Subscribe:

ফোর্‌থ ডাইমেনসন

মানুষের জীবনে অনেক গল্প থাকে। আমার জীবনটা সাদামাটা । তবুও কিছু ঘটনা যে নেই তা নয়। আমি যখন ক্লাস টু তে পড়ি তখন আমার বড় ভাইকে এক লোক বাসায় থেকে পড়াত। আমার ভাই ক্লাস নাইন এ পড়ত। ভাল রেজাল্ট করানোর জন্য বাবা মা লজিং মাস্টার রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।


পাঠক বন্ধুরা প্লিজ ভাববেন না যেন যে ঐ লোকের সাথে আমার প্রেম হয়ে গিয়েছিল! প্রথম দিন এসেই লোকটা আমাকে এমন কিছু কান পর্যন্ত হেসে বলল যা ঐ বয়সেও শুনে আমার কান গরম হয়ে গিয়েছিল। আমার নিজেকে প্রথমেই খুব অসহায় লাগতে শুরু করে। মনে হত নিজের ঘরে আমি যেন অবহেলিত। এ কে এল আমাদের বাসায়! আমার লোকটাকে সহ্য হত না। পরে অবশ্য সে এমন কিছু আচরণ করে যা আমার তখন বরদাস্ত হত না।

পরে টিন এইজ বয়সে এসে আমার সামনে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি নিজেকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে থাকি আর সব কিছুর জন্য আমি নিজেকে পৃথিবীর সব স্বাচ্ছন্দ্য থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেই। আট বছরের একটা মেয়ের সাথে হয়ত চরম কিছু করা যায় না, তবে যতটুকুই হয়েছিল তা ছিল আমার জন্য লজ্জা আর কষ্টের। আমি মাত্র সাড়ে ন’ বছর বয়স থেকেই তীব্র দুঃচিন্তা করতে করতে মাথায় যন্ত্রণার রোগী হই। ফলাফল মায়পেইক গ্লাস। আমার মনে হত আমার চারপাশের আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মত আমার শৈশব যাচ্ছে না! আমি অসহায়ের মত কাঁদতাম। কেউ ছিলনা সেই কান্না মুছে দেবার। কাউকে বলবার মত ভাষা কিম্বা সাহস আমার কোনটাই ছিল না। তাই নিজের কষ্টে নিজেই চোখের জল ফেলতাম।

আমি মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে। তার উপরে আমার বাবা ভয়াবহ রাগী মানুষ। মা-বাবার মাঝে সামাজিক সম্পর্কটুকুই শুধু ছিল। সেই জন্য ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়ে দুর্নামটা মাথায় নিতে হয়নি আর। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম মা বাবার মধ্যে ঝগড়া। খুব খারাপ লাগত তখন। ইচ্ছে হত সব ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যাই।

ভাইয়ের এস.এস.সি র রেজাল্ট এর পর পরিস্থিতি হল আরও ভয়াবহ। ভাই রেজাল্ট ভাল করল না। বরং বেশ খারাপ করে ফেলল। এ জন্যও আমার বাবা অনেক অংশে দায়ী। ছোটবেলা থেকে ভাই কে মাত্রাতিরিক্ত শাসন করত। আমি দেখেছি কি বিষম মারটাই না খেতে হত ওকে! আমি ভয়ে সিটিয়ে থাকতাম। আমার ভাই আমার চেয়ে প্রায় ছ’ বছরের বড়। ওর সাথে পরিবারের সবার দূরত্ব বাড়ল। আমার সাথেও। আমাকে কেন যেন ও ঈর্ষার চোখে দেখত। ওর ধারণা ছিল আমি বোধ হয় একটু বেশিই আদর পাই।

ভাইকে সম্পূর্ণ দোষ দেয়া যায় না। ছোটোবেলা থেকে ভাইএর শাসনের পরিণতি দেখে আমার মা আমাকে সর্বদা বাবার শাসন থেকে আগলে আগলে রাখার চেষ্টা করত। বাবাও আমাকে অনেক বেশি ভালবাসে ছোট বলে। যদিও এই আমাকেই মেয়ে বলে জন্মের সময় সেই বাবাই খুব একটা খুশি হয় নি!যাই হোক, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কখনও জীবনে বিয়ে করব না। ভালবাসা তো দূরে থাক। পরাশুনা নিয়েই থাকতাম। আমার রেজাল্টও ভাল হল।

তবে তার পিছনেও অনেক কষ্টের ঘটনা ছিল। ভাইএর রেজাল্টের পর আমার উপর স্বভাবতই চাপ অনেক ছিল।মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির বাবা মায়েরা বোধ হয় তাদের সব না পাওয়া স্বপ্নগুলোকে ছেলেমেয়েদের দিয়ে পূরণ করাতে চায়। তবুও অনেক ভালই হল পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টগুলো।

আমার জীবনে তখন বিদ্যাচর্চা ছাড়া আর কোনও চিন্তার বিষয় ছিল না। এর কারণ আমি বোধ হয় আগেই বলেছি। অনেক দিনের ব্যাবধানে হয়ত সেই দুঃসহ সৃতিগুলো আর তেমন নাড়া দিত না। তবে আমার প্রতিজ্ঞার কথা কখনো ভুলতাম না।এভাবে দিন কেটে গিয়ে একসময় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।

আমার বন্ধুভাগ্য তেমন ভাল নয়। আমি ছোটোবেলা থেকেই লক্ষ্য করতাম আমাকে কেউ বোঝবার চেষ্টা করে না। আমি যতই মানুষকে কাছে টানি না কেন তারা কেউই আমার অন্তরের বন্ধুত্বের দাবীদার নয়; বরং আমার বন্ধুত্তের উদারতার সুযোগ নিয়ে আমাকে কাজে লাগাত। আমি এটাকে মেনে নিয়েছিলাম। তার একটা বড় কারণ হল বাবা মা আমাকে খুব একটা কোনও বন্ধুর বাড়িতে যেতে দিতেন না। আমি মনে মনে কত কেঁদেছি। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। আমি এই জীবনকেই মেনে নিতে শিখলাম একসময়।

আমার চারপাশের জগত নির্দিষ্ট কিছু গণ্ডির বাইরে প্রসারিত ছিল না এইচ এস সি এর আগ পর্যন্ত। পরে অবশ্য বাবা মায়ের শাসন হঠাৎ করেই শিথিল হয়ে পড়ল। বাইরের জগত এর সাথে অনেক মিশতে লাগলাম। অনেক যায়গায় গেলাম। ছাত্র পড়াতে লাগলাম।এভাবে দিন বেশ কাটছিল। বন্ধুদের সাথে রোমিং আর ফান চলছিল; আমি তোর ক্যাম, তুই আমার ফলোয়ার কিম্বা তুই আমার টিবিয়া, আমি তোর ফিবুলা।

প্রথম টার্ম এর রেজাল্ট ভালই হল। দিনটা ছিল সূর্য গ্রহণ। আমি মোবাইল দিয়ে ফেইসবুক এ ঢুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলাম। পরে পিসি তে এসে দেখি সম্পূর্ণটা। প্রথম কথা হয় অনেক দিন পর। আমি খুব একটা অনলাইন কখনই থাকি না। আমার ছেলে বিদ্বেষ না থাকলেও আমি কখনও কাউকে অন্যভাবে নিই নি আমার সেই প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে। বেশি কাব্য করব না সরাসরিই বলি এই ছেলেটি যেন সুনামি হয়ে আমাকে সুমাত্রার মত লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল।

আমার এই প্রথম কারও সাথে কথা বলে মনে হতে লাগলো আমি যেন ডানা পেয়েছি। এই ডানা মেলে অনেক দূর উড়ে যাওয়া যাবে। যেই আমি তীব্র নারীবাদী আর আতেল ছিলাম, সেই আমার চিন্তাধারায় যেন কোনও ব্যাকহোল এসে সব শোষণ করে এক ধূ ধূ মরুভূমিতে ফেলে দিয়ে গেল। সেই সাহারা মরুর প্রান্তরে আমি একা; কোন অজানা পারস্যের রাজপুত্রের টানে ছুটে চলেছি; কোনোও কূল-কিনারা জানা নেই। আমার মনে তখন দ্বৈতসত্ত্বা। এক আমি অন্ধ মৌমাছির মতো বোঁ বোঁ করে ছুটছি সাহারার মরীচিকার সন্ধানে; আর এক আমি কোন সুদূরের সীনামায় দাঁড়িয়ে কালো ছায়ার মতো মুখে এক রাশ বিরক্তি আর করুণা নিয়ে বার বার ফিরে যেতে বলছি। শেষে মৌমাছিরই জয় হল। সে আমাকে বোঝাল জীবনের অন্যরকম মানে। মনে হতো আমি যেন কোনও অন্ধকার কূয়ার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি; সামনে কোনও কিছু দেখি না অজানা অন্ধকার ছাড়া। শুধু মনে তীব্র আশা যে একদিন সুড়ঙ্গ শেষে দেখা যাবে আলোকোজ্জ্বল সকালের সোনা ঝরানো সূর্য।

অনলাইন ক্র্যাশ বলে হাল্কা ভাবে দেখার কোনও কারণ নেই। কারণ আমি বা সে কেউই ফেইক ছিলাম না; আর আমার চারপাশে এমন কোনও সুযোগ ছিলনা যাতে পারিবারিক চোখ এড়িয়ে প্রণয়ঘটত কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকে। অনেকদিন সে বলত আমাকে দেখা করবার জন্য। হয়তো বুঝতে চাইত; জানতে চাইত। আমি কনফিউসড ছিলাম, দেখা করা কি ঠিক হবে? কিন্তু সে যাই হোক, পরে আমাদের বেশ অনেকবার দেখা হয়। আমার আগের বলা কথাগুলোর পরে নিশ্চয় আন্দাজ করা কঠিন নয় যে আমার আশেপাশে আপনজনের সংখ্যা অপ্রতুল। সে ছিল এর ঠিক উলটো। ওর ছিল অসংখ্য বন্ধু আর পিঠাপিঠি কাজিন। এতো বকবক ছেলেমানুষ করতে পারে তা আমি না শুনলে বুঝতে পারতাম না। তবে মন্দ লাগত না। আমি আগে আগেই বুঝে ফেলতে পারতাম পরে সে কি বলবে। অনেক খোঁচা দেয়া কথায়ও আর পাঁচটা মেয়ের মতো রেগে যেতাম না দেখে সে মাঝে মাঝে বলত, আমি নাকি অন্যরকম।

এভাবে চলল প্রায় এক বছর। কেউই কারও সাথে এমন কোনও আচরণ করতাম না যাতে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। কিন্তু আমদের ঘনিষ্টতা অনেক গভীর ছিল যা অন্য অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো এতদিন এ পরিণতি পেত। বন্ধুরা বা অনেকদিন পর দেখা হওয়া অনেকেই বলে দিতে পারত আমার

কথাবার্তায়,আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ইয়াহু তে চলত মধ্যরাতের চ্যাটিং। কতবার বলতাম, আমি এখন যাই; ঠিক তখনি এমন কিছু একটা মজার বলত যাতে আবার চেয়ার এ বসে পড়তে বাধ্য হতাম। আমাকে সে যত রাগানোর চেষ্টা করত, আমার তত হাঁসি পেত। ভাবতাম আচ্ছা পাগল তো! মাঝে মাঝে নতুন নতুন ইমোশন শিখাতাম। তখন তার উচ্ছাস বাচ্চা ছেলেকেও ছাড়িয়ে যেত। অনেকদিনের মরীচিকার প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে ভিতরে ভিতরে ক্লান্ত হয়ে উঠতাম সত্যিকার জলের তেষ্টায়। এভাবে অনেকদিন কেটে গেল।

আমি আর সে দৈবক্রমে একই সাবজেক্ট এ ছিলাম। আমার বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র হওয়ায় ইতিমধ্যে সে পাশ করে একটা জব পেয়ে গেল। আমি সামনাসামনি হাল্কা অভিবাদন দিলেও মনে মনে যে কত খুশি হয়েছিলাম তা আমি এই নোট এ লিখে বোঝাতে পারব না। কিন্তু ধীরে ধীরে কেন জানি ছক মিলিয়ে সব হল না। এক সময় অতি সাধারন একটি কারনে আমাকে সে এতই অপমান করল যা আমি আজ এক বছর পরেও ভুলতে পারি না। এই একটি বছর আমি অনেক কারণ খুঁজেছি। হতে পারি আমি দুধে আলতা, হরিণীচক্ষি নই। কিন্তু আমার আবেগে, আমার তার প্রতি প্রার্থনায় কোথাও তো সজ্ঞানে কোনো কমতি রাখিনি! তবে বিধি বাম কেন হলেন !!!!!!! যার জন্য পর পর দুটি টার্মের খারাপ রেজাল্ট আমি অম্লানবদনে মেনে নিয়েছি, সে এরকম কেনো করবে আমার সাথে? আমাদের যতদিন পরিচয় তা তো ভুলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট যে, আমাদের পরিচয় ফেইসবুক এ নাকি পহেলা বৈশাখ বা একুশে বই মেলায় সরাসরি বন্ধুর কাজিনের সাথে পরিচয়।

আমার ভিতরে একটা চতুর্থ সত্ত্বা আছে; যে আমাকে শত দুঃসময়েও সাহস যোগায়। এরইমধ্যে আমি এ কূল ও কূল সব হারিয়ে নিঃস্ব। আমার রেজাল্ট এর দুর্দশা আমার এতদিন এ চোখে পড়ল। সেই অন্ধকার কূয়ার শেষে এসে আমি হতাশায় যখন মুহ্যমান ঠিক তখনি আমার সেই ফোর্থ ডাইমেনসান আমি পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে আবার আগের জীবনে ফিরে যাবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আমি আমাকে সান্ত্বনা দিলাম, ঈশ্বর হয়তো জীবনের সব স্বাদ চেখে দেখার জন্যই এ নাটকের অবতারণা করলেন!

আমার জীবন-সাহারায় মরুঝড় সাইমন এসে মুহূর্তে যেন আবেগের নব্য জন্মানো নীল নদটিকে ধূলায় ঢেকে দিল। সেই নীল জলের চঞ্চল মৎস্যকন্যাটির টন টন বালুর পাহারের তলায় রচিত হল সমাধি; বালুর পর বালুর চর জমে গড়ে উঠলো দুর্ভেদ্য প্রাচীর। যেখানে আজ কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ সিলিকার পিরামিড খুড়ে খুঁজে পাবেন সুদূর অতীতে প্রবহমান কোনো নদীর গতিপথ যা আচমকাই থেমে গেছে। আর সেই নদীর হাজারো প্রবাহের মোহনায় পড়ে আছে এক মৎস্যকন্যার ফসিল।এখন আমি আর টানেলের শেষ প্রান্তে একটা সূর্য খুঁজি না; আমার ফোর্থ ডাইমেনসান আমি আমাকে দেখিয়েছে অসীম আকাশে সহস্র নক্ষত্র।

এতটা দূরে সরে এসে এখন আমি অনেক কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাই। ও আসলে অনেক সাধারন ছিল হয়তো। তাই আমার আবেগগুলকে স্বীকৃতি দিতে পারে নি। তবু আমি খুশি এই ভেবে যে, অনেক আগে তার ইউনিভার্সিটি লাইফের শুরুতে যার প্রতি দুর্বল ছিল, তাকেই সে পেয়েছে। আর আমি বুঝতে পেরেছি, যাকে আমি খোলা বই এর পাতার মতো পড়তে পারি তার সাথে হয়তো সারাজীবন আমি সুখী হতে পারতাম না। কিন্তু এত কিছুর পরও আমি তো সব কিছুই মানাতে চেয়েছিলাম; তবে আমি কি এতই মুল্যহীন, এতই সামান্য? তবে থাক, আমার আপনভোলা জীবনটাই ভাল। আজ সে হয়তো মনের শুধু নয়, দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে অনেক দূরে; অনেক জাঁকজমকের দেশে। আজ হয়তো তার জীবনের সব শেয়ার করার সঙ্গীও আছে; কিন্তু আমার মনে কোনও ক্ষোভ নেই; তার জন্য কোনও অভিশাপ নেই। কারণ পছন্দ তো আমার ছিল; আমি কি করে আমার পছন্দকে খারাপ বলি।

তাই শেষে কবিগুরুর ভাষায় বলি,“যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি,ঝড় এসেছে ওরে ওরে, ঝড় এসেছে ওরে এবার,ঝড়কে পেলেম সাথী।“

 

( এটা আমার জীবনের অত্যন্ত সত্য একটি ঘটনা। হয়তো অনেকের মতো সুন্দর করে লেখা হল না। যারা পড়বেন তারা কোনও ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

 

 বারিধি বিন্দু

No comments:

Post a Comment