রিনি একমনে সামনে রাখা বইয়ের মাঝে ডুবে আছে। মাঝে মাঝে হাসছে। মাঝে মাঝে রাগ করে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলছে। পৃথিবীর কোনও খেয়াল এ মুহূর্তে ওর মাথায় নেই। দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে আকাশ ঢুকল। রিনির মাথার উপরে উঁকি দিয়ে বইটা পড়তে চেষ্টা করলো। যতদূর মনে হচ্ছে হিমুর গল্প । আকাশ ভেবে পায় না মেয়েরা এই হিমুর মাঝে কি পায়? হলুদ রঙের পকেট ছাড়া পাঞ্জাবি আর মার্কা মারা কিছু কথা যার আগা গোঁড়া কোনও অর্থই বোঝা যায়না। এখন যদি ও এমন কিছু করে তবে মেয়েরা ওকে আঁতেল ডাকবে।
কিন্তু হিমুর সাত খুন মাফ!! ওর দেখা আশি ভাগ মেয়ে কোন না কোন গল্পের নায়কের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমন গদগদ গলায় এদের কথা বলে যেন প্রতিদিন নায়ক বইএর পাতা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে আর ওদের সাথে চা নাশ্তা খেয়ে খোশগল্প করে। তবে খুশীর ব্যাপার এটাই যে বাকি বিশ ভাগ তেমন বই পড়েইনা। এখানেই বাঁচোয়া। ও যখন এসব ভাবছে তখন রিনি বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল''কি কাজে আসলি জলদি বলে এখান থেকে ফুট''আকাশা স্তম্ভিত হয়ে গেলো। ''ওই আমি তোর ভাই না? তোর এত সাহস আমাকে বের হতে বলিস?''''ইসসস আসছে আমার ভাই।'' ভেংচি কাটল রিনি ''এমনি এমনিতে তো আসিস নাই,স্বার্থপর কোথাকার''আকাশ দুখি দুখি গলায় বলল ''ছি রিনি,তুই বললে আমি তোর কাজ করে দেই না?'' ''দেখ ,কত কাজ করিস আমার জানা আছে।''''লক্ষ্মী বোন আমার,এসাইনমেন্ট একটু লিখে দেনা। কালকেই জমা দিতে হবে''''এর বদলে কি দিবি?''কি গুণ্ডি মেয়েরে বাবা। আর কিছু পারুক না পারুক চাঁদাবাজি ভালই পারে।
লিখাটা জরুরি না হলে এখন একটা চাঁটি নিশ্চিত ছিল রিনির জন্য। কিন্তু ওই একটা কথা আছে না,বিপদে গাধাকেও বাপ বানাতে হয়... ''তুই যা চাস তাই''''আমাকে কালকে বইমেলায় নিয়ে যাবি আর যেসব বই আমার ভালো লাগবে সেগুলা কিনে দিবি। বল দিবি''''সেদিন না এত গুলো বই কিনলি? সব তো পড়া শেষ ও করিসনি।''''তুই কিনে দিবি কিনা বল...এত বকবক করিস কেন?''''আচ্ছা আচ্ছা দিব । তুই আমার কাজটা করে দে।''''দিয়ে যা,আর শোন কালকে বই তো থাকলই,সাথে আজকে চকলেট হলে আরও ভালো হয়...লেখার জন্য অনেক শক্তি দরকার কিনা'' বলে শয়তানি একটা হাসি দিল রিনি। আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কবে যে এর বিয়ে হবে ও সেদিনের জন্য অপেক্ষা করছে। নিশ্চিত সেদিন ও পার্টি দিবে,খুশীতে পাগল ও হয়ে যেতে পারে।
সন্ধায় আকাশ বাসায় এসে দেখল রিনি চা হাতে নিয়ে আবারো একই বই নিয়ে বসে আছে। ওর হাত থেকে টান দিয়ে মগটা নিয়ে ফেলল আকাশ। তারপর লম্বা একটা চুমুক দিল। রিনি চিৎকার করে উঠল''অই,তুই আমার চা নিয়ে টানাটানি করিস কেন? আম্মুকে বললে তোকে দেয় না? বেয়াদব কোথাকার''আকাশ রাগ করলনা। এটা রোজকারের ঘটনা। আরেকটা লম্বা চুমুক দিলো চায়ে। তারপর বলল ''চিনি বেশী দিয়ে ফেলেছিস। জানিস না আমি চিনি কম খাই?''রাগে রিনি চিৎকার দিয়ে উঠল ''আম্মু দেখো তোমার ছেলে আমার সাথে বদমাইশি করে...ঘুশি দিয়ে যদি আমি ওর দাত না ফেলি আমি তোমাদের মেয়ে না'' ''বলে রাখলাম রিনি,তোকে যে বিয়ে করবে তার কপালে দুঃখ আছে। তোর মতো বক্সার বউএর ঘুশি খেলে একটা দাতও বাচবেনা।'' এরপর রিনি কিছু করার আগেই আকাশ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। রিনির লম্ফঝম্প দেখে হাসতে হাসতে ওর পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে।
আকাশ এমন শুধু রিনির সাথেই করে। কেন যেন এসব করতে ওর ভালো লাগে। সবচেয়ে মজা হয় যখন রিনি খেতে বসে। আকাশ করুন মুখে এসে রিনিকে বলে ''এক গ্রাস খাইয়ে দিবি প্লীজ? আমার একদম ভালো লাগছেনা...হাতে ব্যাথা'' এবং রিনি অবশ্যই বলবে পারবোনা। আকাশ মুখ কালো করে চলেও যাবে দেখানর জন্য যে ও কষ্ট পেয়েছে( আস্ত নাটুকেবাজ ছেলে) । এবং একটু পর রিনি একগাদা খাবার নিয়ে এসে আকাশকে বলবে '' হাঁ কর,শুধু একবার ।'' গজগজ করতে করতে রিনি শুধু এক গ্রাস না...মায়েরা বাচ্চাদের যেভাবে খাওয়ায়,একই ভাবে আকাশকে খাইয়ে দেয়। প্রায় রাতেই এই ঘটনা ঘটে।কখনো যদি প্লেট শেষ হবার আগে আকাশ বলে আর খাবেনা,তখন আবার গরম হয়ে যায়''ইম্পসিবল ! তুই খাবি বলে আমি আবার আনলাম,এখন তোকেই সব খেতে হবে''রিনি আর আকাশ জমজ ভাইবোন। আকাশের ২ মিনিট পরেই রিনির জন্ম,সে হিসেবে আকাশ বড়। কিন্তু রিনি কখনো এটা মানেনা।
তাই সে আকাশ কে কখনো ভাইয়াও ডাকে না। নাম ধরেও ডাকেনা। ''ওই'' হল ওর ডাক। একবার আকাশের এক বন্ধু বাসায় ফোন করেছিলো। রিনি ফোন ধরার পর আকাশকে ডাকল অনেক্ষন ''তোর ফোন আসছে'' আকাশ কোনও জবাব দেয় নাই ইচ্ছা করে যাতে রিনি ভাইয়া ডাকতে বাধ্য হয়। ফাজিল মেয়েটা কি করলো জানেন? গলা ফাটায় চিৎকার দিলো ''আক্কাস তোর ফোন আসছেরে। জলদি আয়'' পুরো একমাস ওর বন্ধুরা ওকে আর আকাশ ডাকেনি। এখনো মাঝে মাঝে ওকে আক্কাস ডেকে খেপায়। এরপর আকাশ কান ধরেছিল। আর যাই হোক,রিনিকে ঘাঁটানো যাবেনা।
ক্লাসে ছিল আকাশ। আজকে ওর একদম ভালো লাগছেনা। রিনি আর ওর জন্মদিন আজকে। কিন্তু গতকালকেই রিনি ওর সাথে ঝগড়া করেছে। আকাশও রাগ করে রিনিকে শুভেচ্ছা জানায়নি। সেই ছোটকাল থেকেই ওরা একে অপরকে সবার আগে জন্মদিন উইশ করে। একারনেই সকাল থেকে অস্থির লাগছে মনটা। মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হবে। আচ্ছা,রিনি কোথায়? ওর গিফটটাও দেয়া হয়নি। নাহ,একটা ফোন করেই দেখা যাক। স্যার বোর্ডে কি যেন লিখছেন। এই ফাঁকে আকাশ মোবাইল বের করে রিনিকে কল দিলো। ধরলনা রিনি। আবার নাকি কোনও জায়গায় রেখে ভুলে গেছে আল্লাহ জানে। এত ভুলো মনা ওর বোনটা। মেসেজ পাঠাল যাতে দেখার সাথে সাথে কল দেয়।
ক্লাস শেষ হতেই বের হয়ে আকাশ জলদি হাঁটতে শুরু করলো। বাসায় যাওয়া দরকার ওর। রিনি কল বা মেসেজ কিছুই দেয়নি। অনেক রেগে আছে মনে হয়। ওর অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। কিছুদুর সামনে এগিয়ে দেখল বেশ জটলা। আবার কি ঝামেলা হল?''আকাশ কোথায় যাস?'' পেছন থেকে ওর বন্ধু ডাকল।''বাসায় যাব।''''এখন ওইদিক দিয়ে যেতে পারবিনা। আবার মারামারি লাগসে। ধরলে পারলেই পিটাবে''''আমাকে কেন পিটাবে? আমি কি পলিটিক্স করি নাকি?''''এতদিনেও বুঝলিনা? মাইর খাওয়ার জন্য পলিটিক্স করতে হয়না। ঝগড়া করবে ওরা আর ধোলাই খাবে সাধারন পাবলিক''আকাশ বিরক্ত হল, বাসায় যাওয়া দরকার। রিনিকে জন্মদিন উইশ করতে হবে। পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে আছে। কিছু ছাত্র একজোট হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। সাধারন ছাত্ররা আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কারো চেহারায় আতঙ্ক,কেউ কেউ বিরক্ত। এক জায়গায় মনে হল মানুষ কম। বের হওয়া যাবে হয়তো।
আকাশ কথা না বলে আবার হাঁটা দিলো। ওই জায়গায় আসতে আসতেই ও দেখল হঠাৎ করে আবার চিৎকার বেড়ে গেছে। কয়েকজন দৌড় দিলো। কয়েকজন ছাত্র দাঁ আর লাঠি নিয়ে ''ধর ধর'' বলে অন্যদের উপর হামলে পড়লো।সামনে যাকে পারছে মারা শুরু করেছে। দেখে আকাশ একটু পিছিয়ে গেলো। কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে। কিছু বোঝার আগেই একটা ছেলে ওর সামনে এসে হকিস্টিক দিয়ে পায়ে মেরে দিলো। ''আম্মু'' বলে আকাশ মাটিতে পড়ে গেলো। প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে পায়ে। সমানে লাথি মারছে ছেলেটা আর বলছে''শালা ___ দল করিস না? আজকে তোর দল করা বের করবো'' আকাশ চিনতে পারল ছেলেটাকে,ঝুপড়িতে দেখেছে অনেকবার। তখন এত হিংস্র লাগেনি। মারার সময় মানুষ এমন পশু হয়ে যায় কেন? আরও কয়েকজন এসে ওকে মারতে শুরু করলো। ''মার শালাকে,আজকে পুতেই ফেলব এদের'' আকাশ অজ্ঞান হবার আগে শেষ এটাই শুনল। রিনিকে ''শুভ জন্মদিন পেত্নি'' আর বলা হলনা।
সকাল থেকে রিনি অনেক ব্যাস্ত । ক্লাসে যায়নি। আজকে সারাদিন সে আকাশের পছন্দের খাবার বানিয়েছে। আম্মুকে একটুও হাত লাগাতে দেয় নি। ভাইয়ের পছন্দের মিষ্টি কিনে এনেছে। মার্কেট ঘুরে ঘুরে আকাশের পছন্দের জিনিস কিনেছে। এবং কালকে ঝগড়াও করেছে ইচ্ছা করে। এমনিতে হয়তো বন্ধুদের সাথেই সারাদিন কাটিয়ে আসত আকাশ,কিন্তু বার্থডেতে রিনিকে শুভেচ্ছা না দিলে আকাশ কোথাও গিয়ে শান্তি পাবেনা। জলদি বাসায় চলে আসবে। মুখে যতই বলুক না কেন রিনিকে অনেক ভালবাসে আকাশ,রিনি সেটা জানে। মোবাইলে আকাশের কল দেখেও রিসিভ করলনা সে। ''করতে থাক্ চান্দু,আজকে তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে'' মনে মনে ভাবল রিনি।
আকাশের সারা গায়ে ব্যান্ডেজ। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন ওর জ্ঞান ফিরতে বেশ সময় লাগবে। আকাশের মতো আরও অনেকে এভাবে আহত হয়েছে। দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার কারনে এখনো বেঁচে আছে। পাশে রিনি চুপ করে বসে আছে। হাসপাতালে এসে আকাশকে দেখার পর থেকে একটা কথাও বলেনি। আসলে প্রথমে সে বিশ্বাসই করেনি। ওর এখনো মনে হচ্ছে আকাশ মজা করছে ওর সাথে। হুট করে ''ভৌ'' বলে রিনিকে চমকে দেবার জন্য।ওদের আব্বু আম্মু বসে আছেন আকাশের অন্য পাশে। আম্মুর চোখে পানি,আব্বুর চোখে অবিশ্বাস।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যখন আকাশ টিকেছিল,অনেক গর্ব হয়েছিলো ওদের। বিছানায় সেই ছেলের এরকম নিশ্চল,রক্তাক্ত শরীর দেখে আজকে কেন যেন সব মিথ্যা মনে হচ্ছে। আকাশের বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ওর আব্বু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন ''বাবারা,আমার ছেলেতো কখনো কারো ক্ষতি করেনি।...ওর সাথে এমন কেন হল বলতে পারো কেউ?'' সবাই চুপ। এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছেই নেই। আকাশের আব্বু অজ্ঞান আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন ''কেন আসতে গেলি বাবা? কেন অপেক্ষা করলিনা গণ্ডগোল শেষ হওয়া পর্যন্ত?'' যেন আশা করছিলেন যে তাঁর দুষ্টু ছেলেটা অন্য সব সময়ের মতো এবারো স্বপক্ষে হাজারটা যুক্তি দিবে। কিন্তু আকাশ চুপ। শূন্যতাটা বড় বেশী কানে লাগছে সবার।''আমরা ওকে নিষেধ করেছিলাম আঙ্কেল,কিন্তু ও কথা শোনেনি। বারবার বলছিল বাসায় যেতে হবে।'' আকাশের এক বন্ধু জবাব দিলো ।রিনি এতক্ষণ কিছু বলেনি। কষ্ট চেপে রাখার অসাধারন ক্ষমতা আছে ওর। কিন্তু এ কথা শুনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলনা। আকাশের হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
''আকাশ,আমাকে মাফ করে দে...তোকে বলতে পারিনাই...শুভ জন্মদিন...তুই শুনতে পাচ্ছিস? এই...তুই আমাকে উইশ করবিনা? আমি আর কখনো তোকে পচাবোনা...এই আকাশ, উঠ না...তোর সব কাজ করে দিব। কোনদিন বিরক্তি দেখাবোনা। প্রমিজ প্রমিজ প্রমিজ...তুই আমার লক্ষি ভাই না? একবার চোখ খুলে তাকা না...ভাইয়া...এই ভাইয়া...''
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে যখন আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে সমস্যার মোকাবিলা করা উচিত তখন আমাদেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ একে অপরের উপর হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝাপিয়ে পড়ছে। কাকে দোষ দিব জানিনা। কিন্তু আকাশের মতো অনেক নির্দোষ ছেলেমেয়েদের এভাবেই এর মাশুল দিতে হয়। বড় কষ্ট লাগে এসব দেখলে। অনেক ক্ষোভ,রাগ আর দুঃখ হয় । গল্পের আকাশকে মারতে পারিনি আমি। সে সাহস আমার নেই। কিন্তু বাস্তবের আকাশরা খুব কমই বাঁচে।
নাজমুন নুসরাত
lakha ta ato sundur pore choke pani ase galo...
ReplyDeleteoooooooossadaron laglo
ReplyDelete