Subscribe:

মঙ্গল দ্বীপ জ্বেলে

নায়রা ! নামটা শুনে যে কেউ চমকে যায় । এটা আবার কেমন নাম ? এই নামটা ফাদারের রাখা । যার কথা বলছি সে এক খ্রিষ্টান অনাথ মেয়ে । নাম নায়রা। নাহ,তার নামের কোন পদবী নেই । তার মানে এই নয় সে তার বাবা মার নাম জানেনা । তার বাবা মা যখন এই গাজীপুর মিশনারিতে ফাদারের কাছে তাকে রেখে যায় তখন ফাদারের কাছে লিখিত দিয়ে যায়। সেই লিখিত কাগজ ফাদার তাকে দেখিয়েছে,সে যেদিন মিশনারি স্কুল থেকে পাশ করল ,সেদিন।


কিন্তু যে বাবা মা নিজেদের মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে বলে তাকে সেই ছোটবেলায় মাত্র দুই মাস বয়সে এই অনাথ আশ্রমে ফেলে গিয়েছে তাদের পদবী নায়রা তার নামের শেষে লাগানর প্রয়োজন বোধ করেনা । ছোটবেলা থেকে যে ফাদার তাকে কোলে পীঠে করে মানুষ করেছে তাকেই সে মনে প্রানে সব মানে। তিনিই তার বাবা,মা,শিক্ষক,ধর্মগুরু – ফাদারের প্রতিটি বানী তার আদর্শ , জীবনে চলা পথের পাথেয়।

এখন ফাদারের অনেক বয়স হয়েছে । আশ্রমের শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব নায়রার। সে তাদের শিক্ষিকাও । প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে আগে গির্জায় গিয়ে প্রার্থনায় বসে নায়রা, পাশে থাকে ফাদার। প্রার্থনা শেষে তারা নানা বিষয় নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করে। কখনো ধর্ম নিয়ে , কখনো জীবন নিয়ে, মানুষ নিয়ে। ফাদারের দীক্ষা মাথা পেতে নেয় নায়রা। এরপর বাচ্চাদের কে জাগিয়ে তোলার জন্য ঘণ্টা বাজায় । নায়রার ঘণ্টা শুনেই অনাথ শিশুরা সব দৌড়ে আসে।

এক লাইনে দাঁড়িয়ে তারা নায়রার সাথে গলা মিলিয়ে প্রার্থনা সঙ্গীত গায় –
“মঙ্গল দ্বীপ জেলে,অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভর প্রভু ।“
এইটুকুই নায়রার কাছে তার পৃথিবী । ফাদার আজ পর্যন্ত তাকে কখনো চোখের আড়াল করেননি। নায়রার মত সৎ নিষ্ঠাবান মেয়ে বাইরের পৃথিবীর নোংরামি আর অরাজকতা সহ্য করতে পারবেনা , এই ছিল ফাদারের ভয়।

কিন্তু আজ ফাদার বড়ই চিন্তিত। সকালের প্রার্থনার পর তেমন কথাও হয়নি নায়রার সাথে। বল্লেন,আমি সুস্থ বোধ করছিনা । একটু বিশ্রাম নেব। এই বলে নিজের শয়নকক্ষে ঢুকে গেলেন । নায়রা ভেবে পেলনা কি হয়েছে আজ ফাদারের। খুব বেশী খারাপ করেনি তো শরীর ? কিন্তু এই নিয়ে ফাদারের সাথে কিছু বলার ধৃষ্টতাও হলনা তার। ফাদার দুপুরেও বের হলেন না, খেলেননা।

সন্ধ্যায় নায়রা বাচ্চাদের সান্ধ্য প্রার্থনা শেষ করিয়ে পড়তে বসিয়ে নিজে চুপচাপ গির্জার বেঞ্চে বসে ছিল। খুব নিবিষ্ট মনে দুহাত জোর করে শুধু ফাদারের সুস্থতা কামনা করছিল। এমন সময় সিস্টার মেরী প্রবেশ করলেন।
জানালেন ফাদার নায়রাকে তার কক্ষে ডেকেছেন । নায়রার মন খুশিতে ভরে উঠল । ফাদারের নিশ্চয়ই এখন ভাল বোধ হচ্ছে। তাই তার সাথে গল্প করার জন্য ডেকেছেন। প্রায় সন্ধ্যাতেই ফাদার নায়রার সাথে গল্প করেন।ঘরে ঢুকে সে দেখল ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন ফাদার,চোখ বোজা। নায়রার আওয়াজ পেয়ে আস্তে করে চোখ মেললেন । নায়রা হাঁটু গেরে ফাদারের পায়ের কাছে বসে রইল।ফাদার অনেকক্ষণ কোন কথা বললেননা। নায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ধীরে ধীরে।

নায়রা কিছুতেই ভেবে পেলনা কি হল আজ ফাদারের।তিনি কেন এত নিশ্চুপ আর বিষণ্ণ আজ। অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন ফাদার। নায়রাকে বললেন,”আমার টেবিলের উপর একটা খাম আছে, ওটা নিয়ে এসো মা।” নায়রা আদেশ পালন করল। ফাদার ইশারা করলেন খামটা খুলে পরার জন্য। নায়রা খাম খুলল । তার হাত কাঁপছে , নিশ্চয়ই এই খামটা তেই কিছু আছে যা ফাদারের চিন্তিত হবার কারন। সে কাগজটা খুলে পরল।

তার নামে স্কলারশিপ এর অফার এসেছে। কলেজে তার অসামান্য ভাল রেসাল্ট এবং থিসিস এর কারনে তাকে ঢাকায় থেকে ২ বছর এর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে,সরকারি খরচে । প্রথমে খুব বিস্মিত হলেও ধীরে ধীরে নায়রার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।তাহলে এই চিঠিই ফাদারের মন খারাপের কারন। নায়রা আবার ফাদারের পায়ের কাছে বসে পরল।দুহাত রাখল ফাদারের কোলে। হেসে বলল, “ফাদার,আপনি কেমন করে ভাবলেন এই প্রস্তাব পেয়ে আমি আপনাকে ছেড়ে , এই অনাথ শিশুদের ছেড়ে চলে যাব ! কেন আপনি এই ভেবে চিন্তিত হচ্ছেন? আমি কোথাও যাবনা ফাদার, এই আশ্রম ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা।” ফাদার তার মাথায় হাত রেখে বললেন,”নো মাই চাইল্ড , আমি সেজন্য চিন্তিত নই। কখনো তোমাকে আমি আমার চোখের আড়াল হতে দেইনি।আমার ছায়ায় তুমি ছোট থেকে বড় হয়েছ।

বাইরের পৃথিবীটা বড়ই কঠিন মা। সেখানে হাজার রকমের মানুষ,হাজার পাপের ছড়াছড়ি। তুমি কেমন করে থাকবে সেখানে এই ভেবে আমি অস্থির হচ্ছি।”
নায়রা এবার সত্যি অবাক হল ফাদারের কথা শুনে ,”ওহ ফাদার,আমি তো বললাম আমি এখান থেকে কোথাও যাবনা। বাইরের নোংরা পৃথিবীর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাছাড়া এই প্রস্তাবের আমার কাছে কোন গুরুত্বই নেই। আপনার কাছ থেকে আমি যা কিছু শিখেছি তাই আমার কাছে অনেক বড়,যে কোন উচ্চশিক্ষার চেয়ে দামি। আমার ডিগ্রী পাওয়ারও কোন ইচ্ছে নেই ফাদার। আমি এখানেই থাকব আজীবন।”
-“কিন্তু নায়রা , যেতে যে তোমাকে হবেই ...”
-“কি বলছেন ফাদার,আপনি তো জানেন এ আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনাকে ফেলে আমি থাকতে পারবনা ।” দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরল নায়রার।
-নায়রা,আমি তোমার বাবা মাকে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সব রকমের সুযোগ সুবিধা দিয়ে বড় করব। লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মত মানুষ করব। আজ যখন নিজের যোগ্যতায় তুমি এত বড় সুযোগ পেয়েছ তখন নিজের স্বার্থের জন্য আমি তোমাকে এখানে আটকে রাখতে পারিনা।
-“কিন্তু ফাদার এখানে থাকাটা যে আমারি স্বার্থ । যে আশ্রম আমাকে এত কিছু দিয়েছে,পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছে,আজ নিজের স্বার্থের জন্য আমি অকৃতজ্ঞের মত চলে যেতে পারিনা। এ হয়না ফাদার... ”
- আমি কাল থেকে সারাদিন সারারাত অনেক ভেবেছি । তোমাকে যেতে দিতে আমারও কি কষ্ট হবেনা? তবু তোমার বাবা মাকে দেয়া কথা আমার যে রাখতেই হবে ,তোমাকে যেতেই হবে। আমি এমনিতেই ভেবে ভেবে অনেক সময় নষ্ট করেছি,আর নয়। তুমি কালকেই রওনা হবে। তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। তোমার থাকার বেবস্থা আছে ডরমেটরিতেই। তুমি কালই রওনা হবে ।
-“কিন্তু ফাদার ...”
-“নায়রা , এ আমার আদেশ ।”
এরপর আর কিছুই বলতে পারেনা নায়রা। ফাদারের আদেশের উপরে কোন কিছু বলার ক্ষমতা তার নেই। চুপচাপ বসে রইল সে। ফাদার পরম মমতায় তার চোখের পানি মুছে দিলেন। কোমল কণ্ঠে বললেন,”তুমি এই আশ্রমের গর্ব নায়রা। আজ পর্যন্ত কেউ এই সম্মান পায়নি। I am proud of you my child. আমার সম্মান রক্ষার্থে তোমাকে যেতে হবে। যাও মা,তোমার সব কিছু গুছিয়ে নাও।কাল ভোরে তোমার ট্রেন।”
নায়রা আর একটি শব্দও করলনা। ফাদারের পা ছুঁয়ে উঠে পরল।

পরদিন ভোরে ভেজা চোখ মেলল নায়রা। সারারাত এক ফোঁটা ঘুমুতে পারেনি সে। একে তো ফাদারকে ছেড়ে,তার প্রানপ্রিয় অনাথ শিশুদের ছেড়ে,এতদিনের চিরচেনা আশ্রম ছেড়ে থাকতে হবে, তাও এমন এক জায়গায়, যেখানের কোনকিছু সম্পর্কে তার কোন ধারনাই নেই।বাইরের পৃথিবী আজও তার কাছে অধরা।তবু তাকে যেতেই হবে,ফাদারের সম্মানের দিকে চেয়ে তাকে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে।

প্রার্থনা করার সময় আজ আর ফাদার এলনা। নায়রা জানে ফাদার তার সামনে আজ দাঁড়াবেনা। দু জনের দেখা হলেই তারা দুর্বল হয়ে যাবে। তা হতে দেয়া যাবেনা। ব্যাগ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল সে।আস্তে করে ফাদারের দরজার সামনে দাঁড়াল। কিন্তু ভেতরে ঢুকলনা, ফিরে এল। শেষবারের মত সকালের ঘণ্টা বাজাল।

এই ঘণ্টা কানে যেতেই বাচ্চারা উঠে আসবে। ওইত, ওরা আসছে। ওদের কলরব শোনা যাচ্ছে। নাহ,এখানে আর দাঁড়ান যাবেনা। এই নিষ্পাপ মুখগুলো দেখলেই পিছুটান আঁকড়ে ধরতে চাইবে। বাচ্চারা আসার আগেই নায়রা আশ্রম পার হয়ে এল। উঠে গেল ট্রেনে।কোন এক অজানার উদ্দেশে। ট্রেন ছাড়তেই নায়রার বুকটা হু হু করে উঠল। চোখের জল বাঁধ মানেনা। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। দূরে গির্জার চূড়াটা দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ ছোট হতে লাগলো সেটা। ছোট হতে হতে একসময় শূন্যে মিলিয়ে গেল......


২.

আজ পুরো দু বছর পর নায়রা আবার ট্রেনে উঠল। ট্রেন ছাড়তে এখনও দেরি। চুপচাপ অন্ধকারে নিজের সিটে বসে রইল সে। খুব ক্লান্ত লাগছে। এই ক্লান্তি শরীরের ক্লান্তি না,মনের ক্লান্তি। সে কথা জানান দেয়ার জন্যই হয়ত কেউ একজন পেছনের সিটে রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে দিল – “ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু ।পথে যদি পিছিয়ে পরি কভু।”

চোখ বুজতেই মনের পর্দায় ভেসে এল এই দু-বছরের নানা ছবি। বাইরের পৃথিবীটা বড্ড বেশী রংচঙা । এত বেশী যে নায়রার মত আশ্রমের সাদাসিধে পরিবেশে বড় হওয়া মানুষের চোখে সয়না। তার ফাদার তাকে যে আদর্শে মানুষ করেছে,সেই সব নীতিকথার এখানে এক বিন্দু মূল্য নেই। এই দু বছরে নায়রা অনেক কিছু দেখেছে , শিখেছে। পুরো পৃথিবীটা খারাপ মানুষে গিজগিজ করছে। তারই মাঝে কিছু ভাল মানুষের টিকে থাকতে হচ্ছে অনেক যুদ্ধ করে। চারিদিকে শুধু টাকা আর ক্ষমতার দাপট। সততা , মনুষ্যত্ব সব কিছু জিম্মি ।

প্রথমে এসেই দেখল তার স্কলারশিপ টাকার বিনিময়ে এক মন্ত্রীর আত্মীয়কে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেক ঝক্কি ঝামেলা করে সে সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে। টিউশনি করে সে টাকা দিয়ে পরেছে। ফাদারকে কিছু বলেনি,তিনি মনে কষ্ট পাবেন বলে। টিউশনি করতে গিয়ে ছাত্রীর বাবার কু দৃষ্টি এবং অশ্লীল আচরন সইতে না পেরে এক মাস পরেই চলে এল। লেখালেখির কাজ নিল খবরের কাগজে।কিন্তু ন্যায়ের পথে চলতে গিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। সমাজের কিছু উঁচু দরের মানুষের কু প্রবিত্তি তার লেখায় তুলে ধরায় অনেক ঘানি টানতে হল তার।

বাস্তবতার এসব নোংরামির মাঝেও মানুষের একটা মন তো থাকে । সেই মন সপ্ন দেখে,ভালবাসে ,ভালবেসে ঘর বাধে। নায়রাকেও ভালবাসল একজন। তার সাথেই পড়ত। নাম হিমেল। সেই দিনগুলো ছিল খুব অদ্ভুত! আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতা ছিলনা নায়রার। ঢাকায় আসার পর অনেক যুগল তরুন তরুনি কে দেখেছে সে যারা দিব্যি প্রেম করে বেরাচ্ছে,রাত জেগে কথা বলছে, ভালবাসা দিবসে একজন আরেকজনকে এটা সেটা উপহার দিচ্ছে,তারা নাকি bf,gf - এইসবকিছুই নায়রার কাছে খুব অসস্তিকর,আবার হাস্যকরও। প্রেমের নামে এইসব ন্যাকামি দেখলে তার হাসি পায়। এমন সময়েই হঠাৎ একদিন হিমেল তাকে প্রেম নিবেদন করল। বৃষ্টিতে ভিজে একগুচ্ছ কদমফুল হাতে তুলে দিয়ে বলল,”ভালবাসি।”

যখন কেউ জানে যে কেউ তাকে ভালবাসে, সেটা তার ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করে। সেই মানুষটার জন্য আপনাআপনি এক ধরনের মায়া কাজ করে। নায়রারও তাই হল। হিমেল ধীরে ধীরে তার মনে কোথায় যেন জায়গা করে নিল। এতদিন ঢাকাতে থেকেও তার মনে শুধু ফাদার ও তার স্নেহের শিশুরা ছিল সেখানে কেমন করে হিমেল প্রবেশ করল নায়রা টেরও পায়নি। শেষমেশ হিমেলের কাছে নায়রা হার মানল। স্বীকার করে নিল তার ভালবাসা। এরপর- ভালবাসার অসিম সাগরে ভেসে ভেসে দিন
কাটাতে লাগলো তারা।

তারপর এক সন্ধ্যায় তার জীবনের সব কথা সে খুলে বলল হিমেলকে।কেমন করে তার বাবা মার ডিভোর্স হল,তাকে আশ্রমে রেখে গেল,ফাদার তাকে কেমন করে মানুষ করল, সে কি করে এখানে এল --- সব। সবকিছু শুনে হিমেল কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর বলল-“নায়রা,আমি একটু আসি। পরে কথা হবে।”
-“কি হয়েছে হিমেল? শরীর ভাল লাগছেনা?” উদ্বিগ্ন নায়রা আস্তে করে হিমেলের হাতটা ধরল।হিমেল হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল-“আমার একটু কাজ আছে। আমি যাই।”

সেদিনের পর থেকে হিমেল কেমন যেন বদলে গেল। নায়রাকে দেখলেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কথা বলতে চায়না ... নায়রা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। এই রঙচঙা পৃথিবীতে ঘনঘন রঙ পাল্টানো মানুষগুলোকে তার খুব অচেনা লাগে। এত মানুষের ভিড়ে যে মানুষটাকে তার সবচেয়ে আপন মনে হত সেও হঠাৎ পর হয়ে গেল !

দু দিন আগের কথা। নায়রা তার ক্লাস শেষ করে বের হতেই দেখে হিমেল দাঁড়িয়ে আছে।
-“নায়রা,তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
-“বল হিমেল।কি বলতে চাও...”
-“এখানে না।চল একটু আমার সাথে।”
ওরা নির্জনে একটা গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াল। হিমেল আস্তে করে নায়রার হাতটা তার হাতে তুলে নিল। নায়রা আর থাকতে পারলনা। হু হু করে কেঁদে উঠল-“হিমেল,তুমি আমার সাথে কেন এমন করছ?”
-“নায়রা, আমি তোমাকে সত্যি খুব ভালবাসি। কিন্তু ...”
-“কিন্তু? কিন্তু কি হিমেল?” চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল বিস্মিত নায়রা।
-“তুমি অনাথ। তোমার বাবা মার অনেক আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।তাদের কে তুমি আর কোনদিন দেখনি। বড় হয়েছ অনাথ অশ্রমে ...”
-“তো? অনাথ শিশুকে ভালবাসা যায়না। তাইত?”
-“না নায়রা।আমি তো সেটা বলিনি। আমি জানি আমার পরিবার কখনই তোমাকে মেনে নিবেনা। তবু আমি তাদেরকে বোঝাবো। তোমার জন্য এইটুকু তো আমি করতেই পারি।কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি তোমার অতীতকে সম্পূর্ণ ভুলে যাবে। কোন পিছুটান রাখবেনা। ওই মিশনারিতে কোনদিন ফিরে যাবেনা। তোমার ফাদার,ছাত্ররা-কারো সাথেই যোগাযোগ রাখবেনা। আমি সবাইকে কিছু না কিছু বলে বুঝিয়ে দিব তোমার কথা। বাকি সব তুমি ভুলে যাও নায়রা।”
-“বাহ হিমেল,কত সহজেই বললে ভুলে যেতে। আমি যদি এখন বলি তুমি তোমার বাবা মা কে ভুলে যাও,পারবে? আর ভালবাসা কি কখনো মিথ্যে দিয়ে হয়? আমি চাইনা আমার কারনে তোমার কোন অসুবিধা হোক। আমার পরিচয় আমার কাছেই থাক। তুমি সুখি হও।”

সেদিন ছুটে চলে এসেছিল নায়রা। সব ক্ষণিকের মোহ ত্যাগ করে। সারাদিন সারারাত অনেক ভাবল নায়রা। অনেক হয়েছে,আর না। এবার ফিরে যেতে হবে শিকড়ের কাছে। তার অস্তিত্ব যেখানে। যেখানে ভালবাসা পবিত্র,সব চিন্তা চেতনা পবিত্র। আর এক মাস পর তার পড়ালেখার কাজ এমনিতেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এই দমবন্ধ করা শহরে আর এক মুহূর্তও নয়। ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিল সে।
রাতের ট্রেনেই তাকে ফিরতে হবে। শেষ রাতের ট্রেন ............।


৩.

চোখ মেলতেই নায়রা দেখল ট্রেন থেমে আছে। কখন যে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে ! জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল নায়রা। সবে মাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। এই ভোর নতুন এক ভোর । দূরে গির্জার মাথাটা দেখা যাচ্ছে । তার সেই চিরচেনা পৃথিবী। ব্যাগ হাতে ট্রেন থেকে নামল সে। খুব অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে নায়রার । মনে হচ্ছে এই দু বছর কিছুই হয়নি তার জীবনে, সব স্বপ্ন। যে ভোরে সে আশ্রম ছেড়ে এই স্টেশনে এসেছিল, এ যেন সেই ভোর। আশ্রমে পা রাখতেই সমস্ত শরীর শিহরিত হল তার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যাগটা রেখেই ঘণ্টার দিকে এগিয়ে গেল সে। ভোরের ঘণ্টা বাজাল । তার ঘণ্টা সবার চেনা।

ওইতো,বাচ্চারা সব দৌড়ে আসছে। নায়রা হেসে দুহাত বাড়িয়ে দিল ...


-Madhobi Lota

No comments:

Post a Comment