কিছু কথা বলতে তোমাকে আজ ডেকেছি।
-কি কথা বাবু? এত সিরিয়াস কেন?
-আমাকে তুমি আর বাবু ডাকবা না।
-কেন বাবু? আমার বাবুকে আমি বাবু ডাকব না কেন? বাবু! বাবু! বাবু!
-তুর্না তোমাকে বাবু বলতে নিষেধ করেছি। আমি যেটা বলছি মন দিয়ে শোনো। আমি তোমার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে পারবো না।
-তোমার জোকসের জ্ঞান খুব কম। তুমি অফ যাও। তোমাকে না বলেছি উলটাপালটা জোকস মারবা না?
এরপর আমি ওর দিকে যে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালাম তাতেই ও বুঝে গেল আমি জোকস করছি না।
-দেখ তুর্না। তুমি জানো বড় আপুর কথা। বড় আপু মা-বাবা কারো কথা না ভেবে কিভাবে স্বার্থপরের মত বিয়ে করে ফেলেছিল। বাবার মৃত্যু আপুর কারনেই ঘটে। তোমার আমার বয়সের ব্যাবধান মাত্র তিন বছর। আর দু’বছর পর তোমার বিয়ের প্রপোজাল আসা শুরু করবে। আমি তখনো ছাত্র থাকব। তোমার বাবা-মা তোমাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে আমাদের পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
একটু বিরতি নিয়ে আবার বললাম- “তুর্না আমার আম্মু বড্ড একা। তিনি প্রথমে তার মেয়েকে হারিয়েছেন। তারপর তার জীবনসঙ্গীকে। জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে আমার আম্মু। আমি তাকে আর কোন কষ্ট দিতে পারব না”।
আরো অনেক কথা বললাম। মেয়েটা নির্বাক শুনে গেল আর চোখ দিয়ে অঝোরে বর্ষন করল। ওর প্রতিবাদ করার অনেক পয়েন্ট ছিল। কোন প্রতিবাদ করল না ও। ইচ্ছা হলো ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, “মেয়েরে, তোকে আমি পাগলের মত ভালোবাসি”।

পারলাম না। আম্মুর ছোটবেলায় হাত ধরে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, প্রতিবেলা নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া, পরীক্ষার আগে কোলের ভিতর নিয়ে আমাকে পড়ানো, ঈদের দিন আমাকে যত্ন করে গোসল করিয়ে দেওয়া, আমি সামান্য অসুস্থ হলেই পাগলের মত তার কান্নাকাটি, রাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে শুয়ে থাকা সব মনে পড়ে গেল। মায়ের ভালোবাসার কাছে আমার প্রেম ছোট পড়ে গেল।

আসার আগে তুর্না ওর হাতের কাগজটা আমাকে ধরিয়ে দিল শুধু। বাসায় ফিরে খুলে দেখি ও একটা ছবি এঁকেছে। দুইটা মাছ, একটা ছেলে-একটা মেয়ে, একজন অপরজনকে চুম্বন করছে।





সাত বছর পর।
সকালে ঘুম ভেঙ্গেই দেখি একটা নারীমুখ আমার মুখের সামনে ঝুঁকে আছে। তুর্না। চোখ খুলতেই বলল “HAPPY ANNIVERSERY”।
মনে পড়ে গেল আমার। পহেলা ডিসেম্বর আজ। আজ থেকে দুই বছর আগে মহিয়সী এই নারীর সাথে আমি আমার জীবনটাকে একসূত্রে গেঁথেছি।
ব্রেকআপের পর ৫ বছর পাগলী এই মেয়েটা তার পরিবারের কাছে আসা বিয়ের প্রস্তাব একের পর এক নাকচ করে দিয়েছে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, জিডি পাইলটদের মত প্রোপোজালও পাগলীর কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আর এই পাঁচ বছরে আমি আমার জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছি। আমার আশার থেকেও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। না হয়ে কোথায় যাব? সাথে আম্মু ছিল যে। এই ভদ্রমহিলা একবার আমাকে নিয়ে কোন মিশনে হাত দিলে আমি সেখান থেকে ব্যার্থ হয়ে ফিরিনি। তুর্নার বাসায় প্রোপোজাল পাঠিয়েছিলাম তারপর। এই মেয়েকে ধরে রাখার সাধ্য তার বাবা-মায়ের ছিল না।

আট মাস আগে আমার স্ট্রবেরি একটা জুনিয়র স্ট্রবেরি জন্ম দিয়েছে। আমাদের ছোট্ট ফুটফুটে কন্যা সন্তান। আমি অবশ্য এই পাগলীর চাহিদা বিশেষ পূরন করতে পারিনি। বিশাল একটা বাড়ি হয়ত করে দিতে পারিনি। তবুও ছোট্ট দোতলা একটা বাসা করেছি। আমাদের রুমটা আকাশী নীল রঙের। ঘুমানোর সময় আমাদের মাথার উপর ছোট্ট একটুকরো আকাশ থাকে। রুমের সাথে দক্ষিনমুখী একটা বারান্দা আছে। জুনিয়র স্ট্রবেরি যখন তার নানুমনির সাথে তার পিংক রুমে “বাংলা ভাষা শিক্ষা”য় ব্যস্ত থাকে, আমার সিনিয়র স্ট্রবেরি তখন খোলা বারান্দায় “টাইটানিক” স্টাইলে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর দুহাত থাকে দুদিকে প্রসারিত, আমি ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখি। দখিনা বাতাস ওর খোলা চুলগুলোকে উড়িয়ে বারবার আমার মুখের ওপর এনে আছড়ে ফেলে।মাঝে মাঝে যখন ও আমাদের বাবুকে কোলের ভিতরে নিয়ে ঘুমায়…আমি ওদের নিষ্পাপ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, আর ভাবি। পাগলী এই মেয়েটার এত ভালোবাসার যোগ্য হয়ত আমি নই। কিন্তু আগেই যে বলেছি…এই মেয়ের সাথে আমার ভাগ্য লেখা আছে।

**এই গল্পের কাহিনীতে আমার দুঃসম্পর্কের এক আন্টির কিছুটা এবং আমার এক বন্ধুর জীবন কাহিনীর কিছুটা ছোঁয়া আছে।এই দুজনের জীবন কাহিনী আমাকে মা-বাবা’র ভালোবাসাকে নতুন করে সম্মান করতে শিখিয়েছে**

-নাজমুস সাকিব অনিক

No comments:

Post a Comment