Subscribe:

কল্পময় বাস্তবতা

 রাত ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে , আকাশে থেমে থেমে আলোর ঝলকানি , ঠাণ্ডা বাতাস জানালা হয়ে ঘর মাখামাখি , মালতি ছটফট করছে বহুক্ষণ যাবত । তার কিছুতেই ঘুম হচ্ছে না । ঘুম না হওয়াটা তার কাছে এদানিং নতুন কিছু না ।  সাড়ে পাঁচ মাসি পেট নিয়ে সম্পূর্ণ একা রাত কাটানোটা অন্যরকম ।অধিকাংশ সময়ই ঘুমানো সম্ভব হয় না কারণ থেমে থেমেই অনাগত মানুষটি তলপেটে তার অস্তিত্ব জানান দেয় ।



                            প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেয়েছে ।বুকে চিনচিন একটু ব্যাথা করছে । মালতি খাট থেকে নেমে পাশে রাখা টেবিলে গেল পানি খেতে । জগ খালি ।  সে ধিরে ধিরে আবার যখন খাটে ফিরে আসলো তখন বিস্ময়ে তার শরীর দুলে উঠলো  ।
                  তার খাটের কিনারায় লাল ফ্রক পড়া এক মেয়ে বসে পা নাচাচ্ছে । বসয় ৫ কিম্বা ৬ এর বেশি না , ফুটফুটে মেয়েটির চুল দুটি লাল ঝুটি করা , চোখে গাড় কাজল ! হাতে কিসের যেন একটা আলোর বিন্দু নিয়ে খেলছে , খুব সম্ভবত জোনাকিপোকা  কিন্তু এই মেয়ে কোথা থেকে উড়ে আসলো ? দরজা বন্ধ । জানালার গ্রিল এখনো অক্ষত । ঘরে মালতি ছাড়া আর কেউ থাকে না । তাহলে !

                                  প্রথমিক বিস্ময় কাটানর সাথে সাথে এক্ষণ তার ভয়ে হাত পা কাপছে । চীৎকার করা উচিৎ কিন্তু কোনমতেই করতে পারছে না ,  মনে হচ্ছে কে যেন তার গলা শাড়ি দিয়ে পেছিয়ে ধরে রেখেছে । লোক মুখে সে শুনেছে এই পোয়াতি অবস্থায় মায়েদের একা পেলেই নাকি ‘’ উনারা ‘’ এসে হাজির হয় । তারপর ...... !  মালতি আর ভাবতে পারছে না । তার মাথা ঘুরাচ্ছে , মনে হচ্ছে এক্ষনি ঠাস করে পড়ে যাবে এমন সময় বাচ্চা মেয়েটি রিনরিনে গলায় ডেকে উঠলো  - ‘’  মা তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ ? নিজের মেয়েকে কি কেউ ভয় পায় ! তুমি তো ভারী ধরনের বোকা মা  !‘’ মেয়ে এবার হুবহু  মালতির মতো গাল টিপে কুটকুট করে হাসতে লাগলো । বাচ্চাটার হাসির শব্দে কিছু একটা ছিল যার কারনে হটাত মালতির ভয় নিমিষেই চলে গেল ।  সে ভাল করে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার চিবুকে তার মতই তিল , ঠোঁট জোড়া তার মতোই পাতলা ,  এমন কি কথা বলার সময় মালতির মতই ঘাড় বাঁকা করে তাকায় । 
                           তার কাছে সম্পূর্ণ ব্যপারটা অবাস্তব মনে হচ্ছে ।মনে হওয়াটাই যুক্তির কথা কারন এমনটা হওয়া কোন মতেই সম্ভব না যে তার পেটের বাচ্চা জন্মের আগেই তার সাথে ঘাড় বাঁকিয়ে রসিয়ে কষিয়ে আড্ডা জমাচ্ছে !

                        মালতি মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল । একটু কাপা হাতে মেয়েটির হাত ধরল , তার কেবলি ভয় হচ্ছে , যদি সে চলে যায় !  ঘটনা ধোঁয়া ধোঁয়া হোক আর যাই হোক আসল কথা হচ্ছে  শত অবাস্তবতা  শর্তেও মালতির খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে তার অনাগত সন্তান এখন তার চোখের পা দুলাচ্ছে ।
 ‘’তুই কিভাবে এখানে আসলি ? কে নিয়ে এল  তোকে আমার কাছে ? ‘’ ঘোর লাগা চিন্তায় মালতির প্রথম কথা ,
 মেয়েটি ঘাড় বাঁকিয়ে অবাক হয়ে বলল – ‘’ ও মা , এইটা কেমন কথা ! আমি কোথা থেকে আসবো ? আমি তো তোমার সাথেই সবসময় , তোমার  সমস্ত নিঃশ্বাস সমস্ত অনুভুতি আমি অনুভব করি ।তুমি যা যা দেখ ভাবো সবই তো আমি জানতে পারি । পেটের ভিতর থেকে দেখলাম তুমি একা একা মন খারাপ করে বসে আছ , তাই ভাবলাম যাই একটু গল্প করে আসি , বল তো মা ভাল করি নি ! ‘’
                          ভাল নাকি মন্দ সেইটা এখন মালতির মাথায় নেই সে স্তব্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে । এইটুকু বাচ্চা কি টুসটাস করেই না কথ বলছে !টার সারা মুখে কি মিষ্টি একটা ঘ্রান ! চেহারায় একটা লাবণ্যতা , শুধু তাকিয়েই  থাকতে মন চায় ।

              মেয়েটি এবার কিছুটা অভিমানভরা চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল –‘’ মা , তুমি আজ সারাদিন খাওনি কেন ? তুমি জানো না তুমি না খেলে যে আমারও খাওয়া হয় না । আজ সারাদিন অনেক কষ্ট হয়েছে আমার । ‘’
             মালতির বুক টা হু হু করে উঠলো । তার ছোট্ট মেয়েটা আজ তারই জন্য সারাদিন না খাওয়া ! একজন মা হয়ে সে মেয়ে কে না খাইয়িয়ে রেখেছে । মালতির চোখে ঝর ঝর করে পানি চলে আসলো । সে মেয়েকে কাছে টেনে বলল –‘’ মা রে আমাকে মাফ করে দে রে মা , আমি ইচ্ছা করে এমনটা করি নাই , আজ সারাদিন আমি একফুটা পানিও পাই নাই রে । আমি লুকিয়ে আছি ঢাকা থেকে কিছু দূরে একটা গ্রামে , এইটা তোর বাবার এক দূরসম্পর্কের পিসির বাড়ি । সারা বাংলা এখন উত্তাল , পুরদমে দেশে যুদ্ধ চলছে । আজ নাকি গঞ্জে খবর বেরিয়েছে  পাক বাহিনি  এই গ্রামেও এসে যাবে । তা শুনে এখানকার সবাই পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে । সবাই খুব অতঙ্কিত হয়ে গেছে রে ।  যুদ্ধের সময় মানুষ খুব অসহায় হয়ে যায় । ‘’
                       মালতি কোন মতেই সে কান্না থামাতে পারছে না। মায়ের কান্না দেখে উতলা হয়ে বাচ্চা মেয়েটি পিছনে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল , গালে গাল ঘষে বলল – ‘’  মা গো কেঁদো না মা , আমি তোমার সাথে এতক্ষন দুষ্টামি করেছি ! আমার একটুও কষ্ট হয়নি , সত্যি বলছি মা আমার একটুও কষ্ট হয় নি ,তুমি আর কেঁদো না ... ‘’ মেয়েটি যত্নে মালতির কান্না মুছে দিচ্ছে , মালতি তাকে কোলে নিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে রাখল ।

                   কিছুক্ষন পর মায়েটি জিজ্ঞাস করল – ‘’ আচ্ছা মা , বাবা কবে আসবে? আমার বাবা কে দেখার বড় শখ ।‘’
 মালতি তার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল – ‘’ তোর বাবা এখন যুদ্ধে , এখান থেকে অনেক দূরে সে । কিছুদিন আগে তোর বাবার চিঠি এসেছিল, চিঠিতে সে বার বার তোর কোথা লিখেছে । যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সে তোকে প্রথম দেখবে , তখন দেখিস তোকে কি ভীষণ আদর করে !!
 ‘’  আমার বাবা কি অনেক সাহসী ?’’
‘’ হে রে , তোর বাবা অনেক সাহসী , যারা নিজের জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে তারা অনেক সাহসী হয় ।‘’মালতি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল হটাত সে  জিজ্ঞাস করল – ‘’ আচ্ছা , আমার পেটের ভিতরে তোর কেমন লাগে ?
                                মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগলো – ‘’ তোমার ভিতরে অনেক মজা , ওইখানে খুব আরাম লাগে ,কেবল সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন আর স্বপ্ন দেখি ।  এইখানে আসার পর থেকেই কেমন যেন একটা বারুদ বারুদ গন্ধ পাচ্ছি , চারিদিকে  অন্ধকার একটু পর পর চিৎকার ,  কিন্তু ওইখানে এইসব কিচ্ছু নেই ,  সারাক্ষন বেলি ফুলের একটা ঘ্রান ছড়িয়ে , সবসময় একটা ‘’ ওম ওম ‘’ ভাব থাকে । বেশি শান্তি শান্তি লাগে তোমার ভিতর ।  কিন্তু এইখানে আমার বেশ ভয় করছে মা ।‘’
মেয়েটি ভয়ে আরও কুঁকড়ে মালতির কোলে আশ্রয় নিল ।
মালতি ভাল ভাবে জড়িয়ে ধরে রাখল তাকে । কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে জানাল – ‘’ কোন ভয় নেই মা। আমি আছি না ! তুই দেখিস তোর বাবা একদিন ঠিকই দেশ স্বাধীন করবে । আমাদের আর না খেয়ে থাকতে হবে না, কোন মানুষের আর্ত চীৎকার শুনা যাবে না । চারিদিকে আনন্দ আর আনন্দ থাকবে । তোকে আমরা নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব , তুই নুপুর পায়ে নাচবি , আমি আর তোর বাবা মুগ্ধ হয়ে দেখব ।‘’
 মেয়েটির চোখে এইবার আনন্দ ঝিকমিক করছে ।  সে ইতিমধ্যে নাচের মুদ্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে । এই সময়টাই হয়তো হুটহাট স্বপ্ন দেখার ।
‘’ মা আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে , আমি তোমার কোলে ঘুমাই তুমি আমায় ঘুমপাড়ানির গান শুনাও ‘’  মেয়েটি পরম নির্ভরতায় চোখ বন্ধ করল । মালতি গুনগুন করে তার মেয়েকে গান শুনাচ্ছে । রাত প্রায় শেষের দিকে । ভোরের আলো আকাশ ছয়ার প্রতিজ্ঞায় এগিয়ে আসচ্ছে ।

                                হটাত  দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ । মালতি ধরমরিয়ে দরজা খুলে দেখে পিসি দাড়িয়ে , ---‘’ জয়ন্তর বউ তাড়াতাড়ি চল , পাক মিলিটারি গেরামে ডুইক্কা পড়ছে, সব জ্বালাইয়া দিতাছে , অক্ষুনি পালাইতে হইব , চল জলদি ।
    মালতি খাটে তাকিয়ে দেখে খাট ফাকা , সকালের তাজা আলো জানালা গলে খাটে এসে পড়ছে ।
সে পিসির দিকে ফিরে বলে ‘’ কিন্তু জয়ন্ত তো তাহলে জানবে না আমরা কোথায় !! সে তো জানে আমি এইখানে !
  বৃদ্ধা ব্যস্ত হয়ে বলল – ‘’ বউ দুনিয়া গোল , দেখিস ঘুরতে ঘুরতে একদিন ঠিকই দেহা হইব , এক্ষণ জান ডা আগে বাচাইতে হইব  রে , আর দেরী করিস না ।‘’
মালতির মন সারা রাত যে ঘোর সৃষ্টি করেছিল সকালের বাস্তবতায় টা ভেঙ্গে গেছে । সে এক শাড়িতে হাতে কিছু না নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হল । বাইরে দেখল শত শত মানুষ নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছে । তাদের ভয়ার্ত চীৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে ।
   মালতি তার পেটে হাত রাখল । তার অনাগত সন্তান এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদে , তার গর্ভে ।সে যেভাবেই হোক তার সন্তানকে নিরাপদ রাখবে । এবং সে বিশ্বাস করে তার সন্তান স্বাধীন দেশের বুকেই জন্ম লাভ করবে কারন সে যেমন তার অনাগত সন্তানকে রক্ষায় প্রতিজ্ঞ তেমনি প্রতিজ্ঞা করেছে এই বাংলার সন্তানরা তাদের  ‘’ বাংলা মা ‘’ কে রক্ষার ।
 মালতি বিশ্বাসী পদক্ষেপে সামনে হাটা শুরু করছে । 


( মুহাম্মদ রাফিউজ্জামান সিফাত)

No comments:

Post a Comment