শীতের বিকেল!
কার্জন হলের পুকুরপাড়ের ওই বসার জায়গাটাতে পা ঝুলিয়ে বসে আছি দুজন দুদিকে মুখ করে। বেশ হিম হিম রোমান্টিক পরিবেশ, এইসব ভ্যাদভ্যাদে রোমান্টিকতা আমাকে স্পর্শ করে না, কিন্তু আমার পাশের জন একজন বিশিষ্ট রোমান্টিক মানুষ, অনেকক্ষণ চুপ-চাপ থাকার পরে হঠাতই বলে উঠল-
একটা গান করেন, মিশু!
(আমারে কয় গান গাইতে, এর মাথার ইস্ক্রুপ ঠিক আছে তো!)
আমিঃ সাঁতার জানেন?
সাঁতারের সাথে গানের কী সম্পর্ক বুঝে উঠতে না পেরে বিস্ময়ভরা করুণ চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল সে, কিন্তু আমি বড় নির্দয়!
সেঃ নাহ, জানি না! কিন্তু সাঁতারের সাথে গানের কী সম্পর্ক?
আমিঃ নাহ, মানে আমি গান গাইলে কুকুর-বিড়াল মাই মানুষও পানিতে পড়ে! এই ঠান্ডার মইধ্যে আপ্নে পুকুরে ঝাঁপ দিলে আমি আপ্নারে বাঁচাইতে পারমু না!
সেঃ ও আচ্ছা, ঠিক আছে! গাইতে হবে না!
(জনাব সেন্টু খেয়েছেন, কথায় কথায় এরকম বুড়া-ধামড়া একটা মানুষ সেন্টু খায় কেন, সেইটা আমি ধরতে পারলাম না!)
আমিঃ সাঁতার শিখেন! যেদিন সাঁতার শিখা শেষ হইব, আমারে বলবেন- সেইদিন গান শুনামু!
এই হলাম আমি- সবাই এক নামে একটা কাঠখোট্টা, মারদাঙ্গা, ঝগড়ুটে মেয়ে হিসেবে জানে, যাকে কোন নিয়মে ফেলা যায় না; যার সাথে কোন রকম উচ্চ-বাচ্যও করা যায় না! ছেলেরা আমি মানুষটার তো বটেই, আমার ছায়া থেকে দুইশ হাত দূরত্ব বজায় রেখে চলে! অনিন্দিতা বলে, কোন ছেলের ঘাড়ে কি দুইটা মাথা যে আমার কাছে আসবে খামোখা অপমান হতে, কার এত ঠ্যাকা পড়েছে আমাকে ভালোবাসার কথা বলে নিজের জীবন বিপন্ন করার! কথা সত্য, কিন্তু এই ক্যাব্লাকান্ত লোকটা কোত্থেকে যে সাহস পেল আমার কাছাকাছি আসার, শুধু তা-ই নয় আমার ভিতরটাকে এমন স্পষ্ট করে দেখে ফেলার চোখ সে কোথায় পেল তা ভাবলে অবাক লাগে মাঝে মাঝে!
সে বেশ বুঝে গেল, গদ গদ প্রেম প্রেম ভাব নিয়া আমার চারপাশে ঘুরঘুর করলে বা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ মার্কা ন্যাকা ন্যাকা প্রেম কথা দিয়ে আমার মন গলানো যাবে না! প্রেমের গান শুনলে আমার সুরসুরি লাগে, গল্প-কবিতা পড়লে গায়ে জ্বর আসে আর ম্যুভি তো দেখতেই পারি না, বমি হয়ে যায়! তাই আঙ্গুলটা খানিক ব্যাঁকা করতে হবে, ভালবাসার কথাটাকে ভিন্ন স্টাইলে প্যাঁচ খাইয়ে ঘুরিয়ে আমার ভিতর পর্যন্ত পৌঁছুতে হবে! আর বিয়ের কথা কেউ বলতে আসলেই সুন্দর দাঁতগুলা বের করে সাথে সাথেই ‘ভাই, ওয়ালাইকুমুস সালাম! একটু ব্যস্ত আছি, এইবেলা রাস্তা মাপেন!’ বলে উল্টোমুখী হয়ে হাঁটা দিই এটাও তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না!
আমার মতো কুচ্ছিত হাঁসের ছানা-র মতো দেখতে একটা মানুষকে সে কেন এত পাত্তা দেয় তা বুঝতে পারি না! সে জানে, ঠুনকো অহংকারে আমি ধরা’কে সরা-জ্ঞান করি, কখনো-ই আমার জীবনে অন্য কারো প্রয়োজনকে স্বীকার করবো না, কতটা স্বাধীন আর স্বয়ংসম্পূর্ণ আমি তা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ধরতে চাইব না কারো হাত! তাই বুঝি সে অন্য রাস্তা ধরল- বন্ধু হিসেবে আমি কতটা প্রেশাস, কতটা স্পেশাল তার জীবনে তা আমার কর্ণকুহরে নিত্যদিন রেকর্ডেড ক্যাসেটের মতো বাজিয়ে যেতে লাগল! আমি আবার বিশেষ দয়াবান, নিজে থেকে কারো প্রেমে পড়তে পারবো না এতো বেশ জানি, তাই বোধ হয় কোনদিন বলেছিলাম- কেউ যদি এটা আমাকে বোঝাতে পারে যে তার জীবনে আমাকে দরকার, আমাকেই দরকার অন্য কোন মেয়ে নয়; তবে তার পাশে থাকার কথা আমি ভেবে দেখব! ঠিক পয়েন্টটা নোট করে নিতে সে ভুলল না!
আমি বরাবরই কম বুঝি, তাই যেদিন শুভাকাংক্ষীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে কী চায়, আমি তাকে ডাকলাম! গম্ভীর মুখ করে যখন বললাম- শোনেন, আপ্নের কেইস সুবিধার মনে হইতেসে না! এইরকম কেইস আমি খারিজ কইরা দিই, ঝুলায়া রাখি না! সে যখন বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে, বিচলিত না হয়ে আমায় বলল- সে আমাকে চায়, তবে তার মতো করে নয়, আমার মতো করেই! আমি ভালবাসলে সে আনন্দিত হবে, কিন্তু ভাল না বাসলেও কিছু যায় আসে না তার! এই ক্যাবলাকান্ত লোকটার সাহস দেখে আমি অবাক হলাম! তারপর আমরা সব মনে রেখেও ভুলে গেলাম, আগের মতোই দিন চলতে লাগল!
যেদিন বুঝলাম, আমি তার কাছে অপরিহার্য এটা আমাকে বোঝাতে গিয়ে সে নিজেকে আমার কাছে অপরিহার্য করে ফেলেছে আমি তাকে বললাম-
চলো, প্রেম করি! কিন্তু খবরদার, বিবাহের নাম মুখেও আনবা না!
(আমার মতো উড়নচন্ডী তখনো বিবাহের নামে চোখ সর্ষে ফুল দেখে!)
সেঃ আরে না! বিবাহ নিয়া মাথা ঘামায় কে!
(মনে মনে কিন্তু বলসে, প্রেম করতে চাইস- দুইদিন পরে বিয়াও করতে চাইবা; মাঝে কেবল আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতেস!)
এর পরের দিনগুলো খুব সুন্দর, সবুজ! শীতের সকালের গাঁয়ের পাতা-পোড়া আগুনের মতো তার ওম! আমায় জোর করলে মাথার কোষগুলো সব একযোগে অসহযোগ করে বসে এটা সে বোঝে, একসময় হয় তো আমি নিজেই অনুভব করব- সে সেইদিনের প্রতীক্ষা করে ধৈর্য ধরে, কখনো আমায় ছেড়ে যায় না- জানে তো ছেড়ে গেলেই সমূহ বিপদ! সে জানে, আমার সব কথাতেই ‘হ্যা’ বলতে হয়; ‘না’ বললেই ধুন্ধুমার লেগে যাবে! তাই রাস্তার ঝাল আম-ভর্তা খেতে চাওয়ার বায়না করলে মনে মনে আমওয়ালাকে দুটো গালি দিয়ে আমার সাথে হাসি-মুখে ঝালে চোখের পানি ফেলে আম-ভর্তা খাবে আর বলবে- এমন মজার আম ভর্তা সে জীবনেও খায় নি! ও খুব বড়মাপের মানুষ, এই চুনোপুঁটি আমাকে কেন সে এত ভালোবাসে- আমি তার থই খুঁজে পাই না! আমাদের সন্ধ্যাগুলো কাটে পথ থেকে পথে, হেঁটে আর গল্পে মেতে! ছুটির দিনগুলো কাটে ঘোরাঘুরিতে, আমার কথা তো ফুরুতেই চায় না! বরাবরই বড্ড বক বক করি আমি, আজ-কাল যেন আরো বেশী! তাই সেদিন সারাদিন একসাথে ঘোরার পর রাতে যখন সে বলল- চলো তোমায় পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় যাব! আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলাম!
সেঃ কী হলো?
আমিঃ বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না!
সেঃ তাহলে কোথায় যাবে?
আমিঃ তোমায় ছাড়তে ইচ্ছে করছে না!
সেঃ তাহলে কী করবে?
আমিঃ (দ্বিগুণ উতসাহে) চলো, বিয়ে করে ফেলি আজ! তাহলেই তো আমরা একসাথে থাকতে পারব!
মুচকি হেসে সায় দিয়ে বলল- চলো!
সেদিন ঢাকা শহরের কাজী অফিসগুলো সব কেন রাত নটাতেই বন্ধ হয়ে যাবে কে জেনেছিল! অথচ আমাকে তো বিয়ে করতে হবে এবং তক্ষুণি! বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে আমি তাকে বললাম- শোন, আমাদের বংশে ভেগে বিয়ের ব্যাপক ইতিহাস আছে, সো নো টেনশান! আমার ভাইয়ের বিয়ে (অবশ্যই ভেগে) পড়িয়েছিল যে কাজী, সে আবার আমার ভাইয়ের বন্ধু! চলো, নরসিংদী চলে যাই; ঐ কাজী বেটাকে খবর দিই যোগাড়-যন্ত্র করে রাখবে! বিয়ে করে আমাদের বাসায় চলে যাই, মেঘনার পাড়ে!অবশ্য আমার বাপ-মা এই খবর শুনে খুশী আর বিস্ময়ে যেন হার্ট এটাক না করে সেই চিন্তাটা করে রাখতে হবে!
আজ পূর্ণিমা! আকাশে বিশাল একটা চাঁদ! এমন কাকতালীয়ভাবে আমাদের বিয়ের রাতে পূর্ণিমা হবে কে জানত! আমি তাকে নিয়ে এসেছি মেঘনায় পূর্ণ চাঁদের প্রতিফলন দেখাবো আর জোছনায় অবগাহন করব! মেঘনার উপর ডিঙ্গি নৌকায় আমরা, ছলাত ছলাত পানির শব্দ ছাড়া আর নিশ্চুপ চারপাশ!খুব মায়াবী একটা মুহূর্ত, আমি তার হাত ধরে বললাম-
আমার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে!
সে ভয়ের ভান করে বলল- আমার তো সাঁতারের কোর্স শেষ হয় নি এখনো!
কপট অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরো শক্ত করে তাকে ধরে থাকলাম, চোখ বন্ধ করে গাইলাম-
"সকাল আমার গেল মিছে,
বিকেল যে যায় তারই পিছে গো
রেখো না আর, বেঁধো না আর
কূলের কাছাকাছি
আমি ডুবতে রাজী আছি……"
ও কখনো শোনে নি আমার গান, কিন্তু বন্ধুরা বলে- আমি রবীন্দ্রসংগীত খুব সুন্দর গাই!
-Mishu Khan
valobaste valobasber moto sudor akta mon lage,valobasha ke kokhono kosto dio na...
ReplyDelete