Subscribe:

চোখের অশ্রু আর বৃষ্টির পানির এক হবার দিন

আকাশটা আজ বেশ মেঘলা ।
নিজের প্রিয় আরামকেদারায় বসে আছেন খোরশেদ সাহেব । পরনে সাদা পান্জাবি আর পায়জামা ।

চোখের ভারি চশমাটা বাম হাতে ধরে আছেন। ডান হাতের তর্জনী নিয়ে ঠোট স্পর্শ
করে আছেন তিনি।

...  
আজকে চারিদিকে কেমন যেনো একটা গুমোট ভাব । আকাশের আজকে মনে হয় ভিষন মন
খারাপ ! যে কোন সময় কেঁদে দেওয়ার কুবুদ্ধি করছে ।

খোরশেদ সাহেব এলাকায় সুপরিচিত । পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ তিনি জামাতের সহিত
মসজিদে গিয়ে আদায় করেন ।

জীবন যুদ্ধে অসম্ভব সফল একজন ব্যাক্তি । বাবা মারা যাওয়ার পর ৮ ভাইবোনের
দায়ভার অনেক কষ্টে বহন করেছেন ।

অত্যন্ত কঠিন মানসিকতার মানুষ খোরশেদ সাহেব । তারচোখ দিয়ে কখনো পানি
পরেছেকিনা সন্দেহ আছে ।

তার বাসায় তেমন কেউ আসে না । আগের মতো আর জমজমাট নেই । মেয়ে দুটোকে
উপযুক্ত বিয়ে দিয়েছেন । একমাত্র ছেলেটা আর্মি অফিসার ।

মেয়ে দুটো মাঝে মাঝে আসে তাকে দেখতে । ভালই লাগে তখন । ছেলেটা ২ বছর ধরে মিশনে ।
খোকাকে আজকে অনেক মনে পরছে তার ।

নিজের কাছেও কারনটা পরিষ্কার নয় । অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটাপছন্দ করেন না তিনি ।
কিন্তু আজ কেনো জানি অতীতের কিছু স্মৃতি বারবার মনে পরে যাচ্ছে তার ।

মনে পরে যাচ্ছে রাশিদা বেগমকে বউ করে ঘরে আনার স্মৃতি । ছেলেমেয়েগুলোর
জন্ম , তাদের মিষ্টি দুষ্টমিগুলোর কথা ।

ভাবতে ভালই লাগছে খোরশেদ সাহেবের । নিজের অজান্তেইঠোটে একটু হাসি খেলা
করে গেলো তার ।

ছেলেটার কথাই বেশি মনে পরছে তার । খোকাটা চরম দুষ্টু ছিলো । সারাক্ষন
দৌড়াদৌড়ি করতো ।

"বাবা , বাবা" চিত্‍কার করে ছুটে আসতো খোরশেদ সাহেবের কাছে । বড় হওয়ার
সাথে সাথে ছেলেটা আস্তে আস্তে লাজুক হয়ে গেলো । ছেলেকে কড়া শাষনে রাখতেন
খোরশেদ সাহেব ।

খোকাকে প্রচুর আদর করেন তিনি । তার জন্য বুকে ভালবাসার সাগর তার । কিন্তু
কখনো প্রত্যাক্ষভাবে খোকাকে তার আদরটুকু দেখাননি তিনি।
স্মৃতিগুলো এখনো নতুন লাগছে তার কাছে ।

হটাত্‍ "বাবা" ডাক শুনে যেনো বাস্তবে ফিরে এলেন খোরশেদ সাহেব । পাশে
ফিরেদেখলেন বড় মেয়ে দাড়িয়ে আছে । মেয়েটাকে দেখে অবাক হলেন তিনি ।

মেয়েটার চোখ লাল আর ভিশন ফোঁলা । অনেক্ষন কেঁদেছে বোঝা যায়।

কান্নার কারনটা জিজ্ঞেস করতে চাইলেন তিনি ।

কিন্তু তার আগেই মেয়ে বলে উঠলো "বাবা , যোহরের নামাজের সময় হয়ে গেছে ।"

বলেই দৌড়ে চলে গেলো সে ।
মাথার সফেদ সাদা চুলগুলোতে হাত বুলালেন খোরশেদ সাহেব । ইদানিং সবকিছুই
ভুলে যাচ্ছেন তিনি ।

চশমাটা চোখে লাগিয়ে , পান্জাবির পকেট থেকে টুপিটা বের করে এনে মাথায়
চাপালেন । তারপর স্তিমিত পায়ে এগিয়ে চললেনমসজিদের দিকে ।

মসজিদে ঢুকে অবাক হলেন তিনি । অনেক মানুষ । সাধারত যোহরের নামাযে এতো
মানুষ থাকে না । জামাআত শুরু হয়ে গেছে ।
নিয়ত করে দাড়িয়ে গেলেন তিনি ।

নামায শেষ হলো । ইমাম সাহেব এগিয়ে এলেন খোরশেদ সাহেবের দিকে । আস্তে
আস্তে খোরশেদ সাহেবের কানে বললেন "চাচা । জানাজা শুরু করবো ? লাস তো এসে
গেছে ।"

খোরশেদ সাহেব আবারও অবাক হলেন । ঘাড় কাত করে সায় দিলেন ।

ইমাম সাহেব তাকে ধরে মসজিদের পাশে নিয়ে গেলেন । খোরশেদ সাহেব দেখলেন ,
সেখানে অনেক মানুষ ।

মাঠের মাঝখানে একটা আর্মি ট্রাক । কয়েকজন আর্মি একটা কি যেনো ঘিড়ে আছে ।

কাছাকাছি এগিয়ে গেলেন খোরশেদ সাহেব । দেখতে পেলেন জাতীয় পতাকা মোড়া একটা কফিন ।

ইমাম সাহেব কফিনটার সামনে দাড়ালেন । তারপর সবাইকে কাতার করতে বললেন ।
খোরশেদ সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না । কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না ।

একটা ঘোরের মধ্যে আছেন যেনো তিনি ।
চুপচাপ জানাজা পড়া শেষ করলেন । তারপর দেখতে পেলেন আর্মিরা আবার কফিনটার
সামনে দাড়িয়ে আছে। সামরিক কায়দায় সম্মান প্রদর্শন করলো ।

একজন আর্মি এগিয়ে গিয়ে কফিনের ডালাটা সরিয়ে দিলো। ডুকরে কেদেঁ উঠলো কয়েকজন ।

খোরশেদ সাহেব লাসের মুখ দেখতে পারছেন না মানুষের জন্য ।
বৃষ্টি পরা শুরু করেছে তখন । টিপ টিপ করে পরেই যাচ্ছে । খোরশেদ সাহেবকে
কফিনের কাছে নিয়ে গেলো তার ছোট ভাই ।

কফিনে সাদা চাদরে ঢাকা খোরশেদ সাহেবের খোকার দেহ। খোরশেদ সাহেব নিষ্পলক
চোখে চেয়ে আছেন খোকার মুখটার দিকে ।

তার মনে হচ্ছে খোকা ঘুমিয়ে আছে । ধাক্কা দিলেই ছোটবেলার মতো একটু
নাড়াচাড়া দিয়ে বিরক্ত গলায় বলবে "উফ্ বাবা ! একটু ঘুমাতে দাওনা !"

খোকার মুখে বৃষ্টির পানি পরছে ।কাছে গিয়ে রুমাল দিয়ে মুছে দিলেন তিনি ।

লোকজন কফিনটাকে ঘাড়ে তুলেনিলো । খোরশেদ সাহেবের ছোটভাই তাকে ডাক দিয়ে
কফিনের একটা কোনা ধরার জন্য বলল ।

এগিয়ে গিয়ে কফিনটা কাঠে নিলেন খোরশেদ সাহেব । কফিনের ওজনটা অনেক বেশি
লাগছে তার কাছে । অনেক বেশি । কাধে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার ।

সূরা পড়তে পড়তে কবরস্থানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো সবাই ।

সদ্য খোঁড়া একটা কবরের কাছে এসে সবাই থামলো । কফিন থেকে লাসটাকে সাড়ে তিন
হাত মাটির গর্ভে সঁপে দিলো সবাই । একমুঠ একমুঠ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে
লাগলো কবরটা ।

কবর দেয়া হয়ে গেলো । সবাই তাড়াতাড়ি দৌড়ে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো ।
বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে ।

খোরশেদ সাহেব চুপচাপ কবরের মাথার দিকে পরম মমতায় হাত বুলাচ্ছেন ।

বৃষ্টি মুষুলধারে পরতে আরম্ভ করলো । সদ্য দেয়া কবরের মাটি কাদাঁ কাদাঁ হয়ে গেলো ।

কবরের মাথার কাছে উপুর হয়ে আছেন খোরশেদ সাহেব । পুরোনো স্মৃতির কথা মনে
পরে গেলো তার ।

খোকাকে স্কুল থেকে আনার সময় যখন এরকম বৃষ্টি হতো ,তখন তিনি একটা ছোট্ট
ছাতাধরে রাখতেন খোকার মাথার উপরে । দুজন জায়গা হতো না ছাতার নিচে । তাই
নিজে ভিজতেন ।

হাতড়ে হাতড়ে ছাতাটা খুঁজলেন তিনি কবরের কাছাকাছি । খুঁজে পেলেন না ।

তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে । তার খোকা বৃষ্টিতেভিজে যাচ্ছে । তিনি এটা
সহ্য করতে পারছেন না ।

বৃষ্টি আর তার চোখের পানিতখন এক হয়ে গেছে । আজ তার চোখের অশ্রু আর
বৃষ্টির পানির এক হবার দিন ।

--আহনাফ সানভি--

2 comments:

  1. oshadharon betikromdhormi valobashar golpo vai. . .
    Awesome likhechen. . .
    Isshhh. . . .baba ra amader kotto valobashe ar amra oi valobasha ke kokhono seriously nei na :(
    Bura angul dekhai. . . :(
    Nijeke bodlate chesta korbo :(

    ReplyDelete