Subscribe:

ভেটকি মাছ ও কানা বেড়ালের গল্প

এক ধরনের মানুষ আছে যারা কখনো কোনও কিছুতে কথা বলেনা, যারা জানে অন্যের সমস্যায় নাক গলিয়ে লাভ নেই। আর এক ধরনের মানুষ আছে যাদের সবার ব্যাপারে শুধু নাক না,পুরো শরীর গলানোর বিশ্রী অভ্যাস আছে। তারা এও বুঝেনা যে এইসব দেখলে রাগে গাটা জ্বলতে থাকে। আশিক দ্বিতীয় দলের মানুষ।


ওর সাথে আমার পরিচয়টা খুবই অপমান জনক টাইপের হাস্যকর।

তখন সবে মাত্র নতুন বাসায় উঠেছি আমরা। আগের বাসাটা আমার ভার্সিটি আর নিপুর কলেজের জন্য অনেক দূরে হয়ে যায়। তাই অনেক দিন ধরেই আব্বু ভালো একটা বাসা খুজছিলেন,কিন্ত মনের মত পাচ্ছিলেন না। আমাদের ভাগ্য ভাল আব্বুর এক কলিগ,ইকবাল আঙ্কেল এই এলাকাতেই থাকেন। তারই পরামর্শে এখানে বাসা ভাড়া নেয়া হয়েছে। আঙ্কেলদের বাসা আমাদের উলটা দিকেই। এলাকাটা আসলেই সুন্দর। আগেরটার মত এত ঘিঞ্জি না। কিন্তু এখানে এসেই আমার সাথে যা হল,আমি কখনই ভুলবোনা।
যেদিন আমরা এসেছি তার দুদিন পরের কথা। ঘর গোছানো শেষ। বিকেলের দিকে আমি নিপুকে নিয়ে বের হয়েছিলাম একটু মার্কেটে যাব বলে।

কথা বলতে বলতে আমরা হেটে যাচ্ছি,হঠাৎ দেখলাম নিপুর হাঁটু আর আমার মাথা একি লেভেল এ।
ছোটবেলা থেকে আমি খেয়াল করেছি সোজা পথ আমি হেঁটে পার হতে পারবনা,মাঝে কোনও না কোনও একটা ঝামেলা হবেই। হয় পড়ে যাব,নাহয় ধাক্কা খাবো...একবার কোনও হোঁচট খাওয়া ছাড়া ভার্সিটি থেকে বাসায় চলে এসেছিলাম। শুধু বাসায় ঢুকতে যাব তখনি কাকের বাচ্চা কাক দিলো আমার উপর...ঈঈঈঈঈঈ...চিন্তা করেই বমি আসছে। বলা যায় আমার সাথে এরকম ফালতু কিছু হবেই,এটা একটা নিয়মের মত হয়ে গেছে।

কিন্তু তাই বলে সেদিনও এক গণ্ডা মানুষের সামনে? কোন এক বজ্জাত কলা খেয়ে তার খোসাটা রাস্তাতেই ফেলে গেছে। আর তাও পড়লো ঠিক আমার পায়ের নিচেই। আমিও দেখিনি যার ফলে স্লিপ খেয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনাই যে কি হল আসলে? কয়েক সেকেন্ড মাটিতে পড়ে আমি চিন্তা করছিলাম যে একটা গর্ত হয়ে যাক আর আমি তাতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু হাহাহা হিহিহি হাসির শব্দ শুনে এটা বুঝতে কষ্ট হয়নি যে বেইজ্জতী এখনো শেষ হয়নি। আমার চেহারা টা সম্ভবত কান্না আর রাগ মিলিয়ে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে গিয়েছিলো। আমি দেখলাম সবচেয়ে বেশী চিৎকার করে যে ছেলেটা তখন হাসছিল সেই এসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসির দমকে তার হাত আর মাথা দুটোই সমান তালে কাঁপছে। নিপুও তাড়াতাড়ি ধরতে আসলো। আমি ওদের সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়ালাম।
''কেউ পড়ে গেলে এভাবে বেহায়ার মতো হাসতে হয়?'' আমি নিপুর দিকে তাকিয়ে ঝাড়ি মেরে বললাম।
ওমা,বেয়াদব ছেলে ''ঠিক বলেছেন,হাসাটা একদমই উচিৎ হয়নি'' বলে আবারও পেট চেপে হাসতে লাগলো!

আমি কথা না বলে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে। নিপু কোন কথা না বলে আমার সাথে হাঁটা দিল। ও জানে আমি রেগে গেলে আমাকে যাই বলুক না কেন আমি শুনবোনা।
পেছন থেকে ছেলেটা আবারো ডাক দিলো
''আপাগো,আল্লাহ আপনাকে যথেষ্ট লম্বা বানাইসে। হিল না পরলে কি হয়?'' বজ্জাতটা আমাকে রাগানোর জন্যই এসব বলছে। আমি হিল তেমন পরিনা।
''ওই ব্যাটা,তোর কি?''
আমার কথা শুনে আরও একটা ভেটকি মাছের মতো হাসি দিলো।

পরের দিন আমি রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম যে গতকালের ভেটকি মাছটা উলটো দিকের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর আমার দিকে হেঁটে আসতে লাগলো। যাক,বোধ হয় কালকের জন্য সরি বলবে। আমি একটু ভাব নিয়ে দাঁড়ালাম। এত সহজে মাফ করবোনা।
ছেলেটা আমার ৩ হাত দূরে দাঁড়াল। ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
''আজকে আবারো হিল পরে বের হয়েছ? এবার যদি আছাড় খাও তাহলে আর তুলতে আসবনা বলে দিলাম''
এত অপমানজনক একটা কথা শুনে আমার কি করা উচিত ছিল জানিনা,কিন্তু আমি হিহি করে হেসে দিলাম। আসলে ওর বলার ধরণটাই এমন ছিল,যেন আমরা অনেক পুরনো বন্ধু।
বলা বাহুল্য,এই ছেলেটাই আশিক। ইকবাল আঙ্কেলের ছোট ছেলে।


আমার আম্মু আর আশিকের আম্মুর মাঝে ভারি ভাব হল। আম্মু কিছু রান্না করলে ও বাসায় এক বাটি পাঠাবেই,আর আশিকের আম্মুও একই কাজ করেন। বলা যায় অনেক আন্তরিক একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমাদের দুই পরিবারের মাঝে। নতুন এলাকাতে অনেক ধরনের সমস্যা হয়,কিন্তু আশিকের ফ্যামিলির কারনে আমাদের কোন কষ্টই হয়নি।

তো এভাবেই চলছিল আমার জীবন। রোজকারের ছোটোখাটো ঝামেলা ছাড়া আমার জীবন অনেক আনন্দের বলতেই হবে। বাসায় আব্বু আম্মু আর আমার বিচ্ছু বোনের সাথে আড্ডা,আর বাইরে বন্ধুরা তো আছেই। এর সাথে যুক্ত হল আশিক নামের বাঁদর। আমার জীবন কে যাকে বলে একদম ছ্যারা ব্যারা করে দিলো সে। আমার বাসায় এসে ওর হাব ভাব দেখলে মনে হয় বাসা তার,আমাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছে। আমি না থাকলে আমার বই,সিডি নিয়ে যায় (কারন আমি থাকলে নিতে পারেনা) । আর ফিরিয়ে দেয়ার নাম নাই। বেশ কয়েকবার ফেরত চেয়েছিলাম দেখে বলেছিল হারিয়ে ফেলেছে। তারপর আবার গানও গায় ''ফিরিয়ে দাও আমার বই তুমি ফিরিয়ে দাও,আমার সিডি তুমি ফিরিয়ে দাও...এভাবে মেরে দিও না...''

আমার খুব রাগ হয় এসব শুনে। বেহায়াপনারও তো একটা লিমিট থাকে। কিন্তু আশিকের কোন লিমিট নেই। সরি তো বলেই না উলটা দেমাগ দেখায়। বলে ''এরকম ফকিরের মতো করিস,তোর লজ্জা লাগেনা? যা আমি তোকে সব নতুন কিনে এনে দিব'' কিন্তু সেই নতুন সিডি বা বইয়ের নাগাল আমি কখনই পাইনা। আর সুযোগ পেলেই বলে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। কি লজ্জার ব্যাপার!


আশিককে আমি কখনো তেমন রাগ করতে দেখিনি। একবার শুধু দেখেছিলাম। সেদিন ক্লাস থেকে বাসায় আসছিলাম। আমাদের পাড়ারই একটা ছেলে আমাকে বাজে কিছু কমেন্ট করেছিল। আমিও পাল্টা থাপ্পর দিয়ে এসেছি। আমি খুব লড়াকু ধরনের মেয়ে। মারামারিতে এক্সপার্ট। স্কুলে থাকতে আমার ক্লাসের একটা মেয়ে আমাকে আন্ধি বলেছিল দেখে আমি ওর চুল টেনে,চড় মেরে তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলেছিলাম। ফলাফল অভিভাবকের কাছে অভিযোগ আর আম্মুর হাতে উত্তম মধ্যম। লাভের মধ্যে লাভ হল,এই ঘটনার পর থেকে আমাকে কেউ আর উল্টাপাল্টা কথা বলার সাহস পায়নি। কিন্তু সেদিন বাসায় এসে বুঝলাম না কি হল,শুধু কান্না পাচ্ছিলো। এমনিতে আমি অনেক শক্ত মেয়ে। কিন্তু শক্ত মেয়েদেরও মনে হয় মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। আশিক বাসায় এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য। কিন্তু আমি আমার রুমের দরজা খুললাম না। আমার কান্না কাটি দেখে আমাকে আবার খেপাবে। ওকে সে সুযোগ দেয়া যাবে না। ও আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো।

বিকেলে নিপু এসে বলল আশিক নাকি কোন ছেলের সাথে মারপিট করে এসেছে। গিয়ে দেখলাম আশিক সাহেব ড্রয়িং রুমের সোফায় পা তুলে বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছে।
''শুনলাম আজকাল তুই গুন্ডা রাজের রোল প্লে করছিস''
ও ভেংচি কেটে আবার চায়ে চুমুক দিল। ''জরুরি কাজ করছি,বিরক্ত করিস নাতো'' টাইপের এক্সপ্রেশন। ওর ভাবের যেন কেউ কেয়ার করে!
''কার মাথা ফাটালি আজকে?'' আমি আবার জিগ্যেস করলাম।
এবার হাসিমুখে জবাব দিল সে ''তুই যাকে সকালে চড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়েছিস তার''
এবার আমি আসলেই অবাক হয়ে গেলাম। ও আমার জন্য মারামারি করতে গেছে?
''মারামারি করতে গেলি কেন?''
''তুই কাঁদলি কেন?''
''আমি কাঁদলে তোর কি?''
ও জবাব দিল না। শুধু তাকিয়ে থাকলো। তাকানোটা স্রেফ তাকানো না। ওই চোখের দিকে তাকালে অনেক কিছু বোঝা যায়। ওর সাথে পরিচয়ের পর থেকে এত দিনের মাঝে এমন কখনো হয়নি যে ও কোন কথার জবাব দেয়নি। প্রত্যেক ব্যাপারে ওর মুখে কথা রেডি থাকে। আজকে সে ছেলে কিছুই বললনা...কিন্তু এই প্রথম বারের মত আমি ওর নিশ্চুপতার মাঝেই সব শুনে ফেললাম।

মেয়েদের মাঝে মনে হয় এক ধরনের বিল্ট ইন ডিভাইস থাকে যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি কেউ আমাদের একটু অন্য চোখে দেখছে নাকি। আমিও বুঝে গেলাম এবং প্রচণ্ড ভয় পেলাম। হায় হায়,ওকি আমার প্রেমে পড়ে গেল নাকি? ও ফাজলামি করে,আমাকে নিয়ে হাসা হাসি করে এতটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ও আমাকে ন্যাকা স্বরে ভালবাসি বলছে এটা কল্পনা করেই আমার মাথা প্রচণ্ড ব্যাথা করতে লাগলো।

আমার দ্বারা ভালবাসা টালবাসা সম্ভব না। এইসব পুতুপুতু টাইপের ন্যাকামি আমার অসহ্য লাগে। আমি ঘোর প্রেম বিদ্বেষী নারী। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে যারা প্রেম করে তাদের ঢং দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই । ছেলে মেয়ে গুলোর যেন আর কোন কাজ নেই,সাররাত ফোনে গুটুর গুটুর করে। আর দিনের বেলা পড়াশোনা না করে ঘোরাঘুরি করে। যত এসব নিয়ে ভাবি ততই মাথাটা গরম হয়ে যায়। শুধু মাত্র প্রেমের কথা শুনেই আমার এই অবস্থা,আর প্রেম করলে যে কি হবে সেটা বুঝতে আমার আর বাকি থাকলোনা। আমি ঠিক করলাম আজকে থেকে আশিক কে এটাই বুঝাতে হবে যে ভালবাসা ভালো না। আর আমাকে ভালবাসা মানে তো জীবনের চরম ভুলগুলোর একটা। প্রথমে মনে হল ওর সাথে কথাই বলবোনা। পরে মনে হল সম্ভব না। আফটার অল,আমার এত ভাল বন্ধু...ওকে আমি এভাবে মাঝরাস্তায় কিভাবে ফেলে যাই? বাঁদরটা নাহয় একটা গাধামি করে ফেলেছে। আমি তো ওকে এভাবে ভুল করতে দিতে পারিনা। মনে মনে বললাম,আজকে থেকে শুরু হল মিশন ''রেস্কিউ আশিক'' ( বলতে লজ্জা নাই স্পাই মুভি দেখে দেখে আমার মাথা একদম নষ্ট হয়ে গেছে!)

কিন্তু সমস্যা হল কিভাবে কি করবো জানিনা। মানুষ প্রেমে পড়ে এটা জানি,প্রেম থেকে উঠে কিভাবে তাতো জানিনা! বান্ধবীদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলা সম্ভব না। আমি নেটে পর্যন্ত সার্চ দিলাম ''how to get someone fall out of ur love'' বিচিত্র সব রেসাল্ট। কোনটাই আশিকের উপর অ্যাপ্লাই করতে পারবোনা।
অনেক ভাবার পর আমার মনে হল,যদি অন্য কোন মেয়ের সাথে আশিকের লাইন করিয়ে দেয়া যায়...তাহলে আমার প্রতি ওর প্রেম প্রেম ভাবটা উবে যেতে পারে। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

এরপর থেকে আশিকের সাথে দেখা হলেই আমি ওকে শুধু অন্য মেয়েদের কথা বলতাম।
''জানিস,ইমতিয়াজ আঙ্কেলের ছোট মেয়েটা না তোকে পছন্দ করে''
''এই তুই বুঝিস না? আমাদের দোতলার মেয়েটা তুই খেলতে বের হলেই বারান্দায় দাড়িয়ে থাকে''
''আশিক,লাবন্য ( আমার বান্ধবী ) তোর জন্য একদম ফিদা''
''রুমকি তোর নাম্বার চাইছিল,দিব ?'' ইত্যাদি ইত্যাদি
প্রথম কয়েকদিন ও কিছু বলেনি,শুধু শুনে যেত। কিন্তু একদিন একদম ক্ষেপে গেল
''আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগে এটা বললেই তো হয়,হুদাই প্যাঁচাল পারিস কেন? যা আর তোর সাথে কথাই বলবনা''
এই বলে সে চলে গেল।


আমি আশিক কে কি উদ্ধার করব,সেদিনের পর থেকে সেই দেখি আমাকে এভয়েড করছে। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে,ডাকলেও না শোনার মত করে হেটে চলে যায়। প্রথম কয়েকদিন ভেবেছিলাম ও আসলেই ব্যাস্ত। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম ও ইচ্ছা করেই এমন করছে। একদিন আমার বাসায় এসে আমার সব সিডি আর বই দিয়ে গেল।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম '' তুই না বললি এগুলো হারিয়ে ফেলেছিস?'' ওর অবস্থা দেখে মনে হল যে অন্ধের সাথে সাথে কালাও হয়ে গেছে।
শুধুমাত্র বেরিয়ে যাবার আগে আমার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল ''নিপু শোন,সবাইকে বলে দিস আমি কারো জিনিস নিজের কাছে রাখি না...তোর কানা বোনকে বলিস দেখে নিতে সব ঠিক আছে কিনা''

আমার খুব রাগ হচ্ছিল। এরকম কেন করছে ও? ভয়ঙ্কর মন খারাপ হল আমার। আর অনেক অনেক অভিমান। ওর ভাল করতে গিয়ে আমি খারাপ হয়ে গেলাম? আমি ঠিক করলাম আমিও ওর সাথে কথা বলবনা। যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।


এরপর বেশ কিছুদিন আশিকের সাথে কথা হয়নি। আসলে ওকে তেমন চোখেই দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কি আমি ওকে অনেক মিস করতাম।
এত প্রাণবন্ত ছেলে..ও আসলে বাসায় উৎসবের আমেজ পাওয়া যেত। এখন কেমন মরা মরা হয়ে থাকে সব।উহু,সত্যি কথা হল আসলে আমিই মনমরা হয়ে থাকি।
যাই হোক,একদিন ফেসবুকে গুতোগুতি করছি এমন সময় আশিকের প্রোফাইলে দেখলাম নতুন একটা অ্যালবাম আপলোড করেছে...ওর ছবি গুলো অনেক মজার হয়। তাই আমিও খুলে দেখতে লাগলাম। কমেন্ট করতে অনেক ইচ্ছা হচ্ছিল কিন্তু করলাম না।
একটা ছবি দেখলাম এক মেয়ের সাথে তোলা। খুব নরমাল ছবি। কিন্তু দুজনকে অনেক মানিয়েছে একসাথে।

দিবনা দিবনা করেও কমেন্ট করে দিলাম ''তোদের দুজনকে অনেক ভালো লাগছে,এটা প্রো পিক দে''
কিন্তু কেন যেন মেজাজটা খারাপ লাগছিল,তাই ৫ মিনিট পর আবার রিমুভ করে দিলাম। আশিক অনলাইনে ছিলনা,থাকলে আমার কমেন্ট দেখে কিছু না কিছু বলতই। দেখে নাই ভাল হয়েছে।
সেদিন রাতে আমি আজব একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম খুব ধুমধাম করে আশিকের বিয়ে হচ্ছে,আর আমার সাথে ও নিজের বউ এর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এই বলে যে ''দিশা,এটা তোর ভাবী''
স্বপ্নটা দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবং জানিনা কেন যেন আমার সারারাত আর ঘুম এল না।


পরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটে গেলো। আমার আর কিছুই ভাল লাগেনা। সারাদিন শুধু আশিকের কথা মনে পড়ে। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয়। এর মাঝে নিপু আমাকে একদিন বলল ''আশিক ভাইয়ার সাথে আজকে একটা মেয়ে দেখলাম।''

কোন মেয়ে,কিভাবে কথা বলছিল,রিক্সায় কিভাবে বসেছিল,আশিক কি বেশি হাসছিল না কম হাসছিল? আমার এসব প্রশ্নের যন্ত্রনায় নিপু আর না পেরে রুম থেকেই চলে গেলো। ঠিকই তো? আমার এত গরজ কিসের? ও কার সাথে ঘুরে ফিরে তা আমার দেখার বিষয় না,এবং আজকে থেকে আমি এসব নিয়ে একদমই চিন্তা করবোনা...এরকম অনেক কথা নিজেকে বললাম। তারপর আমি আমার ল্যাপটপ অন করে ফেসবুকে ঢুকলাম। এবং আবারো আশিকের প্রোফাইলেই। আশিকের প্রোফাইল পিকে এবার সেই মেয়েটার সাথে ছবি। আগে যেটা দেখেছিলাম সেটা না। নতুন তোলা। আমি ছবিটা থেকে একদম চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কোন কারন ছাড়াই মনটা আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় নিপু আবার এল। ল্যাপটপের ছবিটা দেখে বলল
''আচ্ছা,তলে তলে তাহলে এই কাণ্ড?''
''কি কাণ্ড?''
''আরে এই মেয়েটাকেই তো দেখলাম আজকে। নিশ্চয়ই আশিক ভাইয়ার গার্ল ফ্রেন্ড''
সম্ভবত আমি এমন কিছুই আশা করেছিলাম। কিন্তু নিপু কনফার্ম করার পর আমার মনে হল নিপুকেই কষে একটা থাপ্পর মারি। পৃথিবী নামক বস্তুর উপর আমার অসম্ভব রাগ লাগছিল। মনে হচ্ছিলো আমি ছাড়া কোথাও কেউ নেই। আমি অনেক একা। কিন্তু আমিতো এটাই চেয়েছিলাম।
মিশন ''রেস্কিউ আশিক'' সফল। তবুও আমার এত খারাপ কেন লাগছে?


কিচ্ছু ভাল লাগেনা আমার...কি যে করি? এক এক বার ইচ্ছা হয় আশিক কে গিয়ে দুটা ঘুষি মেরে আসি। তাতে আমার মনে একটু শান্তি লাগবে। আবার মনে হয় এসব পাগলামির কোন অর্থই নেই। ও যখন আমার দিকে ভালবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল আমি তখন ভয় পেয়ে পালিয়েছিলাম। আমি এত ভিতু কেন? কি এমন হত ওকে ভালবাসি বললে? তারপর আবার মনে হয়,ও যদি সত্যি আমায় ভালবেসেই থাকে তবে এত জলদি অন্য মেয়ের সাথে কিভাবে রিলেশন করে? আমার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করলে এমন কি ক্ষতি হয়ে যেত? এসব চিন্তা করে আমার মাথা ফেটে যাওয়ার যোগাড়। আমার মনে হল, আমার সব প্রস্নের জবাব আশিকই সবচেয়ে ভাল ভাবে দিতে পারবে...ওর সাথে দেখা করাটা খুব দরকার।
ওকে ম্যাসেজ দিলাম,রিপ্লাই দিলনা। কল করলাম,রিসিভ করেনা। বুঝতে পারছি,এভাবে হবে না...


পরের দিন আমি আশিকের ভার্সিটি গিয়ে হাজির। আর কোন ভাবে ওকে ধরা সম্ভব না। আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটাকে সামনা সামনি দেখা। আমার শয়নে স্বপনে যেভাবে মেয়েটার ছবি দেখছি তাতে এক একবার মনে হয় আমিই ওর প্রেমে পড়ে গেছি! এটা ঠিক,দেখার পর আমি কি করবো সেই ব্যাপারে আমার আইডিয়া একদমই নাই। তবে রিঅ্যাকশন খুব খারাপ হবে আমি জানি। যাই হোক,আশার কথা হল আজকে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। রিক্সাঅলা ভাই আজকে পঙ্খিরাজের মত রিক্সা চালিয়েছেন, কাক কোকিল কোন কিছুই আমাকে ঠোকর ও মারেনি বা আমার গায়ে ইয়ে ও করেনি...যততুকু পথ হেঁটেছি কোন প্রবলেমই হয়নি। আজকে একেবারে যাকে বলে ''আমার দিন''।

ক্লাস শেষে আশিক বের হল। আমি পেছন দিকে ছিলাম বলে ও আমাকে খেয়াল করেনি। অনেক ক্ষন দেখলাম ফেসবুকের মেয়েটাকে দেখা যায় নাকি। দেখলাম না। আজকে আসেনি নাকি? আশিক ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে সামনের চায়ের দোকানে ঢুকল। এই সুযোগ । সবে মাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিবে তখনি আমি ওর সামনে গিয়ে বললাম ''তোর সাথে জরুরি কথা আছে,একটু বাইরে আয়''
হিহিহি...ওর চেহারা যা হয়েছিল না,খাবি খাওয়া মাছের মত...ওর বন্ধুরা একবার আমাকে দেখে,একবার ওকে দেখে...নিজেকে চিড়িয়া খানার জন্তু মনে হচ্ছিলো। তাই কথাটা বলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একটু পর বাঁদরটা বেরিয়ে এল
''তুই এখানে কেন?''
''কেন? আসলে সমস্যা?''
ও কিছু বললনা।
ভাবলাম যা বলার এখানেই বলে ফেলি ''তোর গার্ল ফ্রেন্ড কই?'' আমার কথা শুনে রাগে আশিকের চেহারাটা লাল টমেটোর মত হয়ে গেলো।
''ও,এই কথা জানতে এখানে আসলি?''
''তুই তো দেখালি না,তাই আমিই চলে আসলাম...লাবন্য,রুমকিদের কথা শুনে খুব তো তখন ভং ধরেছিলি । তা তোর মনের মধ্যে যে অন্য জিনিস ছিল আমাকে বললেই হতো ''
''ফালতু কথা বলে মেজাজ খারাপ করিসনাতো...''
''এখন ফালতু কথা হয়ে গেলো? আমাকে বললেই হত তোর অন্য মেয়ে কে ভাল লাগে ''
''তোকে কেন বলব? তুই কে? ''
''আমি কেউ না? তাহলে সেদিন কেন আমার জন্য কেন মারামারি করতে গিয়েছিলি ? আমি কাঁদলে তোর কি?''
''কথাটা নিজেকে জিগ্যেস করে দেখ,দিশা...আমার মনে হয় তুই আরো ভালো ভাবে জানিস''
''আমি কিভাবে জানব?''
''ঠিক...তুমিতো জানবানা...মাত্র কালকেই তো জন্মাইলা.....শুনে রাখ,আমি যদি ভং ধরি তাহলে তুই ঢং করিস''

অসম্ভব কান্না পাচ্ছে আমার। কেন এসেছি আমি এখানে? কি দরকার ছিল? আমি হাঁটা শুরু করলাম। আর কোন কথা বলবনা আমি এই বদ ছেলের সাথে। এই শেষ।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। আমি ''আজকে আমার দিন'' থিওরিকে মিথ্যা প্রমানিত করে আবারো আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম। আর ভ্যা করে কেঁদে দিলাম। আশিক তাড়াতাড়ি আমাকে তুলতে এলো। আশেপাশের সবাই হাসছে। চড় দিয়ে সবগুলোর দাঁত ফেলে দিতে পারলে ভাল লাগত আমার। কিন্তু আজকে আমার কপালই খারাপ। আজকে ওদের হাসার দিন।
আমি নাক টানতে টানতে আশিকের উপর ভর দিয়ে উঠলাম। পায়ে খুব ব্যাথা হচ্ছে। নাড়ালেই টান লাগে।
''আমাকে সিএনজি ঠিক করে দে,আমি চলে যাব''

ভয়ঙ্কর গরম চোখ নিয়ে ও আমার দিকে তাকাল। ওরে বাবা,সে চোখের যা দৃষ্টি..আমার আর কিছু বলার সাহস হলনা। এমনিতে আমি বাঘের বাচ্চা,কিন্তু ওর সামনে এরকম মেনী বিড়াল কেন হয়ে যাই? কয়েকটা নড়বড়ে বেঞ্চ ছিল ওখানে,আমার হাত ধরে সাবধানে একটা বেঞ্চ এর উপরে বসাল।
অনেকক্ষন চুপ থাকার পর আশিক বলল
''তোর সমস্যা কি আমাকে একটু বলবি?''
''আমার কোন সমস্যা নাই''
''আমার প্রেমিকা দেখার তোর এত শখ কেন?''
''একশ বার দেখব,হাজার বার দেখব''
আশিক হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়তে লাগলো। আমি আবার বললাম
''প্রেমিকা পেলে সবাইকে ভুলে যেতে হয়? তুই আমার কল রিসিভ করিস না,আমার সাথে কথা বলিস না...আমাকে দেখেও না দেখার ভান করিস...কেন? ''
''কি হবে কথা বলে? আমার ইচ্ছা করে না''
''তোর তাহলে কি সারাদিন প্রেমিকার সাথে ঘুরতেই ইচ্ছা করে?
''আমার ইচ্ছার কথা সত্যি জানতে চাস তুই?''
''জানতে চাই বলেই তো এখানে আসলাম।''
আশিক অনেক থেমে থেমে উত্তর দিল ''শোন তাহলে,আমার তোকে তুমি ডাকতে ইচ্ছা করে,তোর হাতটা ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করে...ভালবাসি বলতে ইচ্ছা করে''
ওর প্রতিটা শব্দ যে সত্যি তা বুঝতে আমার এক সেকেন্ডও লাগেনি। কিন্তু মাঝখানের ঘটনা গুলোর সাথে হিসাব মিলছেনা দেখে মেজাজটা আরো বেশী খারাপ হয়ে গেলো
''আমাকে ভালবাসিস তো অন্য মেয়ের সাথে তোকে দেখা যায় কেন?'' রাগে ফেটে পড়লাম আমি

এক মুহূর্ত চুপ করে আশিক আবার বলল, '' এগুলো সব নিপুর আইডিয়া ছিল। ও শুরু থেকেই জানত আমি তোকে ভালবাসি। আর ওই বলেছিল যে তুইও আমাকে ভালবাসিস,কিন্তু কখনই মানবিনা। ছবির মেয়েটা আমার জুনিওর এক বোন। সেদিন রিমুভ করার আগেই তোর কমেন্ট আমি দেখে ফেলেছিলাম। আমি অফলাইন মোডে ছিলাম বলে তুই ভেবেছিস আমি দেখবোনা । একথা নিপুকে বলার পর ও বলেছিল তোকে জেলাস ফিল করানোর জন্য প্রো পিক চেঞ্জ করতে। বাকি সব ও দেখবে...ও যা বলেছে আমি ঠিক তাই করেছি।''

আর যাই হোক,এ কথা আশা করিনি। আমারই বোন আমার সাথে এরকম নাটক করলো! উপর অলার আসলেই কোন বিচার নাই। আজকে বাসায় যাই,নিপুর কপালে অনেক দুঃখ আছে আজ...
আমি আশিকের সামনে আর কথা বাড়ালাম না। শান্ত ভাবে বললাম ''আমাকে বাসায় দিয়ে আয়''

সিএনজি তে বসে আছি। আশিক সিটের ওই মাথায় আর আমি এই মাথায়। কোন কথা বলছিনা। আশিক মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে আছে। এমন সময় ওর মোবাইলে একটা এসএমএস এলো। ও একটু অবাক হয়েই ওপেন করলো ম্যাসেজটা। আমি আড়চোখে দেখলাম ম্যাসেজটা পড়ে ওর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। কি দেখে ও এত খুশী আমি জানি,কারন ওটা আমারই পাঠানো। এসএমএস এ লিখা
''আজকের পর থেকে আমাকে তুই বলে ডাকলে জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলবো। ''

আবারও সেই চিরায়ত ভেটকি মাছ টাইপের হাসি দিয়ে ও আমার দিকে একটু সরে আসলো। একটু ভয়ে ভয়েই মনে হয়,আমার হাতটা যখন ধরতে যাবে ঠিক তখনি আশিকের মোবাইলে কল এলো,ওপাশ থেকে কি বলছে শুনিনি। কিন্তু আশিকের জবাব ছিল ''তোর ভাবীকে বাসায় পৌছে দিতে যাচ্ছি''
খুবই গৎবাঁধা ন্যাকা টাইপের কথা। কিন্তু এ প্রথম আমার মনে হল...নাহ,শুনতে ভালোই লাগছে তো !



শেষ হয়েও হইল না শেষ :

আমি আর আশিক কেমন আছি সেটা বলি এখন। দুদিন পর পর ঝগড়া না করলে ওর পেটের ভাত হজম হয়না। তারপর আবার আসে আমার রাগ ভাঙাতে...মাঝে মাঝে এত অসহ্য লাগে যে কি বলব? কেন যে ওকে সহ্য করছি আমি নিজেও জানিনা। রাত বিরাতে মোবাইলে কল দিয়ে আমার ঘুমটাই নষ্ট করে দেয়। বৃষ্টি হলেই আমাকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় বর্ষা বিলাস করবে বলে। আমার ল্যাপটপ নিয়ে গুতোগুতি করে আর বলে এখন থেকে আমার সব জিনিস নাকি ওর সম্পত্তি।

তবে একটা কথা বলতেই হয়,ও যখন মাঝরাতে হঠাৎ করে কল করে বলে ''তোমাকে অনেক ভালবাসি'' আমার ঘুম ভাঙ্গা দুচোখে মনে হয় আবার স্বপ্ন নেমে এসেছে। যখন ঝুম বৃষ্টিতে আমাকে বলে যে আজকে আমরা রিক্সায় হুড ফেলে দিয়ে ঘুরব,মনে হয় আজ আর বৃষ্টি না থামুক...যখন ল্যাপটপে ''মাই প্রিন্সেস'' দিয়ে কোন ফোল্ডার খুজে পাই যেখানে আমার অজস্র ছবি যা আমি জানিও না ও কখন কোন ফাঁকে তুলেছে...নাহ বলতেই হবে,আমি আসলে অনেক বেশী ভাল আছি। [:)] [:)]

এখন প্রায় সময় ও আমার পাশে পাশে থাকে। আমার আবার আছাড় খাওয়ার অভ্যাস আছে কিনা...



নাজমুন নুসরাত

8 comments:

  1. osadaron sundor kore likso tumi jodi sotti amon cau take tomr sate tobe take sob dida sera akre rako...

    ReplyDelete
  2. Ki bolbo,purai ocham ! hoise...a2z e story tar ekta bepar chilo. Valo :-D

    ReplyDelete
  3. sweet love story
    thank u

    ReplyDelete
  4. valobasar-golpo, thanks for this awesome story Tobu-o tumio aaj ghumiyo

    ReplyDelete