Subscribe:

ব্রেক আপ...

মা। আমার মা। জন্মের সময়ই আমার সেই মা চলে গেলেন অন্য এক দুনিয়ায়, আমাকে ফেলে। আমার জীবনের প্রথম ব্রেক আপ- মায়ের সাথে। সেই থেকে শুরু।

মার মৃত্যুর পর চাচা-ফুপুদের জোরাজুরিতে আমার সরল-সোজা বাবাটা আবার বিয়ে করলেন। নতুন মা শুরুতে অনেক ভালো ছিলেন। আমাকে আদর করতেন খুব। কিন্তু যখন আমার নতুন মার কোলে একটা ছোট্ট বাবু আসল, তখন থেকেই বদলে গেল সবকিছু। বাবুটাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরলেন বাবা-মা দুজনই। ধীরে ধীরে বাবা পরিণত হলেন মায়ের হাতের পুতুলে। এবার হল নিজের বাবার সাথেই ব্রেক আপ।


পুতুল খেলার বয়সে, আমার ছোট বোনটার জন্য পুতুল, খেলনা কেনার অফুরন্ত টাকা থাকলেও, আমার বেলায় কেন যেন প্রবল অর্থকষ্ট দেখা দিত বাবার। হয়তবা আমার জন্য পুতুল কেনার ইচ্ছা থাকলেও মার মুখঝামটার সামনে তা বলার সাহস পেতেন না আমার বাবাটা। অতএব ফলাফল, পুতুল, রং-বেরং-এর খেলনার সাথেও ব্রেক আপ।

বিড়াল অনেক পছন্দ করতাম আমি। একবার একটা বিড়ালের বাচ্চা বাসায় এনেছিলাম রাস্তা থেকে। অনেক সুন্দর ছিল বাচ্চাটা। কিন্তু মার অপছন্দ ছিল বিড়াল। তাই আমাকে শুনতে হয়েছিল অনেক কথা। আর বাচ্চাটার জায়গা হয়েছিল ওই রাস্তাতেই। বাচ্চাটাকে না বের করলে আমার নিজেকেই যে রাস্তায় বের হয়ে যেতে হতো। এভাবে আমার ইচ্ছা, আমার শখের সাথেও হয়ে গেল ব্রেক আপ।

 

এতকিছুর পরও কেন জানি আমাকে স্কুলে ভর্তি করানো হল। লোকে কী বলে, এই ভয়েই কিনা, কে জানে? আমার স্কুলের বান্ধবীরা কত কী যে করত!

"চল, এটা করি, ওটা করি।"

"এখানে চল, ওখানে চল।"

"এটা খাই, ওটা খাই।"

"এটা কিনি, ওটা কিনি।"

নানা অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে যেতে হতো ওদেরকে। এছাড়া আর কীইবা করতে পারতাম আমি? আমার খাওয়া, স্কুলে যাওয়া-আসা, আমার পেছনে আরও কত বাড়তি খরচ হচ্ছে, তার হিসাব আমাকে বাসায় শুনতে হতো প্রতিটা দিন। টিফিনের কোন ঠিক-ঠিকানা ছিল না। কোনদিন একটা রুটি, কোনদিন শুধু পানি, অথবা কোনদিন না খেয়েই কাটাতে হতো টিফিনের সময়টা। বন্ধুদের দিতাম কত বাহানা-

"ক্ষুধা নেই।"

"আজকে সকালে অনেক খেয়ে ফেলেছি রে।"

"বাসায় মা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি না যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে।"

আমাদের স্কুলে প্রতি বছর শেষে একটা পার্টি হতো- ক্লাস পার্টি। তার ফি জমা না দেওয়ায় বান্ধবীদের সে কী রাগ!

"কোনবারই তুই পার্টিতে আসিস না। আমাদের সাথে কোথাও যাসও না। কী এত কাজ তোর? তুই থাক তোর মত। যা ইচ্ছা কর তুই।"

আমি মনে মনে ভাবতাম, "আমি যদি আমার সব কথা তোদেরকে বলতে পারতাম, তবে আমার বুকটা হালকা হতো রে। এই মনে কত কষ্ট, কত না বলা কথা, বলার মত ভাষা আমার নেই। আমাকে তোরা ক্ষমা করে দিস, প্লিজ। ক্ষমা করে দিস আমাকে তোরা।"

এভাবে করে কখন জানি বান্ধবীরা আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল। নাকি আমিই সরে আসলাম ওদের কাছ থেকে, জানি না আমি। শেষ পর্যন্ত প্রিয় বান্ধবীদের সাথেও ব্রেক আপটা হয়ে গেল আমার।

 

সময়ের সাথে সাথে স্কুল, কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। খরচ কম, সমস্যা কম! তো ভার্সিটিতেই আমাদের ক্লাসেরই একটা ছেলেকে খুব ভালো লাগল আমার প্রথমবারের মত। মনে হল, যাকে এতদিন এই মন খুঁজেছে, তার দেখা আমি পেয়েছি। হয়ত এবার আমার কষ্টের দিনগুলোতে আমার সাথী হবার জন্য, আমার কষ্টকে ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য, তাকে আমার পাশে পাব আমি। যে শুধু আমার কষ্টকে সহনীয় করবে না, বরং আমাকে ভালোবাসবে। ভালোবাসবে অন্তর দিয়ে, নিজের করে নেবে আমাকে। যাকে নিয়ে আমি ছোট্ট একটা ঘর বাঁধব-ভালোবাসার ঘর। সত্যিকার শান্তি-সুখের ঘর।

কিন্তু যখন দেখলাম, আমার ক্লাসেরই একটা মেয়ের সাথে তার প্রবল মেলামেশা, ভালোবাসাবাসি- মনে পড়ল, আরে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার তো ব্রেক আপ হবার কপাল! এটা তো হতোই, হতেই হবে, না হয়ে কোথায় যাবে?

 

আমি ভুলে গিয়েছিলাম, কাউকে ভালোবাসার অধিকার আমার নেই, কারো ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই আমার। অধিকার নেই স্বপ্ন দেখার, ঘর বাঁধার। আমার নিয়তি হল, আমি স্বপ্ন দেখব। কিন্তু তা বাস্তবের রূপ পাবে না কখনোই। প্রবল ঝড়ো হাওয়া এসে প্রতিটি বার আমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে দেবে তাসের ঘরের মতন। গুঁড়োগুঁড়ো করে দেবে আমার স্বপ্নকে, আমার ইচ্ছাকে, আমার এই হৃদয়টাকে। যেই হাওয়ায় আমি ভেসে যাচ্ছি, ভেসে যাব। হয়ত ভাসতেই থাকব, কোন এক নতুন ব্রেক আপ হওয়ার আগ পর্যন্ত...

 

                           


        [বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ গল্পটি কাল্পনিক। আমার জীবনের সাথে এর মিল নেই। বাস্তব জীবনে আমি অনেক সুখী মানুষ। মা-বাবা, ছোট ভাই, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে নিয়ে অনেক ভালো আছি। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, আমার কিন্তু একজন ভালোবাসার মানুষ আছে। যে আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে- সত্যিকার, স্বর্গীয় ভালোবাসা। ওর পড়াশুনা শেষ হলেই আর ২/৩ বছর পর ইনশাল্লাহ পারিবারিকভাবে আমরা আমাদের ভালোবাসাকে একই বাঁধনে বাঁধব। বাঁধব আমার স্বপ্নের, আমার চির চাওয়ার ভালোবাসার ঘরটি। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।]

 




-অধরা, নিউ ইয়র্ক থেকে।

No comments:

Post a Comment