Subscribe:

সুখের মত ব্যথা

আমাদের পাশের  বাসায় দীর্ঘদিন ধরে থাকেন  আফতাব সাহেব।ঘোরতর নাস্তিক  মানুষ।প্রকৃতিও কঠোর।সব  কিছুতেই  একরাশ বিরক্তি  টেনে আনেন।যেমন, একদিন রাজনীতি  নিয়ে কথা বলছিলাম।আফতাব  সাহেব উঠে বললেন, দূর! এই দেশের সব রাজনৈতিক ব্যাটাকে ঘাস খাওয়ানো দরকার।নেপিয়ার জাতের উন্নতমানের ঘাস।তাইলে যদি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হয়।


দেশের উন্নতি নিয়ে কথা বললে বলে উঠেন দেশটা বেলতলায় গেল! রসাতলের  চেয়ে তার আবার বেলতলা বেশী পছন্দ।এখানেও তার বৈজ্ঞানিক  যুক্তি আছে।রসাতলে ন্যাড়া গেলে বিপদের সম্ভাবনা নাই,কিন্তু বেলতলায় গেলে কিছু বলা যায় না।বেলতলা মাথাভর্তি চুলওয়ালা দের জন্য ও নিরাপদ নয়।কারন মধ্যাকর্ষনের টানে বেল যখন পড়বে তখন নিচের মাথা টা ন্যাড়া মাথা ঝাকড়া চুলের বাবরি দূলানো দেখে পড়বে না।এটা তার বৈজ্ঞানিক যুক্তি।এজন্য নিরীহ দেশটাকে তিনি কথায় কথায় বেলতলায় টেনে নিয়ে যান। 


এরকম প্রায়  সবক্ষেত্রেই তার বিরক্তি।প্রেম  ভালবাসার একশ হাত,দুইশ হাত  বা তিনশ হাতের মধ্য দিয়ে ও  তিনি যান না।বরং এসব নিয়ে কথা শুনলেই রেগে যান।কয়েকবার আমি বলার চেষ্টা করেছিলাম।ফল শুভ হয় নি। 


সেই আফতাব  সাহেবই পুজিবাজারে ব্যাপক দরপতনের পর আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,বুঝলা মিয়া,এইবার একটা প্রেম করে ফেলব।মেয়ে দেখ। 

আফতাব সাহেবের  এই পরিবর্তন দেখে খটকা লাগল।জিজ্ঞেস করলাম পরিবর্তনের হেতু কি? 


তিনি যা জবাব দিলেন তা এরকম।পুজিবাজারে  তার বিরাট  অংকের অর্থ পুজি লাগানো আছে।কিন্তু বর্তমানে বিরাট ধ্বসে তা অর্ধেকে রূপ নিয়েছে।এখন পুরা দুনিয়াটা তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। 


মনে মনে আনন্দিত  হলাম।পুজিবাজারের এই ধ্বস যে আফতাব সাহেবের মত কঠোর মনের মানুষের মনে প্রেমের  ভাব জাগাতে পেরেছে এজন্য  তাকে ধন্যবাদ দিতেই হল। 


মেয়ে দেখা শুরু হল বিশাল আয়োজন করে।প্রতিদিন আমরা মহিলা কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় হাবিজাবি জায়গায় চক্কর দিতে লাগলাম।কিন্তু কোথাও কেউ নেই! যেন হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস! এটা আমার চোখে না।আফতাব সাহেবের চোখে।তার চোখে কাউকেই পছন্দ হয় না। 

আমি যখন কাউকে  দেখিয়ে বলি, আফতাব সাহেব,বিসমিল্লাহ বলে শুরু করি,কি বলেন? 

তিনি মুখ  গম্ভীর করে (সাহিত্যিকদের মতে পেচাঁর মত) বলেন, নাহ! মনে ধরে নি। 

এভাবে আমার বিরক্তি ধরে যায়।বিরক্ত হয়ে বলি, ভাই বলেন তো আপনার  মনের ফ্রিকোয়েন্সি কত ? কোনটাই তো ধরে না। 

তিনি তখন  বলেন,আমার ফ্রিকোয়্যান্সি একটু ছোট তো! 


এরকম কিছুদিন  পর আমি মোটামোটি হাল ছেড়ে বসে আছি।বুঝতে পরছি আফতাব সাহেবের প্রেম আর ইহজনমে হচ্ছে না। এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি নিজেই মেয়ে পছন্দ করে বসলেন।বাসায় এসে বললেন, মিয়া তোমার উপর ভরশা করাই ঠিক হয় নাই।দেখলা ক্যামনে ম্যানেজ করলাম? 
ম্যানেজ ও  করে ফেলেছেন নাকি ! আরো  বিস্মিত হতে হয়।

আফতাব সাহেব  আমতা আমতা করে বললেন, ওই একই কথা আর কি! হাফ ম্যানেজ, মানে দেখে পছন্দ হইছে এখন ফুল ম্যানেজের দায়িত্ব তোমার। 


জানতে পারলাম তিন বাসা পরে মেয়ের বাস।নতুন এসেছে দু কদিন হল।ছাদে হাটাহাটি করার সময় আফতাব সাহেব মেয়েটার দেখা পান। 


আমার উপর  গুরুদায়িত্ব।ম্যনেজ করার।একরকম ম্যানেজার।লেগে গেলাম পুরোদ্যমে।বাসার চারপাশে কয়েকদিন হাটাহাটি করলাম।দুইটা রুপবতী মেয়েকে দেখলাম।কিন্তু ওই দেখা ছাড়া আর কিছু করা গেল না।আফতাব সাহেব প্রতিদিন আপডেট নিউজ জানতে চান।বানিয়ে বানিয়ে কিছু শোনাতে হয়।এরকম করতে করতে ফেব্রুয়ারী মাস এসে গেল। 


ততদিনে আফতাব সাহেব ছাদে স্থায়ী নিবাস গেড়েছেন।তিনি বিশাল চেয়ার, অনেক বইপত্র,খবরের কাগজ ইত্যাদি নিয়ে ছাদেই বসে থাকেন সারাদিন।উনার পরিবারের লোকজন বলল,মাঝে মাঝে রাতেও নাকী চলে যান ছাদে! বিষয়টা মারাত্বক!এখন যদি হঠাৎ লাফ টাফ দিয়ে বসেন।প্রেমে পাগলা মানুষ কত কি করে! ছাদে বাস করেন, লাফ দিতে কতক্ষন!ইত্যাদি সাত পাচঁ এবং পাচঁ সাত ভেবে একটা বুদ্ধি বের করলাম।আফতাব সাহেবকে বুদ্ধিটা বলতেই তিনি খানিকক্ষন চুপ করে থেকে হো হো করে হেসে উঠলেন।অপ্রকৃতিস্থ হাসি! প্রেমে পাগলা মানুষের হাসি ও যে অপ্রকৃতিস্থ হয় ঐ হাসি দেখে প্রথম জানলাম।তিনি হাসি শেষে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন,জিনিস রেডি কর। 


ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ রাতে রাত জেগে আমি  জিনিস রেডি করলাম।জিনিস মানে পত্র।প্রেমপত্র।আফতাব সাহেবকে দিতেই তিনি পূর্বকথা অনুযায়ী পাচঁশত টাকা ধরিয়ে দিলেন। 


পরদিন সকালে তথা ভালবাসা দিবসের সকালে আমরা ঐ বাসার সামনে গেলাম।দাড়োয়ানকে ম্যানেজ করতে দুইশত টাকা চলে গেল।দাড়োয়ান পত্র নিয়ে ভেতরে গেল এবং কয়েক মিনিট পর বেরিয়ে এসে বলল, ম্যাডাম আপনাদের ভিতরে যেতে বলেছেন। 

ভাল কথা।আফতাব  সাহেব মনে হল আনন্দে লাফ  দিবেন।সাহিত্যিক ভাষায়  তার অবস্থা আনন্দে আটখানা।  আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন।আমার কেন জানি ভয় ভয় করছিল। 


ঘরে ঢুকতেই দাড়োয়ানের ম্যাডামকে দেখলাম।তার হাতেই চিঠিটা।আমাদের দেখে বসতে বললেন।তারপর জিজ্ঞেস করলেন আপনাদের মধ্যে কে.....................? 

আফতাব সাহেব  একটি হালকা কাশি  দিলেন।যার  মানে আমি ,আমি সেই বীরপুরূষ। 

ম্যাডাম এবার হাসিমুখে বললেন, চিঠি টা সুন্দর হয়েছে।আমার কোন মেয়েকে দিব  বলেন?দুজনই আজ বন্ধুদের সাথে বাইরে গেছে। 
আফতাব সাহেবের চোখ দেখলাম হঠাৎ বড় হয়ে গেল।সাহিত্যিক ভাষায় বিস্ফোরিত নেত্র। একটি শব্দ উচ্চারন করলেন তাও ভাঙ্গা ভাঙা গলায়। আপনি? বীরপুরুষের কন্ঠ এমন ভেঙ্গে গেল কেন বুঝতে পারি নি তখন।


ভদ্রমহিলা বললেন, আমি ওদের মা।আপনাকে  ছাদে দেখেছি।তারপর তিনি পুলিশের সিআইডি ব্রাঞ্চে না কিসে  আছেন বললেন ঠিক শুনতে পারি নি কারন তখন আফতাব সাহেব ঝেড়ে দৌড় দিয়েছেন।আমিও দৌড় দিব এমন সময় মহিলা আমার সামনে এসে দাড়ালেন।আবার বলতে লাগলেন, কষ্ট করে এনেছ যখন দিব।আমি প্রেমে বিশ্বাস করি।আর তোমার সৎ সাহস আমার ভাল লেগেছে।এখন বল কার জন্য?আমার বড়মেয়ে না ছোটমেয়ে কাকে তোমার ভাল লাগে? 

বিশাল ঝামেলায় পড়লাম।জীবন বাচাঁতে মিথ্যা বলা জায়েজ।তাই একজনের কথা বলে আমিও দৌড় দিলাম। 


ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে বন্ধুরা একটা পিকনিকের আয়োজন করেছিল।বুঝলাম  এখন আফতাব সাহেবের জন্য বাসায় থাকা নিরাপদ না।ব্যাগ নিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম। 


পিকনিকে এসে  প্রথমদিন ভালই কাটল।পরদিন মানে আজ মোবাইল অন করেই শোনলাম ব্রেকিং নিউজ।আফতাব সাহেব জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন।তিনি ছাদের সমস্ত কাগজ, বই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একাকার করে ফেলেছেন।আমার কথা বলে সিংহের মত গর্জন করছেন।তার ধারনা আমি সব জেনে শুনেই তার সাথে মজা করেছি।বিরাট দুশ্চিন্তায় আছি।এমন সময় মোবাইলে মেসেজটা আসল। 



  “মায়ের সাথে সাহস দেখাতে পেরেছেন বলে মা আপনার পক্ষে আছেন।আমি ও বিবেচনায় রাখলাম :p :p” 

রিপ্লাই দিব  কি না চিন্তায় আছি।মেয়েটা দেখতে সুন্দরের স্ত্রীলিঙ্গ।মানে অতি রুপবতীদের একজন।যতই তার কথা ভাবছি ততই চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছি বুকে বা পাশটায়।একেই কি রবী বাবু বলেছিলেন সুখের মত ব্যাথা?

  
  
প্রশ্নটা এখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।




-মুরাদুল ইসলাম

No comments:

Post a Comment