Subscribe:

গন্তব্য...

স্বামীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি । হাতে একগোছা ফুল । তাঁর স্বামীর প্রিয় ফুল সেটা । গাদা ফুল । সালেহা মাহমুদ এখনো ভাবেন তাঁর স্বামী কেন গাঁদা ফুল পছন্দ করতেন । প্রতিবার একটা উত্তরই আসত – “এই যে ফুলটাকে দেখছ , এই ফুলের একটা পাপড়ি আমি, আরেকটা তুমি । আর বাকিগুলো আমাদের ছেলে মেয়ে । জানো , গাঁদা ফুল এমন একটা ফুল, যার একটা পাপড়ি ছিড়ে গেলে সুবগুলো পাপড়িই আলাদা হয়ে যায় । কিন্তু , আমাদের ভালোবাসা আমাদের কখনো আলাদা করবেনা । হা হা হা । ” অনেক হাসতেন মাহমুদ সাহেব । আর সালেহা তাঁর স্বামীর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতেন ।

          এখনো মুগ্ধ হয়ে দেখছেন সালেহা । দেখছেন তাঁর কবরটা । অনেক ভালোবাসায় ঘেরা ছোট্ট জায়গাটা । সবাইকে ছেড়ে এমনভাবে চলে যাবেন , সেটা কখনো ভাবতেও পারেননি সালেহা । সেদিনও সপ্নে দেখলেন মাহমুদ সাহেবকে । একই ভঙ্গিতে হাসছেন । আর বলছেন “কি হল ? আর কতদিন থাকবে আমাকে ছেড়ে ? আমি অপেক্ষায় আছি । ” মাঝে মাঝেই স্বপ্নটা দেখেন সালেহা । খুব মন খারাপ হয়  । তখনি স্বামীকে দেখতে আসেন ; সাথে একগোছা গাদা ফুল । ফেরার সময় বলে যান “ওগো , আমি আরেকটু থাকতে চাই তোমার ছেলের সাথে । পাগলটা এখনো ছোটই আছে । তারপর ঠিকই চলে আসব । এইতো আর কিছুদিন । ” আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি ।


গাড়িতে উঠে বসলেন সালেহা । ড্রাইভারকে আর বলতে হলনা কোথায় যেতে হবে । সোজা এসে একটা ধবধবে সাদা দালানের সামনে থামল গাড়ী । নেমে পা বাড়ালেন সালেহা । দারোয়ান সোলায়মান লম্বা করে একটা সালাম দিল । সালামের উত্তরের সাথে একটা হাসি দিলেন সালেহা । তারপর সোজা চলে গেলেন ভেতরে ।  এখানে আসলেই সালেহার মন ভালো হয়ে যায় । কারন জায়গাটা মাহমুদ সাহেবের সপ্ন ছিল । সপ্নের নাম “মরহুম রিফাত মাহমুদ বৃদ্ধাশ্রম” । মাহমুদ সাহেবের অনেক সপ্ন ছিল একটা বৃদ্ধাশ্রম বানানোর । তিনি তার জীবদ্দশায় সেটা পুরণ না হলেও হয়েছে তার মৃত্যুর পর । সালেহার একটাই দুঃখ – স্বপ্ন পুরণের সময় স্বামীকে পাশে পাননি তিনি ।    


          ভেতরে ঢুকেই শান্তি লাগল সালেহার । কিছু অতি পরিচিত মুখ চোখে পড়ল আবার । সবার মুখে হাসি । মনখোলা হাসি । সালেহা মনে করেন এখানের মানুষগুলো যেভাবে হাসেন , সেভাবে আর কেউ হাসতে পারেনা । এত নিষ্পাপ হাসি দেয়াও ভাগ্যের ব্যাপার । সবাই পারেনা । কিন্তু তারা পারেন । কারণ তার সেই বাবা মা , যারা নিজের মন- প্রাণ দিয়ে সন্তানের জন্য খেটেছেন । সন্তানের ভালো দেখেছেন । কিন্তু যখন তারা বৃদ্ধ হয়েছেন , তখনই হয়েছেন অপমানিত আর অবহেলিত । পেয়েছেন কষ্ট । সেটা কি তাদের প্রাপ্য ছিলো ? না । কখনোই নয় ।  এখনও সেই নিষ্পাপ প্রানগুলো স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসে তাদের সন্তানকে । আর বিনিময়ে পায়না কিছুই । তাদের নেই কোন চাওয়া-পাওয়া , শুধু আছে সন্তানের জন্য বুকভরা ভালোবাসা ।


          কাজ শেষ করে রাতে বাসায় ফিরলেন । বাসায় এসে ছেলে কাব্যর জন্য রান্না করলেন । সালেহা প্রতিদিন দু'বেলা রান্না করেন । সকালে আর রাতে । দুপুরে কাব্য বাসায় আসেনা । আর সালেহাও থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে । তাই আর রান্না করা হয়না । রাতে ছেলে এসে মায়ের সাথে খায় , গল্প করে , অফিসে কে কি করল সব বলে । সালেহা ছেলের কথা শোনেন আর ভাবেন – কাব্যর একটা বিয়ে দেয়া দরকার । এভাবেই দিনগুলো যাচ্ছিল । সপ্নের মত ।


          একদিন সকালে সালেহা কাব্যকে বললেন বিয়ের কথা । শুনে কাব্য কিছু না বলেই অফিসে গেল । সালেহা ভাবলেন ছেলে লজ্জা পেল কিনা । কিন্তু না । রাতে এসেই কাব্য মাকে বলল – সে একটা মেয়েকে পছন্দ করে । শুনে হাসলেন সালেহা । ভাবলেন – ছেলে আসলেই বড় হয়েছে  । তারপর দিন মেয়ের বাসায় গিয়ে কথা বললেন তিনি । মেয়েকে দেখে পছন্দ হল তার । ছেলের ওপর আস্থা রেখে আর কিছু জানতে চাইলেননা তিনি । সব কিছু ঠিক-ঠাক হল । দেখতে দেখতে ধুমধাম করে বিয়েটাও হয়ে গেল । বিয়ের সময় সালেহার মনে হচ্ছিল তার কলজেটা কে যেন ছিড়ে খাচ্ছে । একমাত্র সন্তান এখন হয়ে যাচ্ছে কারো সাথী । আরেকজনের সহযাত্রী । ছেলে কি তার পর হয়ে যাচ্ছে ? নাহ , এ হতে পারেনা । কাব্য সবসময়ই তার চোখের তারা ছিল , এবং থাকবে । সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত পেরিয়ে ভোর হল , টের পেলেননা । সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল ছেলের কথা । আবার মনে হল সে তো এখন তার স্ত্রীর সাথে , মায়ের কথা কি তার মনে আছে ? সে কি আগের মতই ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই মাকে দেখতে আসবে ? মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুম থেকে উঠোবে ? বলবে “মা , ক্ষিধে লেগেছে " ?


          ঘুম থেকে উঠেই ছেলের ঘরের দিকে গেলেন । দরজার সামনে এসে দেখলেন ঘর খালি । “কাব্য.........” আস্তে ডাকলেন সালেহা । ডাকটা পুরো ঘরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল। আবার ডাকলেন। কেউ সাড়া দিলোনা । কাজের বুয়াকে ডাকলেন। বুয়া বলল “আম্মা , তেনারা তো খাইয়া বাইর হইয়া গেসেন গা । আফনে ঘুমাইতাসিলেন বইলা ডাকেনাই ।  ফিরিজে খাওন আছে । ভাইজানে কইসেন আফনারে খাইয়া লইতে ।” কথাটায় একটু ধাক্কা খেলেন সালেহা । সেটা বুয়াকে বুঝতে দিলেন না । চশমাটা চোখে লাগিয়ে বাইরে আসলেন । দারোয়ান সালেহাকে বলল “আম্মা , আইজকা যাইবেন না ?” সালেহা আস্তে করে বললেন “না ।” শরীরটা ভাল লাগছেনা আজ । অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে । একা মনে হচ্ছে । আয়নার সামনে এসে দাড়ালেন সালেহা । হঠাৎ হেসে উঠলেন । নিজেকে বললেন “কি সব আজে বাজে ভাবছি আমি ? আমার ছেলে তো আমারই আছে । আমার ছেলে এখনও আমাকে অনেক ভালোবাসে । অনেক।” ভাবতে ভাবতে মনে হল আয়নাটা তাকে দেখে ভেংচি কাটছে আর বলছে “সালেহা , তুমি আজ একা , বড় একা ।”


          পরের কটা দিন বিভীষিকার মাঝে কাটল সালেহার । দুদিনেই সালেহা বুঝে ফেললেন বউমাকে যা ভেবেছিলেন সে তা নয় । বড়লোকের মেয়ে হবার দরুণ সে ঘরের কোন কাজ পারেনা , যদিও তার বাবা মা বলেছিলেন মেয়ে রান্না-বান্না টুকিটাকি পারে । কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এসে চা বানানো পর্যন্ত শিখতে হয়েছে তাকে । আর রান্না-বান্না ? সেটা তো দূরের কথা । যাই হোক ; হাজার হলেও ছেলের বউ , তাই সালেহা নীরবে মেনে নিলেন । কিন্তু তিনি কষ্ট পেতে বাধ্য হলেন যখন বিয়ের দু'দিনের মাথায় তাকে শুনতে হল “মা দেখুন , আমি এসব ঘরের কাজ-বাজ পারিনা । আমার বাসায় কাজের বুয়ারাই সব করেছে । তাই আমি এগুলো নিজের হাতে করা পছন্দ করিনা । আমার সময়ই বা কোথায় ? আপনি তো বুড়ো মানুষ , কাজ-কারবার নেই ; আপনি না হয় এগুলো সামলে নেবেন ।” কথাগুলো বলে গটগট করে হেটে চলে গেল বউমা । আর সালেহা ? হজম করতে না পেরে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন । কাজের বুয়া সালেহার দিকে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল মুছে কৃত্তিম হাসি ফুটিয়ে বলল “আম্মাজান , বউমা তো ঠিকই কইসে । তেনার এহন এইসব কামের মইধ্যে আইবার মন চায় না । আফনে চিন্তা কইরেন না । আমি সব কইরা লমুনে । আফনে রূমে গিয়া রেস্ট করেন । যান ।” বলে সালেহাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসে বুয়া । সালেহা বোবার মত পড়ে থাকেন । কিচ্ছু মাথায় আসেনা তার । সব গুলিয়ে যায় । আর পাশে বসে বুয়া খোদাকে ডাকে ।


          এরপরদিন সালেহা চুপ হয়ে যান । কাব্য রাতে ঘরে ফেরে বউকে নিয়ে , ঢুকে মাকে খোঁজে । সালেহা ছেলের পায়ের শব্দ শুনে চোখের পানি মুছে হাসিমুখে বসে থাকেন । কাব্য মাকে দেখে বলে “কেমন আছ মা ?” সালেহা অনেক কষ্টে মিথ্যে বলে যান “ভাল আছি বাবা , অনেক ভালো ।” পরেরদিন কাব্য তার বউকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় যায় । সালেহা ছেলে আর বউমাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দিয়ে আসেন । দুজনকে আশীর্বাদ করে দেন মন ভরে । বাসায় এসে খুব একা একা লাগে সালেহার । সারাদিন পায়চারি করে বেড়ান । একবার ছেলের রুমে যান , একবার নিজের রুমে । ছেলের জামাকাপড় নেড়েচেড়ে দেখেন , গন্ধ নেন । ভাবেন কখন তার বুকের ধন আবার ফিরে আসবে । ভাবতে ভাবতে স্বামীর ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ান তিনি । গত কদিন ধরে মাহমুদ সাহেব প্রতিদিন সপ্নে আসছেন । কিন্তু আগের মত হাসি নেই তার মুখে । খালি বলেন “আর কত ? অনেক তো হল । তুমি একা কেন এত কষ্ট পাবে ?” সালেহা স্বামীর ছবির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন । ফিসফিস করে বলেন “আমি অনেক ভালো আছি গো । দেখছনা তোমার ছেলে কত সুখে আছে । আর বউমাও তো লক্ষী একটা মেয়ে । ওদের খুব মানিয়েছে , তাইনা ?” মাহমুদ সাহেবের ছবি কোন উত্তর দেয়না । শুধু তাকিয়ে থাকে তার নিষ্পাপ স্ত্রীর দিকে । সালেহা বুঝতে পারেন তার স্বামীর কাছে কপট হাসি ধরা পড়ে যাচ্ছে । তাড়াতাড়ি সরে আসেন ।  


          এভাবে থাকতে আর ভাল লাগেনা সালেহার । তিনি আবার নিয়মিত কাজে মন দিলেন । কেটে গেল এক সপ্তাহ । কাব্য প্রতিদিন সকালে আর রাতে একবার করে মাকে ফোন করে , বলে আজ সে বউমাকে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছে , কি করেছে । এভাবে যেতে যেতে একদিন রাতে কাব্য মাকে ফোন দিয়ে বলল “মা , আমরা আশা করি কাল বা পরশুর মধ্যে চলে আসব । তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে ।” কথাটা শেষ না হতেই সালেহা শুনতে পান ওপাশে বউমা কাব্যকে ভেংচি কাটছে “হয়েছে , আর ভান ধরতে হবেনা । সারাজীবন তো মার কাছেই ছিলে । এখন হানিমুনে এসে আবার কি ? তাড়াতাড়ি এদিকে এসো , আমার নেকলেসটা পাচ্ছিনা । ” পাশ থেকে কাব্যর কন্ঠস্বর চুপসে যায় । আস্তে করে “মা আমি আসছি” বলে চলে যায় কাব্য । সালেহা কথাগুলো শুনেও ছেলের জন্য লাইনে অপেক্ষা করেন । একটু পর কাব্য এসে আবার মায়ের সাথে কথা বলতে থাকে । কখন যে সময় পার হয় , মা ছেলে কেউ বোঝেনা । হঠাৎ আবার বউমার ঘুমজড়ানো বিরক্ত কন্ঠ শোনা যায় “কি হল ? আর কত ? তোমাদের কথা কি আজীবনেও শেষ হবেনা ? এত কিসের কথা ? এসো , শুতে এসো ।” সালেহা কি বলবেন বুঝতে পারেননা ।  তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দেন তিনি । আবার মনে হতে থাকে কেউ যেন কলজেটা ছিড়ে নিচ্ছে । চুপ করে বিছানায় পরে থাকেন সালেহা । নিঃশ্বাস আটকে আসে তার ।


          দেশে ফিরে আবার কাব্য খেয়াল করতে থাকে তার মা আর আগের মতন নেই । কেমন জানি চুপসে গেছেন । কাব্য মাকে অনেকভাবে বলানোর চেষ্টা করল । কিন্তু সালেহা কিছুই বললেন না । তার ছেলেকে কোন কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে তার নেই । ভালই তো আছে সে বউকে নিয়ে । তাই কাব্য আর বেশি একটা ঘাটালো না । এদিকে সালেহা নিজেকে গুটিয়ে নিলেন সংসার থেকে । শুধু নিজের প্রয়োজনীয় কাজটুকু করেন , বৃদ্ধাশ্রম দেখাশোনা করেন আর রাতে বাসায় ফেরেন । এভাবেই চলছিল । একদিন কাব্য গাড়ি নিয়ে অফিসে চলে যাবার পর সালেহা যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন , তখন বউমাও কোন কাজে বের হচ্ছে ।

-কোথাও যাবে বউমা ?

- হ্যাঁ মা , একটু শপিংয়ে যাব ।

-আমিও একটু বাইরে যাচ্ছি ।

-আপনি তো বৃদ্ধাশ্রম যাবেন , ওই পথেই যাব আমি । আপনাকে নামিয়ে দেব ।

গাড়িতে করে সালেহা বৃদ্ধাশ্রম পৌঁছান । কাজ শেষে যখন বাসায় ফিরবেন , তখন কাব্যকে ফোন দেন তিনি । কাব্য অফিসে ব্যস্ত । আসতে দেরি হবে । বউমাকে ফোন দিলেন ।

-তুমি কোথায় মা ? আমাকে একটু বাসায় যেতে হবে ।

-মা , আমি একটু ব্যস্ত আছি ।

-আচ্ছা মা , তুমি কাজ শেষ করে আমাকে নিয়ে যেও । আমি অপেক্ষা করছি ।

-মা , আমি স্যরি , এখন আপনাকে নিতে আমার দেরি হবে । আপনি পারলে একটা সিএনজি নিয়ে চলে যান ।

সালেহা হেসে বলেন “আচ্ছা” । বাসায় দুটো গাড়ি । আর আগে কখনো সালেহাকে সিএনজিতে যেতে হয়নি । তবু তিনি ভাবলেন বউমার হয়ত অনেক কাজ । কিছু না মনে করে বাসায় ফিরলেন । বাসায় ফিরে রাতে কাব্যকে ডাকতে গেলেন । তখনি রুমের বাইরে থেকে শুনলেন-

-আচ্ছা , মা আর কতদিন আমাদের সাথে থাকবে ?

-আর কতদিন মানে ?

-মানে আমি বলছিলাম , আমাদের আলাদা বাসা নেয়া দরকার ।

-কেন ? মা থাকলে কি সমস্যা ?

-কি সমস্যা মানে ? তুমি বোঝনা ? পুরো ঘরটাই তো ভুতের বাড়ী হয়ে আছে । আমি একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠতে পারিনা , যখন তখন বের হতে গেলেও মা তাকিয়ে থাকেন , বন্ধুদের কেউ তো বাসায় আসতেই চায়না , হাই ভলিউমে গান শুনতে পারিনা...............


আর শুনতে ইচ্ছে করেনা সালেহার । চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে । নিজেকে বোঝা মনে হতে থাকে । নাহ , কাব্য এভাবে দেখে ফেললে মন খারাপ হবে । সালেহা দ্রুত উলটো ঘোরেন , নিজের রুমের দিকে । ঘুরেই দেখেন বুয়া । ছলছল চোখে সালেহার দিকে তাকিয়ে আছে । বুয়া এ বাসায় কাজ করে বিশ বছর । এ ঘরের সবই তার জানা । শেষ বয়সে এসে মায়ের দুঃখ দেখে আর ভাল লাগেনা তার । রুমে নিয়ে এসে সালেহাকে জড়িয়ে ধরে বুয়া “আম্মাজান , আফনে কাইন্দেন না । মাইয়া মানুষ কিচ্ছু বুঝে না । ছোড তো । আম্মাজান , আফনে এইহান থেইকা যান গা । হেরা নিজেগো মতন থাহুক । এইহানে আর থাইকেন না । আফনে মইরা যাইবেন আম্মা , আফনে মইরা যাইবেন ।” সালেহা কাঁদে , আর মাহমুদ সাহেবের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে । মাহমুদ সাহেবের ছবিটাকে অনেক দুঃখী মনে হয় ।


রাতে খাবার পর কাব্য বারান্দায় বসে । সালেহা আস্তে করে ছেলের পাশে এসে বসেন । কাব্য মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে ফেলে ।

-কি হয়েছে তোর বাবা ?

-না মা । কিচ্ছু হয়নি ।

-সত্যি করে বল ; তোর কি হয়েছে ?

-না মা , আমি ঠিক আছি । তুমি ?

-আমি তো ভালই আছি ।(মুখ লুকান সালেহা)

-মা.........

-তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা ।

সালেহা ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন । ছেলের কষ্ট বোঝেন তিনি ।

-কাব্য...

-কি মা ?

-তুই বউমাকে বিয়ের সময় কি বলেছিলি ?

-কি আর বলব , আমি তো ওকে আগে থেকেই চিনতাম । তেমন কিছু বলার প্রয়োজন মনে হয়নি । কেন মা ?

-না , এমনি । আচ্ছা বাবা , অনেক রাত হল । ঘুমিয়ে পড় , যা ।  

রাতে শোবার সময় সালেহার মনে পড়ে যখন মাহমুদ সাহেব তাকে দেখতে আসেন , তখন সব শেষে বলেছিলেন-

-আপনি আমাকে কতটুকু পছন্দ করেছেন সেটা জানতে চাইবনা । জানতে চাইব আমার বাবা-মা কে আপনার কেমন লেগেছে । বিয়ের পর আগে আমাকে নয় , আমার বাবা-মা কে খুশি রাখবেন । আমি এমনিতেই খুশি থাকব ।


কথাগুলো এখনো কানে বাজে সালেহার । মনে হয় এখনো মাহমুদ সাহেব কানের পাশে বলে যাচ্ছেন । কিন্তু এ দুনিয়ার ছেলে মেয়েরা বাবা-মা কে কিছু মনে করে কিনা ভাবতে অবাক লাগে সালেহার । ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন সালেহা । ঘুমের ভেতর আজ আবার মাহমুদ সাহেব আসেন , নতুন ভঙ্গিতে নতুন কিছু কথা বলেন ।


          কথাগুলো এখনো কানে বাজছে সালেহার । ভোর হয়েছে মাত্র । আজ অনেক আগে ঘুম ভেঙ্গেছে সালেহার । আস্তে আস্তে রেডি হলেন । ব্যাগে করে কটা কাপড় নিলেন । বুয়াও সকালে উঠে সালেহাকে ব্যাগ গুছাতে সাহায্য করল  । তারপর রুম থেকে বের হলেন । কাব্য তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে । কাউকে ডাকলেন না , শুধু বুয়ার হাতে কিছু টাকা আর একটা ছোট চিঠি দিয়ে বললেন কাব্যকে দিতে । বলে বুয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন । সালেহা জোরে কাঁদতেও পারলেন না । শব্দে কাব্য উঠে যেতে পারে , তাই । ছেলেকে এই মুখ দেখানো যাবেনা । তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হলেন । বের হয়ে হয়ে দেখলেন দারোয়ান , ড্রাইভার দাড়িয়ে আছে । তারা সবাই সালেহাকে এগিয়ে দিতে চায় । গাড়ি নিয়ে বের হয় ড্রাইভার । সাথে দারোয়ান , বুয়া আর সালেহা । সোজা মাহমুদ সাহেবের কবরস্থানে যায় সে । সালেহা গাড়ি থেকে বের হয়ে স্বামীর কবরের সামনে এসে দাঁড়ান ।



-কেমন আছো রিফাত ? তুমি গতরাতে এমনভাবে ডাকলে , না এসে পারলাম না । জানো , আমি একেবারে তোমার কাছে চলে এসেছি । সব ছেড়ে । আমি থাকলে আমার ছেলের শুধু শুধু কষ্ট হবে । আমি চাই ওরা সুখে থাকুক । আজ তোমার জন্য গাঁদা ফুল আনিনি । ইচ্ছে করেই আনিনি । কারন , আমার গাঁদা ফুলের গাছগুলো সব মরে গেছে । আর ফুলের পাপড়িফুলোও আলাদা হয়ে গেছে আজ । তাই । আমি আর পারলাম না । ত্রিশ বছর তোমার সংসার করেছি । আজ আমার ছেলের বউ হয়েছে । ওদের দিকে তাকিয়ে ত্রিশ দিনের জন্যও ঘরে থাকতে পারলাম না , তোমার কাছে এলাম । আমি রোজ তোমায় দেখতে আসব । ভালো থেকো রিফাত , আমি আবার আসব ।  


বলে উলটো হাটতে থাকেন সালেহা । এখন একটু হাল্কা লাগছে । গাড়ির কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন দারোয়ান , ড্রাইভার আর বুয়া সব ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আছে । দারোয়ান বলল “বুজি(বুয়া) আমাগোরে সব কইসে । আমরাও জানতাম আপনে একদিন চইলা যাইবেন । তাই সকাল সকাল ঘুম থেইকা উঠতাম । আম্মাজান , আমাগো দোয়া আছে আফনার লগে । ফি আমানিল্লাহ ।” সালেহার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ে । ঠেকাতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হন । এই মুখগুলোর দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকলে আর যাওয়া হবেনা তার ।


তাড়াতাড়ি চোখ মুছে হাঁটতে থাকেন । পেছন থেকে ড্রাইভার বলে ওঠে “আম্মা , যান কই ? গাড়ি তো এইদিকে ।” সালেহা মুখ ঘুরিয়ে বলেন “না রে , আজ আর গাড়িতে যাব না । হেঁটেই যাব । এইতো আর কিছুদুর ।” বলেই আবার হাঁটেন সালেহা । পা ভারী হয়ে আসতে থাকে । কেন জানি ওদের ছাড়তে খুব কষ্ট হচ্ছে । আবার পেছনে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলেন “তোরা আমাকে দেখতে আসবি তো ?” কথাটা শোনা মাত্রই জোরে ফোপাতে শরু করে তিনজন । সালেহা আবার হাটার গতি বাড়ান । তাদের কান্না অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে আসে । চোখ ঝাপসা হয়ে আসে সালেহার ।


 গন্তব্য......





 “মরহুম রিফাত মাহমুদ বৃদ্ধাশ্রম”


********************************************************************************

পৃথিবীর সকল মা-দেরকে উৎসর্গ করছি,যারা সন্তানকে ভালোবেসেছেন শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত ।


By : Blockhead Hasnat

No comments:

Post a Comment